রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর পদে দ্বিতীয় দফার দৌড় থেকে রঘুরাম রাজন সরে দাঁড়ানোর পরেই মোদী সরকারকে বিদ্রুপে বিঁধেছিলেন পি চিদম্বরম। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল, রাজনের মতো গভর্নর পাওয়ার যোগ্যতা নেই এই এনডিএ সরকারের। মাস ঘুরল না। তার আগেই তাঁর জমানার শীর্ষ ব্যাঙ্ক কর্ণধারের তীব্র আক্রমণের মুখে পড়লেন চিদম্বরম নিজেই। বাদ গেলেন না ইউপিএ জমানার আর এক অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ও।
শুক্রবার বাজারে এসেছে রাজনের পূর্বসূরি ডি সুব্বারাওয়ের বই ‘হু মুভড্ মাই ইন্টারেস্ট রেটস’। ৩৫২ পাতার ওই বইয়ে দুই অর্থমন্ত্রীকে কার্যত তুলোধোনা করেছেন তিনি। লিখেছেন, তাঁর আমলে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সুদ না-কমানোর অনড় অবস্থান নিয়ে বিরক্ত ছিলেন চিদম্বরম ও প্রণববাবু। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, বৃদ্ধির চাকায় গতি বাড়ার পথে বাধা চড়া সুদের হার। তা নিয়ে সরকারের সঙ্গে সংঘাতের মাসুলও তাঁকে গুনতে হয়েছে বলে সুব্বারাওয়ের দাবি।
রাজন-বিতর্ক এখনও টাটকা। তার মধ্যে শীর্ষ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নরের এই মন্তব্য ফের উস্কে দিয়েছে পুরনো বিতর্ককে। অনেকে বলছেন, দিল্লিতে নর্থ ব্লকের অর্থ মন্ত্রক আর মুম্বইয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কে গভর্নরের ১৯ তলার অফিসে মুখ পাল্টায়। কিন্তু বদলায় না দু’পক্ষের সমীকরণ। শীর্ষ ব্যাঙ্ক মূল্যবৃদ্ধিতে রাশ টানার লড়াইয়ে নাছোড়। তার জন্য চট করে সুদ কমাতে তাদের আপত্তি। উল্টো দিকে, অর্থ মন্ত্রক পাখির চোখ করে বৃদ্ধির হারকে। যে কারণে সস্তায় ঋণের বন্দোবস্ত করতে সুদ কমানোর পক্ষে সওয়াল করে তারা। চেষ্টা করে তা নিয়ে চাপ তৈরি করার। অর্থ মন্ত্রকে প্রণববাবু থেকে চিদম্বরম হয়ে অরুণ জেটলি। শীর্ষ ব্যাঙ্কে সুব্বারাও থেকে রাজন। দু’তরফের এই কুস্তি সারাক্ষণ জারি থাকে বলেই সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি।
২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে সুব্বারাও শীর্ষ ব্যাঙ্কের কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার দিন দশেক পরেই দেউলিয়া ঘোষণা করে মার্কিন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্ক লেম্যান ব্রাদার্স। শুরু হয় বিশ্বজোড়া মন্দা। সেই কঠিন পরিস্থিতিতে পাঁচ বছর (প্রথম দফায় ৩ আর দ্বিতীয় দফায় ২) রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হাল ধরেছিলেন সুব্বারাও। সেই স্মৃতির ঝুলি উপুড় করতে গিয়ে তিনি তুলে এনেছেন এমন অনেক ঘটনা, যা বুঝিয়ে দেয় যে, সুদ নির্ধারণ নিয়ে ঠিক কী ধরনের টানাপড়েন চলে নর্থ ব্লক আর মিন্ট স্ট্রিটের মধ্যে।
সুব্বারাও জানিয়েছেন, দ্বিতীয় দফায় তাঁকে ফিরিয়ে আনতে আগ্রহী ছিলেন না প্রণববাবু। তা সত্ত্বেও তিনি ফেরেন মূলত প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের উদ্যোগে। সেই নিয়োগ তাঁকে জানতে হয়েছিল টিভি থেকে। পরে ফোনও এসেছিল প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে। অর্থ মন্ত্রক টুঁ শব্দটি করেনি। তিনি লিখেছেন, সুদ কমানোর জন্য অনেক সময় প্রবল চাপে পড়তে হয়েছে। নাক গলাতে চেষ্টা করেছে অর্থ মন্ত্রক। সরকারের সঙ্গে একমত না হওয়ার মাসুলও গুনতে হয়েছে। কখনও দুই ডেপুটি গভর্নরের (ঊষা থোরাট ও সুবীর গোকর্ণ) মেয়াদ বাড়ানোর সুপারিশ করেও সায় পাননি। আবার কখনও মেক্সিকোয় নৈশভোজে তাঁকে অস্বস্তিতে ফেলে দেখেও-না-দেখা করেছেন চিদম্বরম। দু’পক্ষের মতানৈক্যকে বন্ধ দরজার বাইরে এনে বলেছেন, ‘‘চড়া মূল্যবৃদ্ধির মতো ঢিমে বৃদ্ধিও একই রকম গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। বৃদ্ধির গতি বাড়াতে প্রয়োজনে একাই চলতে তৈরি কেন্দ্র।’’ সম্প্রতি এক লেখায় ওই কংগ্রেস নেতার দাবি ছিল, তাঁর সময়ে ১০টির মধ্যে ৮টি ঋণনীতিতেই একমত ছিল কেন্দ্র ও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। তেমন গলাগলি অন্তত সুব্বারাও মনে করতে পারেননি। তবে টালমাটাল সময়ে টাকার দামকে থিতু করায় প্রশংসা করেছেন রাজনের।
জমানার শেষ দিকে সুব্বারাও বলেন, ‘‘আমার বিশ্বাস, চিদম্বরম এক দিন বলবেন...ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আছে।’’ আজকের পরে শীর্ষ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর সম্পর্কে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীর তেমন ভাবার সম্ভাবনা কম।