‘মুক্তবেণীর গঙ্গা যেথায় মুক্তি বিতরে রঙ্গে/
আমরা বাঙালী বাস করি সেই তীর্থে বরদ বঙ্গে।’
(‘আমরা’, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত)
গ ঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর যুক্তবেণী প্রয়াগে, আর মুক্তবেণী বা মুক্তধারা হুগলি জেলার ত্রিবেণীতে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর কবিতায় বাঙালির অতীতগৌরব তুলে ধরেছেন, তার বাসভূমি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ‘বঙ্গ’কে। সে বঙ্গ থেকেই বাঙালির জাতিকুলমান, কিন্তু ভৌগোলিক পরিচয়ে তা আসলে কোথায়? কবিতার প্রতীকী অবয়বে বঙ্গের যে পরিচয়, সে তো ঔপনিবেশিক ‘বেঙ্গল’। ষোড়শ শতকে আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরি-র ‘সুবা বাংলা’য় প্রথম এই নামে চিহ্নিত অঞ্চলকে প্রশাসনিক ভাবে সমন্বয়ের উদ্যোগ দেখা গেল। তারই ধারাবাহিকতায় এল ঔপনিবেশিক পর্বের ‘বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি’ থেকে ১৯০৫-এ কার্জনের বঙ্গভঙ্গ-প্রসূত ‘বেঙ্গল’ (যার মধ্যে ছিল বিহার ও ওড়িশাও) আর ‘ইস্টার্ন বেঙ্গল অ্যান্ড আসাম’ প্রদেশ, শেষে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পরে ‘বেঙ্গল’। ১৯১১ থেকে শতবর্ষ জুড়ে ভাঙচুর আর নামবদলের ইতিবৃত্ত সু পরিচিত। এত দিনে আবার আমরা ফিরে আসছি ‘বেঙ্গল’-এ, তবে এ বার নেহাতই এক খণ্ডিত ভূখণ্ডে।
আইন-ই-আকবরি-তে যে নামে পুরো সুবাকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হল, সমসময়ে তার গুরুত্ব বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু সুলতানি আমলে তো ‘গৌড়’ অনেক বেশি পরিচিত ছিল। সুলতান ‘গৌড়েশ্বর’, তাঁর রাজধানী গৌড় (বড়জোর নিকটবর্তী পাণ্ডুয়া)। সমসাময়িক ইতিবৃত্ত, পর্যটকদের বিবরণ, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য সবেতেই গৌড়ের ছড়াছড়ি। আসলে বঙ্গ বা বাংলাকে পেতে হলে আমাদের আরও অনেকটা পিছিয়ে যেতে হবে।
ঐতরেয় ব্রাহ্মণ-এ সম্ভবত ‘বঙ্গ’-এর প্রথম উল্লেখ পাই ‘বগধ’-এর (মগধ?) প্রতিবেশী রূপে। ভৌগোলিক অঞ্চল নয়, জাতি হিসাবে। বৌধায়ন ধর্মসূত্র-এ বঙ্গ জনপদের অবস্থান কলিঙ্গের পাশে বলেই অনুমান করা হয়েছে। অশোকের লিপিতে বঙ্গ স্থান পায়নি, তবে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র-এ বঙ্গের সূতিবস্ত্রের কথা আছে। এতে বঙ্গের অবস্থান বোঝা না গেলেও মহানিদ্দেশ (খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতক বা তারও আগে) এবং মিলিন্দপঞ্হ (খ্রিস্টীয় প্রথম বা দ্বিতীয় শতক) থেকে এটুকু বোঝা যায় বঙ্গের একাংশ অন্তত সমুদ্রতীরবর্তী ছিল, বঙ্গের এলাকার মধ্যে ছিল কোনও বন্দরও। সম্ভবত এই কথার প্রমাণ রয়েছে জৈন উপাঙ্গগ্রন্থ প্রজ্ঞাপনা-য় (খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় থেকে খ্রিস্টীয় প্রথম শতক)— যেখানে বলা হয়েছে যে তাম্রলিপ্ত বঙ্গের অন্তর্গত। মহাভারতের বিভিন্ন উল্লেখ থেকে নীহাররঞ্জন রায় অনুমান করেছিলেন, বঙ্গদেশটি পুণ্ড্র (উত্তরবঙ্গ), তাম্রলিপ্ত ও সুহ্মের (রাঢ়) সংলগ্ন দেশ, তবে প্রত্যেকটিই স্ব-স্বতন্ত্র।
এ ব্যাপারে খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের এক চিনা নথির কথা বলেছিলেন প্রাচীন ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী এলাকা সহ একটি অঞ্চলকে ওয়েই লুয়ে নথিতে যে নামে উল্লেখ করা হয়েছে, তার উৎস ‘বঙ্গ’ বলেই মনে করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ব্রতীনবাবু আরও বলেছেন, নথিটিতে এই অঞ্চলকে ‘গঙ্গারাষ্ট্র’ও বলা হয়েছে। অর্থাৎ ওই চৈনিক সূত্রের কাছে বঙ্গ ও গঙ্গা প্রায় অভিন্ন ছিল। এ অনুমান ঠিক হলে অন্তত গাঙ্গেয় অববাহিকার দক্ষিণাংশে ‘বঙ্গ’কে ধরাই যায়। ব্রাহ্মণ্য, বৌদ্ধ, জৈন সূত্রে যা যা উল্লেখ পাওয়া যায়, তার সঙ্গে এর মোটামুটি সামঞ্জস্যও থাকছে। এরই পাশাপাশি যদি পেরিপ্লাস গ্রন্থের ‘গঙ্গা’রাষ্ট্র এবং বিভিন্ন গ্রিক ও ল্যাটিন বিবরণে যে ‘গঙ্গারিদাই’ বা ‘গঙ্গে’ বন্দরের কথা আছে তাকে এর সঙ্গে মেলানো যায় তা হলে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম-দ্বিতীয় শতক থেকে আজকের দক্ষিণবঙ্গ-কেন্দ্রিক ‘বঙ্গ’-এর সমৃদ্ধি ও গুরুত্ব নিয়ে দ্বিমতের বিশেষ অবকাশ নেই। শুধু আজকের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা নয়, তার পুবে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের অনেকটাই যে এর অন্তর্গত ছিল, তাও এই সব পরোক্ষ প্রমাণ থেকে বোঝা যায়। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে প্লিনির বিবরণ ও দ্বিতীয় শতকে টলেমির মানচিত্রও এক বিস্তীর্ণ এলাকার দিকেই নির্দেশ করে।
আনুমানিক খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে লেখা কালিদাসের রঘুবংশ-এ বঙ্গের প্রসঙ্গ আছে। দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে ‘নৌসাধনোদ্যত’ বঙ্গজনকে পরাজিত করে রঘু ‘গঙ্গাস্রোতোহন্তরে’ জয়স্তম্ভ স্থাপন করেন। ‘গঙ্গাস্রোতোহন্তরে’ বলতে গঙ্গাস্রোতের মধ্যে বা গঙ্গাস্রোত পার হয়ে, যে ব্যাখ্যাই আমরা গ্রহণ করি না কেন, বঙ্গজনের বাসভূমির অবস্থান তাতে বিশেষ বদলায় না।
মোটামুটি ভাবে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত সময়ে বঙ্গের যে গুরুত্বের কথা সমসাময়িক বা কিছুটা পরবর্তী বিবরণ থেকে পাওয়া গেল, তাতে বোঝা যায়, উত্তরবঙ্গে পুণ্ড্রবর্ধনের পুণ্ড্রদের পাশাপাশি সেই পর্বে বঙ্গও ছিল সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। গুপ্তযুগে (পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতক) উত্তরবঙ্গ থেকে পাওয়া একাধিক তাম্রশাসনে পুণ্ড্রবর্ধনকে ‘ভুক্তি’ বা প্রদেশ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। খ্রিস্টীয় নবম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে এই প্রদেশ ভিন্ন ভিন্ন নামে ক্রমাগত আধুনিক কলকাতার উপকণ্ঠ পর্যন্ত গাঙ্গেয় অববাহিকার সমগ্র পূর্বাংশকে নিজের ভৌগোলিক পরিসীমার মধ্যে নিয়ে আসে। কিন্ত ভৌগোলিক পরিসরের বড়রকম হেরফের হলেও কোনও বিশেষ রাজ্যের ক্ষমতাকেন্দ্রের সঙ্গে কিন্তু তাকে মেলানো যাচ্ছে না, বিভিন্ন সময় তা বিভিন্ন রাজ্যের অধীন। কোনও বিশেষ কৃষ্টির জন্মও তাকে কেন্দ্র করে হয়নি, যা পরে ‘গৌড়’কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল।
কুষাণ ও গুপ্ত পর্বে বঙ্গ নিয়ে তেমন কিছু জানা না গেলেও ষষ্ঠ শতকে বর্তমান বাংলাদেশের কোটালিপাড়া-ফরিদপুরকে কেন্দ্র করে দ্বাদশাদিত্য-ধর্মাদিত্য-গোপচন্দ্র-সমাচারদেবের মতো স্থানীয় রাজাদের যে শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, তা ছিল বঙ্গেরই অন্তর্গত। গোপচন্দ্রের শাসন ভাগীরথীর পশ্চিমতীরেও বিস্তৃত হয়েছিল বলে তাম্রশাসনে বলা হয়েছে। এই রাজাদের তাম্রশাসনে ‘বঙ্গ’ শব্দটির উল্লেখ না থাকলেও পরোক্ষ প্রমাণ আছে। এতে ব্যবহৃত ‘নব্যাবকাশিকা’ বা ‘নাব্যবকাশিকা’ শব্দটি পরে ফিরে ফিরে এসেছে পূর্ববঙ্গের চন্দ্র ও সেন রাজাদের তাম্রশাসনে, ‘নাব্য’ বা ‘নাব্য-মণ্ডল’ রূপে। এই সবই নৌ-চলাচলের উপযুক্ত অঞ্চলকে বোঝাচ্ছে, আর নদ-নদী-খাল-বিল পরিবেষ্টিত দক্ষিণবঙ্গের পক্ষে তা অবশ্যই প্রযোজ্য।
‘বঙ্গ’ অঞ্চলে চন্দ্র-বর্মণ-সেন রাজত্বের যে ছবি নানা সূত্রে উঠে আসে তা সপ্তম শতক থেকে গৌড়ের উত্থান ও সমৃদ্ধির পাশাপাশি এক স্বতন্ত্র ক্ষমতাকেন্দ্রের অস্তিত্ব প্রমাণ করে। গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক থেকে পাল রাজারা দাপটে রাজত্ব করার সময়েও বঙ্গ তার অস্তিত্ব অটুট রেখেছিল। এতটাই, যে ত্রয়োদশ শতকে যখন সেন রাজাদের শক্তিকেন্দ্র সরাতে হল, তখন তা আরও কিছুদিন টিকল সেই বঙ্গ অঞ্চলেই। সমকালীন নানা বিবরণে গৌড়েশ্বর ও বঙ্গেশ্বর বা বঙ্গপতি দুটি অভিধারই ব্যবহার দেখা যায়। চন্দ্ররাজ শ্রীচন্দ্রের পশ্চিমভাগ তাম্রশাসনে বিদেশীয় মঠ বোঝাতে ‘দেশান্তরীয়’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, যেখানে দেশীয় মঠ বোঝাতে লেখা হয়েছে ‘বঙ্গাল’ শব্দটি। অর্থাৎ ‘দেশ’ মানে ‘বঙ্গ’। বঙ্গ ও বঙ্গাল দুটি শব্দেরই ব্যবহার এই সময় থেকেই নজরে পড়ে। গৌড় ও বঙ্গ দুটি পৃথক ভৌগোলিক পরিসর আস্তে আস্তে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও ধারক ও বাহক হয়ে ওঠে। মধ্যযুগে গৌড়ীয় আখ্যা বাঙালির সমার্থক হয়ে উঠেছিল। সুলতানি পর্বের শেষে বাংলা মুঘল অধিকারে আসার পর সুলতানি ঐতিহ্যের মতো গৌড়ও বিস্মৃতির অন্তরালে বিলীন হয়, ফিরে আসে বাংলা, সুবা বাংলায়।
খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের বঙ্গ থেকে ষোড়শ শতকের সুবা বাংলায় ফিরে আসার ইতিহাসে আরও একটু পিছিয়ে যাওয়া সম্ভব, এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক রজত সান্যাল। শুধু পিছিয়ে যাওয়া নয়, বঙ্গের গুরুত্ব আরও একটু প্রতিষ্ঠা করাও বটে। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়ে একটি শিলালেখ আবিষ্কৃত হয়। বর্তমানে ভারতীয় সংগ্রহশালায় রক্ষিত খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের এই লিপিটির হরফ ব্রাহ্মী, ভাষা মাগধী প্রাকৃত। খণ্ডিত লিপিটিতে পুণ্ড্রনগরে ‘সংবঙ্গীয়’ জনগোষ্ঠীর উল্লেখ আছে বলেই মনে করেন দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর প্রমুখ লিপিবিদ। ভাণ্ডারকর লিখেছিলেন, এই ‘সংবঙ্গীয়’ কি উত্তর ভারতের ‘সংবৃজ্জি’র মতো বঙ্গীয় গোষ্ঠীগুলির কোনও যুক্তগোষ্ঠী, যারা একজোট হয়ে পুণ্ড্রবর্ধনের অন্যতম প্রধান জনগোষ্ঠীর মর্যাদা পেয়েছিল? রজতবাবুর মতে, তাই যদি হয় তা হলে বঙ্গভূমিতে তেইশশো বছর আগে বঙ্গীয় জনগোষ্ঠীর গুরুত্বের কি এটাই প্রথম পাথুরে প্রমাণ? তা হলে তো পুণ্ড্র, গৌড় পেরিয়ে আমরা সেই বঙ্গেই ফিরলাম!
মানচিত্র: রজত সান্যাল