শুশুনিয়া লিপি। ছবি: অভিজিৎ সিংহ
এক সময়ে বাংলার লোকমুখে প্রচলিত ছড়া-সংস্কৃতির মধ্যে সমসাময়িক আঞ্চলিক সমাজ জীবন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাঙাগড়ার ছবি মিলত। বাঁকুড়ার বড়জোড়া থানার প্রত্ন-জনপদ পখন্না নিয়েও প্রচলিত এক ছড়ায় কৃষিপ্রধান অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সুর ধরা পড়ে। সাবেক বর্ধমানের উজানি-মঙ্গলকোট অঞ্চল প্রাপ্ত এই ছড়ায় বলা হয়েছে—‘লবড়ি ছবড়ি গাঙ সিনানে যাই/ গাঙের জলে রাঁধি বাড়ি পখুরের জল খাই/ চার মাস বর্ষা পখন্না যায়/ পখন্নাতে গিয়ে দেখি দুয়ারে মরাই/ ছোট মরাইয়ে পা দিয়ে/ বড় মরাইয়ে পা দিয়ে/ রাই এসো গো ঝলমলিয়ে’।
দামোদরের দক্ষিণ তীরে অবস্থিত পখন্নার আর্থিক সমৃদ্ধি প্রাক-মৌর্য যুগেই ছিল। কারণ, খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতকে এই জনপদের গড়ে ওঠার পিছনে রাজপুতানার পুষ্করণা রাজ্যের দিগ্বিজয়ী চন্দ্রবর্মার ভূমিকা ছিল। তিনি তাঁর বঙ্গবিজয়ের স্মারকরূপে এখানে আর একটি পুষ্করণা নগরী তৈরি করেছিলেন। তার আগে পুষ্করণা বা পখন্নার নাম কী ছিল, জানা যায় না।
বাঁকুড়া তথা সমগ্র বাংলার ইতিহাসের প্রেক্ষিতে চন্দ্রবর্মা ও তাঁর দ্বিতীয় রাজধানী পুষ্করণার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কারণ, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে কলিঙ্গরাজ মহামেঘবান খারবেল মগধের সীমা পর্যন্ত জয় করেন। খারবেলের মৃত্যুর পরের তৎকালীন বাংলার ইতিহাস নীরব। ১৩৩৯ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত বাংলার ইতিহাস নিয়ে লেখা রামপ্রাণ গুপ্ত তাঁর ‘প্রাচীন রাজমালা’ বইয়ে লিখেছেন, ‘খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতকে এই যবনিকা উত্তোলিত হয়। এই সময়ে রাজপুতনার মরুপ্রদেশের পুষ্করণা নগরের অধিপতি চন্দ্রবর্মা সপ্তসিন্ধুর মুখ বহ্লীকপ্রদেশ হইতে বঙ্গদেশ পর্যন্ত সমগ্র আর্যাবর্ত জয় করিয়াছিলেন’।
চন্দ্রবর্মার খোঁজ মেলে শুশুনিয়া পাহাড়ের উত্তর ঢালে পাথরের গায়ে খোদিত এক লিপিমালাতেও। লিপিটি খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতকে খোদিত। সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিসেন রচিত ‘এলাহাবাদ প্রশস্তি’-তে চন্দ্রবর্মার উল্লেখ দেখে ইতিহাসবিদদের একাংশ মনে করেন, সমুদ্রগুপ্ত যে ন’জন রাজাকে পরাস্ত করে তাঁদের রাজ্য অধিকার করেছিলেন, চন্দ্রবর্মা তাঁদের এক জন। চন্দ্রবর্মার রাজত্বকালের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, মধ্যপ্রদেশের মন্দসৌর থেকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত একটি শিলালিপিতে। প্রাচীন মালবদেশের দশপুর-মন্দসৌর লিপিসূত্র অনুসারে, জয়বর্মার পুত্র সিংহবর্মা। সিংহবর্মার দুই পুত্র—বড়, চন্দ্রবর্মা ও ছোট, নরবর্মা। নরবর্মা ৪৬১ বিক্রমাব্দ অর্থাৎ ৪০৪-০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। সুতরাং, চন্দ্রবর্মা তার পূর্ববর্তী।
কিন্তু মন্দসৌর লিপিতে চন্দ্রবর্মার কোনও বংশধরের উল্লেখ পাওয়া যায় না।
দিল্লির মেহরৌলি লিপিতে রাজা চন্দ্রর উল্লেখ মেলে। এই লিপি অনুসারে, রাজা চন্দ্রবর্মা বিষ্ণুপদগিরিতে বিষ্ণুর ধ্বজা স্থাপন করেছিলেন। ভারতে গয়াক্ষেত্রে ও রাজস্থানের পুষ্করে বিষ্ণুপদগিরি আছে। ইতিহাসবিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ‘এই বিষ্ণুপদগিরি পুষ্করে হওয়াই অধিক সম্ভব’।
চন্দ্রবর্মা তাঁর জন্মভূমির প্রতি টানবশত বাঁকুড়ায় অপর পুষ্করণা নগরীর পত্তন বা নামকরণ করেছিলেন। এই লিপি থেকে আরও জানা যায়, চন্দ্রবর্মা পূর্বে বঙ্গদেশ ছাড়া, পশ্চিমে হিন্দুকুশ পর্বতের কাছে বহ্লিকদেশ জয় করেছিলেন। শুশুনিয়া লিপি রাজা চন্দ্রবর্মার বঙ্গবিজয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাথুরে প্রমাণ। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘সমুদ্রগুপ্তের প্রশস্তি ও শুশুনিয়া লিপির চন্দ্রবর্মা এবং দিল্লির স্তম্ভলিপির চন্দ্র যে অভিন্ন, সে নিয়ে কোনও সন্দেহ নাই।’’
শুশুনিয়া লিপির দু’টি অংশ। উপরের অংশে থাকা বৃত্ত বা চক্র থেকে কতগুলি রেখা বেরিয়ে এসেছে। এই রেখাগুলিও একটি বড় বৃত্ত বা চক্র দিয়ে ঘেরা। এই বৃত্তের সমান্তরালে থাকা আর একটি বৃত্ত থেকে চোদ্দোটি অগ্নিশিখা বেরিয়েছে। প্রতি অগ্নিশিখার পরে দু’টি অর্ধবৃত্ত খোদিত। লিপি বিবর্তনের প্রেক্ষিতে বলা যায়, শুশুনিয়ার লিপিটি ভাবলিপি। এমন লিপিতে কোনও বস্তু বা ভাবকে বোঝাতে পুরো ছবি না এঁকে সামান্য কিছু রেখা বা ‘মোটিফ’ ব্যবহার করা হত। পণ্ডিতেরা উক্ত ভাবলিপিকে ‘বিষ্ণুচক্র’ বলেছেন। এই বিষ্ণুচক্রের নীচে ও পাশে তিনটি ছত্রে খোদিত লিপি রয়েছে। এটি শুশুনিয়া লিপির দ্বিতীয় অংশ। সংস্কৃতে উৎকীর্ণ লিপির অক্ষর ব্রাহ্মি। পাঠ—‘পুষ্করণাধিপতে মহারাজ শ্রীসিঙ্ঘবর্মণঃ পুত্রস্য/ মহারাজ শ্রীচন্দ্রবর্মণ কৃতিঃ/ চক্রস্বামিন দাসাগ্রেণাতি সৃষ্টঃ’ (পুষ্করণার অধিপতি মহারাজ শ্রীসিংহবর্মার পুত্র মহারাজ শ্রীচন্দ্রবর্মার কীর্তি। চক্রস্বামী অর্থাৎ বিষ্ণুর অগ্রদাসের দ্বারা সৃষ্ট।) সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে এটি ‘দ্য ওল্ডেস্ট ব্রাহ্মি ইনস্ক্রিপশন ইন বেঙ্গল।’ এই প্রসঙ্গে তাঁর ছাত্র অধ্যাপক সুখময় চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘লিপি ব্রাহ্ম, নামান্তর গুপ্তলিপি। প, ম, হ, র প্রভৃতি কয়েকটি অক্ষর প্রায় আধুনিক বাংলা অক্ষরের মতো’।
শুশুনিয়া লিপির গুরুত্ব আরও দু’টি কারণে। প্রথমত, রাজা চন্দ্রবর্মা স্বয়ং বিষ্ণুভক্ত হওয়ায় প্রজারাও রাজআনুগত্যের কারণে বিষ্ণু উপাসকে পরিণত হন। খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতকের শুরুতে রাঢ়মণ্ডলে এই বিষ্ণুভজনা রাঢ়দেশ তথা সমগ্র বঙ্গে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, বিষ্ণুসেবার জন্য ভূ-দানের সাক্ষ্য দেয় শুশুনিয়া শিলালিপি।
শুশুনিয়ায় চন্দ্রবর্মা খোদিত বিষ্ণুচক্র-র একটু নীচে বাঁ দিকে শঙ্খ আকৃতির মতো আরও একটি লিপি রয়েছে। তন্ত্রশাস্ত্রে দেবদেবীর পুজোয় শঙ্খমুদ্রার ব্যবহার দেখা যায়। কেউ কেউ মনে করেন, ওই লিপি তান্ত্রিক-শঙ্খলিপি। এখনও পাঠোদ্ধার হয়নি। অনুমান, চন্দ্রবর্মার আগে শুশুনিয়া পাহাড়ে বৌদ্ধ শ্রমণেরা থাকতেন। মহাযান বৌদ্ধমতের সঙ্গে তান্ত্রিক যোগ ছিল। তাই শঙ্খমুদ্রার আকারে লিখিত এই লিপিটি বৌদ্ধ শ্রমণদের সাধন-সঙ্কেতও হতে পারে।
লেখক বাঁকুড়ার সংস্কৃতিকর্মী