একটি চিনা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের দৌড়ানো বাধ্যতামূলক করিল। চিনে তিন দশক পূর্বেও স্থূলতা প্রায় অ-দৃষ্ট ছিল, কিন্তু ২০১৪-র এক সমীক্ষায় দেখা গিয়াছে ৪৩.২ মিলিয়ন চিনা পুরুষ ও ৪৬.৪ মিলিয়ন নারী স্থূলকায়। তদ্ব্যতীত, ছাত্রদের শরীরগঠন অতি প্রয়োজন, তাহারা দৈহিক ভাবে সুস্থ সবল হইলে, মানসিক ভাবেও তৎপর থাকিবার সম্ভাবনা। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ম করিয়াছে, ছাত্রদের ১০৪ মাইল এবং ছাত্রীদের ৭৪ মাইল দৌড়াইতে হইবে, পাঁচ মাস সময়ের মধ্যে। কোনও ছাত্র কত দূরত্ব কত সময়ে কত গতিতে অতিক্রম করিল, তাহা মাপিতে একটি অ্যাপ তৈয়ারি করা হইয়াছে, যাহা জিপিএস-এর সাহায্যে পরিমাপগুলি করিবে। তিন বৎসর পূর্বে এক চিনা বিশ্ববিদ্যালয় বলিয়া দিয়াছিল, ব্যায়ামে যথেষ্ট নম্বর না পাইলে ছাত্রেরা প্রাপ্য বৃত্তি হইতে বঞ্চিত হইতে পারে। দুই বৎসর পূর্বে একটি চিনা বিশ্ববিদ্যালয় বলিয়াছিল, স্নাতক হইবার পূর্বে সাঁতার শিখিতেই হইবে, ৫০ মিটার সন্তরণ না পারিলে স্নাতক হইবার আশা নাই। আর এক বিশ্ববিদ্যালয় দৌড় বাধ্যতামূলক করিয়াছিল, তাহার জন্য প্রযুক্তিও ব্যবহার করিয়াছিল, কিন্তু তাহা অ্যাপ পর্যন্ত পৌঁছায় নাই। তাহারা মাঠে দৌড়াইবার ট্র্যাকের দুই প্রান্তে দুইটি পোস্ট রাখিয়াছিল। শুরুর পোস্টটিতে ছাত্র একটি কার্ড স্ক্যান করিয়া, নিজস্ব পরিচিতির সংখ্যা দিয়া, নিজের মুখের ছবি তুলিয়া, দৌড়াইতে শুরু করিবে। দৌড় শেষ হইলে, সেই প্রান্তের পোস্টটিতে কার্ডটি পুনরায় স্ক্যান করিলেই, তাহার দৌড়ের সময়টি নথিভুক্ত হইয়া যাইবে। শীতের ছুটির পূর্বে এমন অন্তত ২৪টি দৌড় সকল ছাত্রছাত্রীকে দৌড়াইতে হইবে, ইহা ছিল ফরমান। প্রতি মাসে সেরা দৌড়বাজের নাম ঘোষণা করা হইত এবং পুরস্কার দেওয়া হইত। এখন যে বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাপ দিয়া দৌড় মাপিতেছে, বলিয়া দিয়াছে, যে ভাল দৌড়াইবে না, তাহার স্নাতক হইবার পরীক্ষায় পাশ করা ক্রমশ কঠিন হইয়া পড়িবে।
এই প্রকারের প্রয়াসের উদ্দেশ্য মহৎ, সমস্যা বাধ্যতা লইয়া। চিন এমন এক রাষ্ট্র, যাহা বিশ্বাস করে, মানুষকে দিয়া কিছু করাইতে হইলে, পাঁচনবাড়ি হস্তে লইয়া চক্ষু রাঙাইয়াই তাহা সাধিত করিতে হয়। দর্শনটি মন্দ নহে, কারণ মানুষ আলস্যপ্রিয়, তাহারা দণ্ডের ভয়ে যেমন দৌড়াইবে, কেবল সৎপরামর্শের প্রণোদনায় তাহা করিবে না। পৃথিবীময় বিভিন্ন দেশে প্রতি দিন গণমাধ্যম ও সরকার মিলিয়া কর্ণপটহ বিদীর্ণ করিয়া বলিতেছে, এইটি খাইবেন না, ওইটি পান করিবেন না, অমুক আপনার পক্ষে ক্ষতিকর। তাহার পরিবর্তে বরং ব্যায়াম করুন, আপেল খান, নেশাদ্রব্য পরিহার করুন, তাড়াতাড়ি শুইয়া পড়ুন। কিন্তু মানুষ ফেসবুক লইয়া যত ব্যস্ত ও হোয়াটসঅ্যাপ লইয়া যত পুলকিত, নিজেকে ঘাতক ডেঙ্গি হইতে বাঁচাইবার তাগিদেও মশারি টাঙাইতে তত উৎসাহী নহে, জমা জল ফেলিতে তেমন তৎপর নহে। সেই ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এই ধরিয়াবাঁধিয়া সবাইকে দৌড়ের পথে নামাইয়া দেওয়া হয়তো অধিক কার্যকরই বটে। কিন্তু কেবল কার্যকারিতার ভিত্তিতে আদেশ দিলে, প্রায়ই মানুষের স্বাধীনতার ব্যাপারটি উপেক্ষিত থাকিয়া যায়।
বিদ্যায়তনের ক্যাম্পাসে সকলে ক্লাস শেষ করিয়াই দৌড়ের জুতা পরিয়া, ফোনে অ্যাপ চালু করিয়া মাঠে হাঁপাইতে হাঁপাইতে ধাবমান, দেখিয়া দেশের রূপকারেরা হৃষ্ট হইতে পারেন, কিন্তু ইহার মধ্যে প্রাণশক্তির স্ফূর্তি অপেক্ষা কর্তৃপক্ষের রোষবৃত্ত হইতে প্রাণপণ পলায়নের ইঙ্গিতই অধিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র প্রাথমিক শ্রেণিভুক্ত শিশু নহে, তাহার ভালমন্দের উপায় বাছিয়া লইবার অধিকার তাহাকে দিতে হইবে। দৌড় ও অন্যান্য ব্যায়ামের প্রতি উৎসাহ দান অবশ্যই করা যাইতে পারে, শারীরিক ভাবে অধিক সক্ষমকে পুরস্কৃত করাও যাইতে পারে, কিন্তু না দৌড়াইলে পরীক্ষার নম্বর কাটা যাইবে কেন? ছাত্র কেন খেলার সময়টিতে বসিয়া কাব্যগ্রন্থ পাঠ করিতে পারিবে না, বা গণিতের রহস্যে নিমজ্জিত হইতে পারিবে না? কাহারও হয়তো শরীরচর্চা বিষয়ে প্রবল অনীহা, অথচ সে ছাত্র হিসাবে অসামান্য, সে দেশকে তাহার বুদ্ধি দিয়া সেবা করিতে পারিবে ও সেই বুদ্ধি শাণিত করিবার প্রক্রিয়াতেই তাহার আনন্দ ও ব্যস্ততা। ফতোয়া আরোপ করিয়া সাধারণত মানুষকে বিকশিত করা যায় না, বিদ্যাস্থানে তো তাহা নিতান্ত অন্যায়, কারণ শিক্ষার মূল অবদান স্বাতন্ত্র্য, সমষ্টি-অনুসরণ নহে। সকল ব্যক্তিকে এক ছাঁচে ঢালাই করিতে চাহিলে, দেহ হয়তো জড়তামুক্ত হইবে, মনন হইয়া পড়িবে আড়ষ্ট।
যৎকিঞ্চিৎ
মহাপুরুষরা বলেছেন, মানুষের পক্ষে সব সম্ভব। আমরা শুনেছি, বিশ্বাস করিনি, যদ্দিন না অাইপিএল এল। এখন দেখা যাচ্ছে, খুব কম বলে অবিশ্বাস্য রান করা সম্ভব, স্পেশাল এফেক্ট ছাড়াই উড়ে গিয়ে অবাস্তব ক্যাচ ধরা সম্ভব। অর্থাৎ ঘুমিয়ে আছে সুপারম্যান সব মানুষের অন্তরে, শুধু ঠেলা মেরে জাগ্রত করতে হবে। যদি ছোঁয়াচে রোগের মতো এ নির্ভীকতা সারা দেশে ছড়ায়, নিমেষে ডবল সেঞ্চুরি। শুধু মোটিভেশনাল বক্তাদের চাকরি যাবে, তাঁরা নয় আইপিএলে ধারাভাষ্য দেবেন!