প্রায় এক বছর হল নরেন্দ্র মোদী মসনদে বসেছেন। তাঁর ‘আচ্ছে দিনের’ দেখা কিন্তু এখনও মেলেনি। ব্যাপারটা অনেকটা ‘তারে আমি চোখে দেখিনি, অনেক গল্প শুনেছি’ গোছের হয়ে উঠেছে।
তবে দেশের মানুষ যাই ভাবুন বড় মাপের কিছু বিদেশি সংস্থা এখনও বিশ্বাস করে সুদিন আসতে চলেছে। আইএমএফ, বিশ্বব্যাঙ্ক-সহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক অর্থসংস্থার ধারণা আগামী দু’বছরের মধ্যেই ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার পৌঁছে যেতে পারে ৮ শতাংশের আশেপাশে। একই বিশ্বাস অর্থমন্ত্রীর। বাস্তব কিন্তু তেমন ইঙ্গিত দেয় না। চলতি মাসগুলিতে দেশের অগ্রগতির পরিসংখ্যান আদৌ এর ধারে-কাছে নেই। মার্চে মূল পরিকাঠামো শিল্পে বৃদ্ধির হার ছিল শূন্যের ০.১০% নীচে, অর্থাৎ এই হারে উৎপাদন কমেছে। মূল পরিকাঠামো শিল্প বা ‘কোর সেক্টর’ বলতে বোঝায় ইস্পাত, সিমেন্ট, কয়লা, বিদ্যুৎ, অশোধিত তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, রাসায়নিক সার এবং তেল শোধন শিল্প। মার্চে এই আট শিল্পের গড় উৎপাদন ছিল গত ১৭ মাসের মধ্যে সবথেকে কম। ২০১৪-’১৫ সালে এই শিল্প বেড়েছে মাত্র ৩.৫% হারে, যা গত ৬ বছরে সবথেকে কম। পাশাপাশি, রফতানিও ঠেকেছে তলানিতে। বেশ হতাশ করা ফল প্রকাশ করেছে বেশির ভাগ বড় মাপের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা। মোদীর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পও তেমন সাড়া জাগায়নি শিল্পমহলে।
অন্য দিকে বর্ষা নিয়ে আগাম বার্তা সুখকর নয়। কেন্দ্রের সঙ্গে কর নিয়ে বিবাদে এরই মধ্যে ফিরে গিয়েছে বিদেশি আর্থিক সংস্থার মোটা অঙ্কের লগ্নি। শুধু শেয়ার নয়, টাকা তুলে নেওয়া হচ্ছে বন্ডের বাজার থেকেও। ফলে দ্রুত ডলারের তুলনায় ভারতীয় টাকার দাম পড়ছে। এই সব তথ্য আদৌ আশা জাগায় না। এই কারণে শেয়ার সূচক ক্রমশ নামছে। এই পতন প্রভাব ফেলেছে মিউচুয়াল ফান্ডের দুনিয়ায়। গত দু’মাসে বেশির ভাগ ইক্যুইটি প্রকল্পের ন্যাভ কমেছে কম-বেশি ১০%।
যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেওয়া হয় মোদী-জেটলি যেমন ভাবছেন, ভারত সেই গতিতেই এগোবে, তা হলেও কি সাধারণ মানুষের অবস্থার বিরাট কোনও পরিবর্তন হবে? সরকারি হিসেবে মূল্যবৃদ্ধির হার যতই কমুক, খাদ্যদ্রব্যের বাজারে যে-আগুন জ্বলছে, তা দেশের সব দমকল মিলেও হয়তো নেবাতে পারবে না, বিশেষ করে বর্ষা যদি কম হয়। এক দিকে যখন খাদ্যপণ্যের দামের এই অবস্থা, অন্য দিকে তখনই পণ্যমূল্য কমছে এই অজুহাতে জমার উপর সুদ কমতে শুরু করেছে সর্বত্র। বিভিন্ন ব্যাঙ্কের মেয়াদি আমানতে এরই মধ্যে সুদ কমানো হয়েছে কম-বেশি ৫০ বেসিস পয়েন্ট। আগামী মাসে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আরও সুদ কমানোর সম্ভাবনা বেশ প্রবল। তা যদি হয়, বেশ বিপাকে পড়বেন অসংখ্য সুদ-নির্ভর মানুষ।
কার্যত, দেশের অগ্রগতির সিংহভাগ উপর তলাতেই থেকে যায়। মূষিকাংশ ছাঁকনি গলে নীচের তলায় নামে। কিন্তু একই বাজারে বাজার করতে হয় সবাইকে। একই হারে পরিষেবা কর (১৪%) দেন ধনী-দরিদ্র সকলে। ফলে শুধু পরিসংখ্যান অর্থনীতির যে-ছবি তুলে ধরে, তাতে মূল সমস্যার সমাধান হবে না। সত্যিকারের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে নীচের তলাতে। তবেই স্পষ্ট হবে ভারতের অগ্রগতির ছাপ।
অনেকের আশানুরূপ আর্থিক ফল না-হলেও, কিছু নামী সংস্থা, বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলি কিন্তু বেশ ভাল ফল প্রকাশ করেছে। গত সপ্তাহে নজরকাড়া ফলাফল বার করেছে দেশের বৃহত্তম গাড়ি নির্মাতা মারুতি-সুজুকি। মার্চ মাসে সমাপ্ত তিন মাসে মারুতির নিট লাভ ৬০.৫% বেড়ে পৌঁছেছে ১,২৮৪ কোটি টাকায়। গোটা বছরে লাভ বেড়েছে ৩৩%। ছাড়িয়েছে ৩,৭০০ কোটি টাকা। ২০১৪-’১৫ সালে সংস্থা বিক্রি করেছে ১১.৭০ লক্ষ গাড়ি। বিক্রির নিটমূল্য ১৩২৭২ কোটি।
বছরের শেষ ৩ মাসে দেশের বৃহত্তম বেসরকারি ব্যাঙ্ক আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কের লাভ ১০% বেড়ে ২,৯২২ কোটি টাকায় পৌঁছলেও ব্যাঙ্কের সম্পদের গুণগত মান কিন্তু কমেছে। অন্য দিকে বেশ ভাল ফল প্রকাশ করেছে অ্যাক্সিস ব্যাঙ্ক। শেষ তিন মাসে ব্যাঙ্কের মুনাফা ১,৮৪২ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২১৮১ কোটি। গোটা বছরের মুনাফা ৭৪৪৮ কোটি। এই নিয়ে সব বেসরকারি ব্যাঙ্কই আগের তুলনায় উন্নত ফল প্রকাশ করল। এখন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির ফলাফলের জন্য। বহু ফলাফল আমাদের সামনে আসবে মে মাসের বাকি দিনগুলিতে। বাজার এখন বেশ নীচে। ফলাফল দেখে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য ভাল শেয়ার সংগ্রহের এটি একটি আদর্শ সময়।
তবে খুব তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, তেমন হতাশ হওয়ার সময় এখনও আসেনি। মোদী সরকার এখনও পর্যন্ত দেশকে যে-ফল উপহার দিতে পেরেছে, তা খুব সুস্বাদু না-হলেও এর ভেতরে যে-বীজ আছে, তার সম্ভাবনা কম নয়। জনসংখ্যা ভারতের বড় শক্তি। অর্থনীতি ধীরে এগোলেও চাহিদার অভাব হবে না। তা মেটানোর জন্য শিল্প ও কৃষির চাই বড় মূলধন। আর, তার জন্য চাই শক্তিশালী শেয়ার বাজার। ভারত দ্রুত এগোবে এই আশ্বাসে ভরসা রেখে অনেক সংস্থাই নতুন ইস্যু আনার পথে এগোচ্ছে। নতুন ইস্যুর বাজারে যে-জল ইতিমধ্যেই বইতে শুরু করেছে, জুন-জুলাইয়ের ভরা বর্ষায় তা হয়তো জোয়ারে পরিণত হবে। সেবির দফতর থেকে পাওয়া যাচ্ছে তেমনই ইঙ্গিত।