মঞ্চের পর্দা উঠলে আমরা জানতে পারি, ফাঁসির আসামি এক জন শিক্ষিত ঠান্ডা মাথার সিরিয়াল কিলারের সাক্ষাৎকার নিতে এসেছেন এক জন সাংবাদিক। এবং সেটি সম্প্রচার হবে সোজাসুজি। সেই সম্প্রচার ঘিরে যে দর্শকের আগ্রহ তুঙ্গে, সেটাও আমরা জেনে যাই। সেই সাক্ষাৎকারকে কেন্দ্র করে উঠে আসে এই সময়ের অন্যতম প্রধান প্রশ্ন: সন্ত্রাসী কে? ব্যক্তি? না রাষ্ট্র? মূল বৃক্ষের শাখা-প্রশাখার মতো উঠে এসেছে আরও নানা সামাজিক জরুরি সমস্যার কথা। ‘রঙ্গলোক’-এর সাম্প্রতিক প্রযোজনা ‘হন্তারক’ নাটকে এ ভাবেই উঠে এসেছে সময়, সমাজ, আর আক্রান্ত মানবিকতার কথা। এমন নয় যে, এই রকম প্রযোজনা বাংলা মঞ্চে খুব দুর্লভ। সব দিক বিচার করলে মাঝারি মানেরই প্রযোজনা। কিন্তু দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা নেই এই নাটকে, এটা মানতেই হবে।
একটা সময় ছিল যখন ‘বাঘ যে ভাবে শিকার ধরে’, ঠিক সেই ভাবেই ‘সময়টাকে কামড়ে’ ধরত বাংলা গ্রুপ থিয়েটার। আর যে দোষই তার থাক, দায়িত্ব এড়ানোর দোষ এই সে দিনও তাকে দেওয়া যেত না। বস্তুত আগ বাড়িয়ে দায়িত্ব নেওয়াই ছিল তার ধর্ম, লাভ-লোকসান পরের কথা। থিয়েটার করছি কেন? এই প্রশ্নে নিজের কাছে নিজের জবাবদিহিই ছিল মুখ্য।
সারা দেশে জরুরি অবস্থা চলছে। আমরা মঞ্চে দেখছি ‘আন্তিগোনে’-র নিয়মিত অভিনয়। দেখেছি ‘প্রফেসার মামলক’। নকশাল আন্দোলনের অভিঘাতে ভেঙেচুরে যাচ্ছে সামাজিক ধ্যানধারণা। মঞ্চের ‘চার অধ্যায়’ কেঁচে গণ্ডূষ করতে বাধ্য করছে। পরবর্তী সময়েও ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’-এর মতো নাটকও দেখেছি। উদাহরণ দিতে বসলে থামা মুশকিল। এই সব নাটক ভেতরে ভেতরে বুঝিয়ে দিয়েছে ক্ষমতার স্বরূপ। নিজের সময়কে যে চিনে নিতে হয় ইতিহাসের ধারাবাহিকতায়, শিখিয়েছে তাও।
অথচ ইদানীং বিষয়বস্তু কেমন যেন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। অল্প কিছু হাতে গোনা প্রযোজনা বাদ দিলে, প্রায় সর্বত্রই এই পালিয়ে বেড়ানো। যেন বাইরের দুনিয়ার হাওয়া পাছে ঢুকে পড়ে, তাই দরজা জানালা প্রায় বন্ধ রেখে ‘শিল্পের জন্য শিল্প চর্চা’।
এই প্রেক্ষাপটে আলোচ্য নাটকটি আমাদের ভাবতে বলে। যে সময়ে বাস করছি, সেই সময়টাকে চিনতে বলে। বিশেষত এই নির্বাচনের সময়ে সেটা জরুরি, যখন হাজার রকম সন্ত্রাস মানুষকে ঘিরে ধরছে, দুর্বোধ্য হয়ে যাচ্ছে প্রতিবেশীর আচরণ, চেনা দলের অচেনা চেকনাই আমাদের হতভম্ব করে দিচ্ছে, গুলিয়ে যাচ্ছে কী চাই আর কী চাই না— এই রকম সময়ে কোনটা জরুরি আর কোনটা না হলেই মঙ্গল, তারও তল পাওয়া কঠিন।
প্রতি দিন খবরের কাগজে আর চ্যানেলে চ্যানেলে মৃত্যুর খতিয়ান। নির্বাচন ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই ভেতরে ভেতরে শঙ্কা, কে জানে আরও কত মানুষের মৃত্যু-পরোয়ানা জারি হতে যাচ্ছে। সমস্ত রাজনৈতিক দল যে যার ক্ষমতা অনুযায়ী এই মৃত্যুখেলায় শামিল হয়েছে। কেবল মৃত্যুর খেলাই বা কেন! যত রকম ঘৃণা আর হিংসার কথা, দূষণের কথা আমরা জানি, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ঝুলি থেকে বেরিয়ে আসছে সে সব। বক্তৃতায় বা শরীরী ভাষায় তো বটেই, এমনকি সাক্ষাৎকারের ভাষাও সভ্যতার সীমা পেরিয়ে যাচ্ছে।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
প্রতি দিন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা গৌরবান্বিত করে চলেছেন হিংসার রাজনীতিকে। আত্মরক্ষার জন্য নয়, বিরোধীকে— কেবলমাত্র বিরোধী বলেই— ভয় দেখাও, হত্যা করে এগোনোর পথ মসৃণ করো। যে যুক্তিতে সীমান্ত পার হয়ে অন্য দেশে ঢুকে হত্যা করা শ্লাঘার বিষয় হয়ে ওঠে, সেই একই যুক্তিতে পাশের বাড়ির ছেলেটি প্রতিপক্ষ রাজনীতিতে আছে বলে তাকেও খুন করা যায়। সাধারণ মানুষের টাকায় কেনা নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয়ের মধ্য থেকে নেতারা উত্তেজক ঘৃণা আর হিংসা ছড়াতে ছড়াতে সত্য-মিথ্যার মিশেলে তৈরি করে দিচ্ছেন এক মেকি যুদ্ধের বাতাবরণ। আর কামানের গোলার মতো নিজেদের গণতন্ত্রের সৈনিক মনে করে, আত্মবলিদানে এগিয়ে যাচ্ছেন নামগোত্রহীন জনগণ, বেঁচে থাকাটাই যাঁদের কাছে অঘটন।
এমন নয় যে এই ফাঁকিবাজির ইঁদুর-বেড়াল খেলাটা সাধারণের জ্ঞানবুদ্ধির বাইরে। কিন্তু খেলার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেই বলে নিজেকেই নিজের চোখ ঠারতে হয়। বোঝাতে হয়, না, আগের বারের মতো এ বার অতটা হবে না। এ এক আশ্চর্য প্রতারণার গোলকধাঁধা।
‘হন্তারক’-এ দেখি, হিংসা একেবারে গৃহস্থের অন্দরে পরস্পরের সম্পর্কে ঢুকে পড়েছে। কিশোর মনকে কব্জা করে ফেলছে অবলীলায়। মনে পড়ে যায়, বীরভূমের গ্রামে ফ্রক-পরা এক বালিকা আমায় ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিল ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড তাদের ঘরবাড়ি, তার ছেঁড়া বইখাতা। চোখে তার জল ছিল না, ছিল আগুনঝরানো দৃষ্টি। কথার পিঠে সে জানাল বাঁচার উপায়। প্রতিপক্ষ দল থেকে বলে গিয়েছে, তাদেরও দেওয়া হবে বন্দুক। যা হাতে থাকলে সবাই ঢিট।
রাষ্ট্রক্ষমতা দখল যখন পাখির চোখ, তখন যেন তেন প্রকারেণ সেটা চাই। এই হল নির্বাচন-নির্বাচন খেলার একমাত্র নিয়ম। আর তার ফল? গণতন্ত্র দীনাতিদীন মানুষকে কোনও নিরাপত্তা দেয় না— যে নিরাপত্তা দেয় পিস্তল। এক সময় রাষ্ট্র বন্দুক দিয়ে তাদেরই মোকাবিলা করেছিল, যারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলেছিল। আর আজ? রাষ্ট্রের নামে ক্ষমতা দখল করতে পরস্পরকে বন্দুক হাতে লড়িয়ে দেওয়ার রাজনীতি চলছে, রাষ্ট্রের মদতেই।
এ ভাবেই চলছে এক দেশজোড়া খেলা। সবচেয়ে অসুবিধাজনক তথ্যটা হল, খেলাটা চলছে ‘গণতন্ত্র’-এরই নামে, ‘গণতন্ত্র’কেই বাঁচাতে!