ছড়াচ্ছে বিক্ষোভের আগুন। মঙ্গলবার আথেন্সে পার্লামেন্ট ভবনের সামনে। ছবি: এএফপি।
গ্রিস সঙ্কট ট্র্যাজেডির দিকেই এগোবে কি না, তার উত্তর দেবে রবিবারের গণভোট। তবে আপাতত গ্রিস ও ইউরোপের বাদবাকি দেশগুলির মধ্যে সন্ধির আশা নেই বলেই মঙ্গলবার ইঙ্গিত মিলেছে। কারণ গ্রিসের প্রধান ঋণদাতা জার্মানি ভোটের আগে কোনও রকম রফায় না-আসার ব্যাপারে এককাট্টা।
সরকারি খরচ কমানো ও কর বাড়ানোর শর্ত মেনে নিয়ে ত্রাণ প্রকল্পে সায় দেওয়া, না কি ইউরো অঞ্চল থেকে বেরিয়ে যাওয়া, এ নিয়ে রবিবারের গণভোটের আগে আপাতত ত্রাণ প্রকল্প বহাল রাখতে শেষ মুহূর্তে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে মঙ্গলবার আর্জি জানিয়েছিল মরিয়া গ্রিস। সে ক্ষেত্রে আইএমএফের ঋণ মেটানোর সুযোগও পেতে পারত তারা। দু’বছরের জন্য তহবিল জোগানো চালিয়ে যেতে অনুরোধ জানান গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপ্রাস। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর আর্জি মানা যাবে কি না, তা নিয়ে কথা বলতে ইউরোপীয় অঞ্চলের অর্থমন্ত্রীদের জরুরি বৈঠক ডাকেন ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান জাঁ ক্লদ জুঙ্কার। শর্ত মেনে ত্রাণ প্রকল্পে সায় দিতে তিনি গ্রিসকে ফের আহ্বান জানান। কিন্তু সব আশায় জল ঢেলে দেন গ্রিসের সবচেয়ে বড় ঋণদাতা দেশ জার্মানির চান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেল। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, ৫ জুলাইয়ের গণভোটের আগে নতুন করে কোনও আলোচনায় মত নেই তাঁর। গণভোটে গ্রিস ত্রাণ প্রকল্পের শর্ত মানতে সায় দিলে তবেই ফের খুলবে আলোচনার দরজা।
এর জেরে আইএমএফের ১৬০ কোটি ডলারের ঋণ গ্রিস মেটাতে পারবে না। কারণ ভাঁড়ার ফাঁকা। আইএমএফকে সরকারি ভাবে সরাসরি ‘না’ বলে দিয়েছেন গ্রিসের অর্থমন্ত্রীও। শেষ মুহূর্তে আর কোনও রফাসূত্র না-মিললে এই প্রথম তথাকথিত উন্নত দুনিয়ার কোনও রাষ্ট্র ঋণখেলাপির তকমা পেতে চলেছে, ইতিহাসে যার নজির নেই। গ্রিস বসতে চলেছে জিম্বাবোয়ে, সুদান, কিউবার সঙ্গে এক সারিতে।
গ্রিসের প্রধানমন্ত্রীও ওই ভোটে ত্রাণ প্রকল্পের বিপক্ষেই রায় দিতে কার্যত আর্জি জানিয়েছেন জনগণকে। তাঁর মতের পক্ষেই বিপুল সংখ্যক জনগণ মঙ্গলবার ঋণদাতা দেশগুলির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখান আথেন্স ও থেসালোনিকি শহরের বিভিন্ন রাস্তায়। তাঁদের হাতে ছিল ব্যানার, যাতে লেখা ছিল, ‘‘আমরা ঋণদাতাদের হাতের পুতুল নই।’’ বেকারত্বের সমস্যায় নাজেহাল নাগরিকদের বলতে শোনা যায়, ‘‘আমরা ইউরো চাই না, সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে চাই।’’ গণভোটে তাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেঁধে দেওয়া শর্ত মেনে ত্রাণ নেওয়ার বিপক্ষেই ভোট দিতে চান অনেকে। এই ‘না’ ভোটকে তাঁরা স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল বলেই মনে করছেন। তবে সংস্কারপন্থীরাও এ দিন সরব হন। ফলে পার্লামেন্ট ভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষ বাঁধে।
পাশাপাশি, গ্রিসের সঙ্কটে তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চেয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। এ জন্য ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁকোয়া হল্যান্ডে-কে সঙ্গে নিয়ে নতুন একটি ঋণ প্যাকেজ তৈরি করতে চান তিনি। তাঁরা এক বিবৃতিতে জানান, গ্রিসের পরিস্থিতির প্রতি নজর রাখার কথা। গ্রিস যাতে ইউরোপে থেকেই বৃদ্ধির সড়কে ফিরতে পারে, সে জন্য আমেরিকা আর্থিক সংস্কারের একটি পথনির্দেশও তৈরি করে দিতে চায় বলে জানান হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব জোশ আর্নেস্ট। তিনি বলেন, ‘‘অভিন্ন ইউরোপীয় মুদ্রা ইউরো নিয়েই যাতে গ্রিস ছন্দে ফিরতে পারে, সেই আশাই করব। আশা করি এ ব্যাপারে বাকিরাও একই লক্ষ্যে এগোবেন।’’ ওবামা এ প্রসঙ্গে অবশ্য বলেন, ‘‘গ্রিসের সঙ্কট যথেষ্ট উদ্বেগের। তবে আমেরিকায় তার বড় কোনও প্রভাব পড়বে না।’’
তবে সোমবারই গ্রিসের রেটিং কমিয়ে দিয়েছিল মূল্যায়ন সংস্থা এস অ্যান্ড পি। আন্তর্জাতিক ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা একেবারে তলানিতে নামিয়ে ওই রেটিং ধরা হয় সিসিসি-মাইনাসে। মঙ্গলবার আর এক মূল্যায়ন সংস্থা ফিচ জানিয়েছে, গোটা ইউরোপের আর্থিক বৃদ্ধিকে টেনে নামাতে পারে গ্রিস সঙ্কট।
অন্য দিকে গ্রিসের সঙ্কটের প্রভাব মঙ্গলবার পড়েনি ভারতীয় শেয়ার বাজারে। এক দিকে পড়তি বাজারে শেয়ার কেনার সুযোগ, অন্য দিকে গ্রিসের সমস্যার মাঝেও বিশ্বের বেশ কিছু শেয়ার বাজারের গা ঝাড়া দিয়ে ওঠা, এই দুইয়ের জেরে ভারতে চাঙ্গাই ছিল সূচক। এ দিন সেনসেক্স ১৩৫.৬৮ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়ায় ২৭,৭৮০.৮৩ অঙ্কে। এর আগে টানা দু’দিনের লেনদেনে তা পড়েছিল ২৫০.৮২ পয়েন্ট। সোমবার পতনের কারণ ছিল গ্রিস সঙ্কট। ভারত ছাড়াও এশিয়ার বেশ কিছু শেয়ার বাজারে মঙ্গলবার সূচকের মুখ ছিল উপরের দিকে। তবে ইউরোপের শেয়ার বাজার এ দিনও পড়েছে। কিছুটা ঘুরে দাঁড়ায় মার্কিন বাজার।
ভারতীয় শিল্পমহলও মনে করছে গ্রিস কাণ্ডের জেরে ভারতের অর্থনীতির উপর তেমন কোনও আঘাত আসবে না। বণিকসভা সিআইআইয়ের ডিরেক্টর জেনারেল চন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, গ্রিসের পরিস্থিতি যে এই দিকে মোড় নিতে চলেছে, সেটা প্রত্যাশিতই ছিল। এই ঝুঁকি সহ্য করার ক্ষমতা ভারতের আছে। তার কারণ: এ দেশের অর্থনীতির ভিত যথেষ্ট শক্তিশালী, রাজকোষ ঘাটতি নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল রেকর্ড ছুঁয়েছে, ডলারে টাকার দামও স্থিতিশীল। ফলে গ্রিসের সঙ্কটের বিরূপ প্রভাব এড়ানো ভারতের পক্ষে কঠিন হবে না। উপরন্তু অর্থনীতিতে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার যে-সব ব্যবস্থা নিচ্ছে, তারও প্রশংসা করেছে সিআইআই। যার জেরে আর্থিক বৃদ্ধি নতুন করে গতি পেতে চলেছে বলে আশাবাদী চন্দ্রজিৎবাবু।
শেষ পর্যন্ত ইউরোপের অভিন্ন মুদ্রা ইউরো না পুরনো মুদ্রা ড্রাকমা, গ্রিস কাকে বেছে নেয়, সে দিকেই অবশ্য এখন নজর সারা দুনিয়ার। ইউরো ছেড়ে বেরিয়ে এলে দুর্বল ড্রাকমা দিয়ে আমদানি-নির্ভর গ্রিস তার প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে পারবে না বলেই আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। সে ক্ষেত্রে আরও ঘোরালো হয়ে উঠতে পারে গ্রিস সঙ্কট।