মিলানে মুখ্যমন্ত্রী। সোমবার।
লগ্নি টানতে জার্মানিতে রাজ্যের ‘সুখী ক্রেতা’ ও বড় বাজারের ছবি তুলে ধরেছিলেন। এ বার ইটালি থেকে বিনিয়োগ পেতে প্রযুক্তি আর দক্ষ মানবসম্পদের যুগলবন্দিকে হাতিয়ার করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ইউরোপে রেনেসাঁর আঁতুড় থেকে লগ্নির খোঁজে ইটালিতে ভারতীয় দূতাবাস ও বণিকসভা ফিকির সহযোগিতায় সোমবার মিলানে সম্মেলনের আয়োজন করেছিল রাজ্য। সেখানে সে দেশের শিল্প মহলের সামনে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আপনাদের হাতে যেমন আধুনিক প্রযুক্তি, তেমনই পশ্চিমবঙ্গে অঢেল দক্ষ মানবসম্পদ। তার উপরে সেই দক্ষতা কাজে লাগানো সম্ভব উন্নত দুনিয়ার তুলনায় নামমাত্র খরচে।’’ এই সুবিধা নিতে তাই লগ্নির ঝুলি হাতে রাজ্যে পা রাখতে ইটালীয় শিল্প মহলকে আহ্বান জানালেন তিনি।
ফ্রাঙ্কফুর্টের ধাঁচে মিলানেও শিল্পের মনজয়ের লক্ষ্যে আবেগ আর তথ্যের মিশেলে আস্থা রেখেছেন মমতা। বাঙালির পাতে পিৎজা-পাস্তা জনপ্রিয় হওয়ার কথা বলেছেন। মনে করিয়েছেন, ভারতে সহজে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে রাজ্য শীর্ষে। বাঙালির ফুটবল প্রেমের প্রসঙ্গে যেমন বিশ্বকাপ, এ সি মিলানকে টেনেছেন, তেমনই তুলে ধরেছেন চর্মশিল্প ও ছোট-মাঝারি শিল্পে সম্ভাবনার কথা।
ইটালির শিল্প প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে আঁচ পাওয়া গিয়েছে, এ দেশের অর্থনীতির হাল তেমন সুবিধার নয়। মিলানে বিশ্বখ্যাত ‘ফ্যাশন উইক’ রমরমিয়ে শেষ হল ঠিকই। কিন্তু ফেরারি কিংবা জিয়োর্জিও আর্মানির মতো ব্র্যান্ডের আঁতুড় ঘরে চাহিদায় টান বহু পণ্যেরই। তাই গাড়ি থেকে পোশাক— হন্যে হয়ে নতুন বাজার খুঁজছে অনেক ইতালীয় সংস্থাই।
সম্ভবত সেই নাড়ি টিপেই মমতা বোঝাতে চেয়েছেন, কী ভাবে রাজ্যে পা রাখলে খুলবে পূর্ব, উত্তর-পূর্ব ভারত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশাল বাজার। ফের সেই সূত্রে তুলেছেন সরকারি সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের কথা। তাঁর যুক্তি, মানুষের হাতে টাকা আর মুখে হাসি থাকলে তবেই তো বাজারের দিকে পা বাড়াবেন।
কিন্তু লগ্নির জন্য শিল্প রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চায়। চাহিদার তালিকায় থাকে জমি, প্রকল্পে দ্রুত ছাড়পত্র। মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রীর পাশাপাশি অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র ও মুখ্যসচিব মলয় দে-র দাবি, লাল ফিতের ফাঁস নয় বরং লগ্নির জন্য লাল কার্পেট বিছিয়ে দিতে তৈরি রাজ্য। খোদ মুখ্যমন্ত্রী বললেন জমি-ব্যাঙ্ক ও জমি-নীতি তৈরি থাকার কথা। পরে একান্ত আলাপচারিতায় মাফিয়ার উপদ্রব সামলে ব্যবসা করায় অভ্যস্ত ইতালীয় শিল্পমহলের কেউ কেউ ভারতীয় প্রতিনিধিদের অবশ্য প্রশ্ন করছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে লগ্নির পরিবেশ সত্যিই শিল্পের অনুকূল তো?
বন্ধ বন্ধ থেকে ই-গভর্ন্যান্স— সব শুনে বণিকসভা কনফিনদাস্ত্রিয়া কাসেত্রার প্রেসিডেন্ট জিয়ানলুইগি তারেত্তিনো জানালেন, পরের বিশ্ব বঙ্গ শিল্প সম্মেলনে আসবেন তাঁরা। পাখির চোখ কৃষিপণ্য, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, গয়না শিল্প। আর এক বণিকসভা আসোলোম্বার্দা কনফিনদাস্ত্রিয়া মিলানোর ভাইস প্রেসিডেন্ট আলেসান্দ্রো স্পাদা বলেন, তাঁদের লক্ষ্য ছোট-মাঝারি শিল্প। কাউন্সিল ফর লেদার এক্সপোর্টসের পূর্বাঞ্চলীয় চেয়ারম্যান রমেশ জুনেজার দাবি, লেদার পার্ক সংস্কারের কাজ শুরু হওয়ায় রাজ্যে আগ্রহ দেখাতে পারে ইটালির জুতো তৈরির সংস্থাগুলি।
উৎপাদন শিল্প থেকে উচ্চশিক্ষা— সব ক্ষেত্রেই যে লগ্নি স্বাগত, তা বোঝাতে চেয়েছেন মমতা। রাজ্যে ব্যবসার অভিজ্ঞতা বলতে মঞ্চে তুলে এনেছেন শিল্পপতিদের। অনুষ্ঠান শেষে ইটালীয় শিল্পমহলের অনেকে বলেন, এত দিন লগ্নির ক্ষেত্রে চিনকেই নিশানা করেছে তাঁদের দেশ। বড় সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে ভারতে আরও ভাল করে মাটি পরখের ক্ষেত্রে। সেই ‘ত্রুটি’ নাকি এখন শোধরাতে চান তাঁরা।
কিন্তু সেই সুবিধা বাংলা নিতে পারবে কি? উত্তর মিলল, ‘‘ভেদিয়ামো’’। অর্থাৎ, দেখা যাক।