মুম্বই থেকে নাশিক। নাশিক জেলার উত্তরে গুজরাত সীমান্তের কাছাকাছি সুরগণা তহশিল। আশি কিলোমিটার পথ। বন্ধুরা বলেছিলেন, সুরাত হয়ে যেতে; সময় কম লাগবে, পথও কম। কিন্তু আমি তো খুঁজতে এসেছি সেই পথ, সুরগণার আদিবাসী কৃষকরা, মেয়ে-পুরুষ মিলে পায়ে হেঁটে যে পথে সূচনা করেছিলেন এ বছর মার্চের কৃষক লং মার্চের। সুরগণা থেকে নাশিক, নাশিক থেকে মুম্বইয়ের আজ়াদ ময়দান, আড়াইশো কিলোমিটারের বেশি পথ পায়ে হেঁটে গিয়েছিলেন আদিবাসী কৃষকরা। নাশিক থেকে মুম্বই একশো আশি কিলোমিটার হেঁটেছিলেন চল্লিশ হাজারেরও বেশি কৃষক, তাঁদের অধিকাংশের পায়ে জুতো ছিল না। শেষ দশ-বারো কিলোমিটার হাঁটতে হয়েছিল গভীর রাতে, নিঃশব্দে— মুম্বই মহানগরীর স্বাভাবিক জীবনছন্দে যেন কোনও ছেদ না পড়ে।
নাশিক থেকে দিন্দোরী— সেচের জলে পুষ্ট, সম্পন্ন কৃষকের খেতখামার। এখানকার সব্জি, বিশেষত পেঁয়া়জ, টম্যাটো যায় সারা দেশে, বিদেশেও। যতই উত্তরে চলি, দু’পাশে সহ্যাদ্রি পর্বতমালার জ্যামিতিক পাথুরে রুক্ষতা ঘিরে ধরতে থাকে। উচ্চাবচ ভূমি, কোথাও সমতল মাটি দূরে পাহাড়ের ঢালে মিশেছে। পথে শুষ্ক নদীখাত, আর্দ্রতাবিহীন মাটিতে বর্ষানির্ভর চাষ। পশুখাদ্যের টানাটানি, ঘাসের জন্য গরু চরে পাহাড়ের ঢালে। পথের ধারে বড় পাথরে, কালভার্টের গায়ে লাল রং দিয়ে আঁকা কাস্তে-হাতুড়ি চিহ্ন, লেখা: চলো মুম্বই! শীতের পর চাঁদের পিঠের চেহারা নেয় এ অঞ্চল, পিঙ্গল হলুদ রঙের বৃষ্টিহীন ভূমি-পর্বত পরবর্তী মৌসুমি বায়ুর অপেক্ষায় থাকে। সহ্যাদ্রি পর্বতমালার কোলে সুরগণা তহশিলের দু’লক্ষের কাছাকাছি মানুষের ৯৬.৫ শতাংশ আদিবাসী। ২৬০০০ হেক্টর জমি এখানে ‘জঙ্গল’-এর মধ্যে পড়ে। জঙ্গল অধিকার আইন পাশ হয়েছে ২০০৬ সালে। এক দশকের বেশি সময় পরেও, মহারাষ্ট্র সরকার আদিবাসীদের চাষ করা জমির ব্যক্তিগত পাট্টার দাবির মাত্র এক-তৃতীয়াংশ মঞ্জুর করেছে। বাকি কৃষকরা বহু দশক ধরে জঙ্গলে জমি চাষ করছেন, অথচ তাঁদের কোনও অধিকার নেই। তাঁদের অতিক্রমণকারী হিসেবে চিহ্নিত করে জঙ্গল বিভাগ ফাইন করে, উৎখাত করে, ফসল নষ্ট করে দেয়। জমিতে সেচের কোনও ব্যবস্থাও তাঁরা করতে পারেন না। পাট্টা নেই বলে কৃষিঋণও পান না।
বহু দিন ধরে আদিবাসী কৃষক ও খেতমজুরদের সংগঠিত করছে সর্বভারতীয় কিসান সভা। বৃষ্টি-নির্ভর, অনিশ্চিত কৃষির ভরসায় দিন কাটানো সুরগণায় পঞ্চাশ শতাংশ পরিবার জল নেন খোলা কূপ থেকে, গরমে সেই কূপের জলও শুকিয়ে যায়। জঙ্গলের কাঠে রান্না করেন ৯৪ শতাংশ পরিবার। স্বাস্থ্য উপকেন্দ্রে এক জন মাত্র ডাক্তারকে দেখাতে রাস্তা পর্যন্ত লাইন পড়ে। স্কুলগুলির অবস্থা শোচনীয়, ছাত্রছাত্রীরা মাটিতে বসে পড়াশোনা করে। এই সব হতদরিদ্র মানুষের পদযাত্রায় শুরু হয়েছিল গত মার্চের নাশিক-মুম্বই কিসান লং মার্চ— আজ দিল্লির রামলীলা ময়দানে সারা দেশ থেকে যে কৃষকরা এসেছেন, তাঁদের অনুপ্রেরণাও মার্চের ওই বিশাল পদযাত্রা থেকে।
হাজার হাজার কৃষক আমাদের নাগরিক জীবনযাপনের খুব কাছে এসে পড়লে, প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া হয় মিশ্র। মুম্বই শহর এমন ভাবে অভিনন্দন জানিয়েছিল কৃষকদের, যে প্রশাসনও সতর্ক হয়ে ওঠে। কিছু দিন আগে উত্তরপ্রদেশ-দিল্লি সীমান্তে কিসান ক্রান্তিযাত্রার কৃষকদের ওপর লাঠি, কাঁদানে গ্যাস ও জলকামান ব্যবহার করেছিল প্রশাসন। দিল্লির সমাবেশ সে তুলনায় অনিরুদ্ধ, শহরবাসীদের উত্তাপও ঘিরে ছিল কৃষকদের।
আসলে, কৃষকদের তো আমরা, মধ্যবিত্ত শহুরে মানুষ চোখে দেখতে পাই না, দেখি সব্জি ও শস্যের পাইকারি বাজারকে! ক্রয়মূল্যের কতখানি তাঁদের কাছে পৌঁছয়, সে বিষয়েও আমাদের ধারণা অস্বচ্ছ।
দুর্নিবার গ্রীষ্মে মরাঠাওয়াড়া থেকে ফেরার পথে আহমেদনগরের এক কৃষক বলেছিলেন, ৩৫০০০ ফুট উঁচুতে প্লেনে বসে আপনারা যখন তাজা ফলের ঠান্ডা রস খোঁজেন, আমাদের কথা মনে পড়ে কি? টানা খরার বছরের এই সব আঙুর চাষি বাড়ির গহনা বন্ধক রেখে বরফের চাঁই এনে আঙুর মাচার তলায় রেখেছিলেন, উত্তাপ ও শুষ্কতা থেকে লতাগুলিকে বাঁচাতে। আমাদের না জানলেও চলে।
সুরগণা তহশিলে গিয়ে জেনেছিলাম, আদিবাসী কৃষকের জমির অধিকার, আদিবাসী শিশুর পুষ্টির অধিকার নিয়েই পরিকল্পনা হয়েছিল মার্চ মাসের লং মার্চের। কিন্তু স্বভাবতই বিরোধী দলগুলির নৈতিক সমর্থন পেতে, কৃষিঋণ মকুব, ন্যূনতম ক্রয়মূল্য এবং অবশ্যই জাতীয় কৃষি কমিশনের (ড. স্বামীনাথনের অধ্যক্ষতায়) প্রস্তাব কার্যকর করার দাবিও এতে সংযুক্ত হয়েছিল। দিল্লি সমাবেশেও তা-ই।
কেবল মহারাষ্ট্রে নয়, সারা দেশে কৃষি উৎপাদন চলেছে ঘোর অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে। গত পাঁচ-ছ’মাস দেশের নানা গ্রামেগঞ্জে ঘুরে দেখেছি জলহীনতার কী ভয়াবহ চেহারা! মানুষের পানের, স্নানের জল নেই, তৃষ্ণার্ত পশু মাটিতে পড়া জল চেটে খাচ্ছে। বৃষ্টির গড় পরিমাণ বদলায়নি, বদলেছে বর্ষার ছন্দ। কোথাও বর্ষা দেরিতে, কোথাও ফিরতি বর্ষা উধাও, কোথাও একটানা মেঘহীন দিন। অথচ ভূমিতল থেকে জল টেনে নেওয়া হচ্ছে নির্বিচারে; বৃষ্টি-নির্ভর কৃষিতে আগে যেখানে হত ধান, জোয়ার, বাজরা, ভুঁইমুগের মতো শস্য, যা মৃত্তিকার আর্দ্রতা টেনে নিয়ে জন্মায়, এখন সেখানে হচ্ছে আখ, তুলো, সয়াবিন। বড় চাষিদের নিজস্ব রাজনৈতিক ক্ষমতা আছে, তাই চাষের প্রকৃতিতে হস্তক্ষেপ করতে অপারগ সরকার। আখের দামে হাজার হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি, তাই আখ চাষ বাঁধা উপার্জন নিশ্চিত করে। অথচ আখ শুষে নেয় প্রয়োজনের বেশি ভূগর্ভস্থ জল।
গত পাঁচ দশকে খরা ও অনাবৃষ্টির প্রকোপ বেড়েছে। ১৯৬০-এর দশকে পাঁচটি রাজ্যের ৬৬টি জেলায় খরা ঘোষিত হয়েছিল, এখন তা ছড়িয়েছে ২৩টি রাজ্যের ৪০০’র বেশি জেলায়। কিছু দিন আগে মহারাষ্ট্র সরকার ১৫১টি তহশিলে খরা ঘোষণা করেছে। মরাঠাওয়াড়ায় জলভাণ্ডারগুলিতে ৩৫ শতাংশ জল। গ্রামের মানুষের উদ্বেগ— আগামী বর্ষা পর্যন্ত আট মাস কী ভাবে চলবে। ভূগর্ভস্থ জল সংরক্ষণ করে, ছোট চেক বাঁধ তৈরি করে, মৃত্তিকা সংরক্ষণের কাজ করে জলহীনতার মোকাবিলার চেষ্টা হচ্ছে। সরকারি ও স্বেচ্ছাসেবীদের উদ্যোগেও। কিন্তু তা সিন্ধুতে বিন্দু। ‘রিলিফ’-এর রাজনীতি ফুলে ফেঁপে উঠছে। পানীয় জলের ট্যাঙ্কার সরবরাহ— এক বড় ব্যবসা। সেচ প্রকল্পের নামে টাকা মঞ্জুর করিয়ে অর্ধসমাপ্ত ফেলে রাখা, বা বিলম্বের অজুহাতে আরও টাকা মঞ্জুর করানো— এ কাজে জড়িত বড় বড় ঠিকাদাররা। শাসক বা বিরোধী, সব দলের নেতাদের সঙ্গে তাদের গাঁটছড়া নিশ্চিন্তে বাঁধা।
জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৯৫ থেকে ২০১৫-র মধ্যে, তিন লক্ষ কৃষকের আত্মহত্যার খবর পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে ৬৫০০০ আত্মহত্যা ঘটেছে অন্যতম সম্পন্ন রাজ্য মহারাষ্ট্রে, বিদর্ভের তুলো অঞ্চল আত্মহত্যার হারে দেশের এক নম্বরে। ২০১৫’তে মহারাষ্ট্রে নতুন সরকার নির্বাচিত হলে ‘সংজ্ঞা’ এমন ভাবে বদলানো হয়, যে আপনিই আত্মহত্যার সংখ্যা কমে আসে।
কৃষক কেন আত্মহত্যা করেন? কৃষকরা মানসিক ভাবে খেতমজুর বা কারখানার শ্রমিকের চেয়ে দুর্বল, এ কথা বলতে পারলেই প্রশাসন খুশি হয়। কৃষক কিন্তু আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত এক দিনে নেন না। সেচের অভাব, প্রতিকূল বৃষ্টিচক্র, ক্রমবর্ধমান খরচ ও ঋণের বোঝা— এই সবের সঙ্গে লড়তে লড়তে তিনি এক দিন বোঝেন, নিজেকে ও যাবতীয় সম্পত্তি বিক্রি করলেও তাঁর ঋণ শোধ হবে না।
ঋণ মকুবের বড় ঘোষণাতে চাষির সমস্যার সমাধান হবে না। তাঁর প্রয়োজন সংবেদনশীল ব্যাঙ্ক, যে কৃষির অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকির মূল্যায়ন করে তাঁকে ঋণ দেবে। সরকারি ব্যাঙ্কগুলি, যারা হাজার হাজার কোটি টাকার অনাদায়ী ঋণের বোঝা জমা হতে দেখে নিরপেক্ষ উদাসীনতায়, তারা কৃষির অনিশ্চয়তা বুঝতে যথেষ্ট মনোযোগী নয়। ঋণ মকুব একটি রাজনৈতিক অস্ত্র, তা কৃষকের ক্ষমতায়নে কোনও ভাবে সাহায্য করে না। চাষির প্রয়োজন অসংগঠিত মহাজনী ব্যবস্থার সুদচক্রের থেকে মুক্তি।
এ বছর ২৩টি ফসলের ন্যূনতম দাম বাড়িয়েছে সরকার। অথচ মাত্র ৬ শতাংশ চাষিই ওই দামের সুযোগ নিতে সক্ষম। ২৩টির দাম বাঁধা হলেও ধান এবং গমের মতো দু’তিনটির বেশি শস্য সরকার কার্যত ক্রয় করে না। তা হলে কৃষক সমাবেশের দাবিগুলি কার্যকর কী করে হবে?
বিশিষ্ট সমাজকর্মী, সাংবাদিক পি সাইনাথ এই সমাবেশ ও পদযাত্রার মধ্যে দেখছেন হতাশা থেকে বেরিয়ে এসে কৃষকদের লড়াইয়ে শামিল হওয়ার উচ্ছ্বাস। প্রশাসনিক ঔদাসীন্যের নাড়ি কিছুটা চিনি বলে তাঁর সঙ্গে আমি পুরোটা একমত হতে পারি না। আমি দেখি, ‘শান্তিময় শূন্য পরিণাম’। মার্চের ঐতিহাসিক লং মার্চের পর মহারাষ্ট্র সরকার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার দলিল-দস্তাবেজের কাজ এখনও আরম্ভই হয়নি। মার্চের আগেও কৃষকরা অসংখ্য শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা, রাস্তা রোকো, ডিভিশন অফিস ঘেরাও করেছেন। তাঁদের ক্ষতবিক্ষত, খালি পায়ের ছবি বুকে নিয়ে ভোরের কাগজ বেরিয়েছে। মহানগর নতমস্তক হয়েছে অভিবাদনে। আমার প্রশ্ন অন্য: বণিকসভাগুলির সমর্থনে শিল্প ও ব্যবসায়ী সংস্থাগুলি পাঁচতারা হোটেলে সরকারি অফিসার ও মন্ত্রীদের ডেকে নেয়, সেখানেই তাদের দাবিদাওয়া পূরণের প্রতিশ্রুতি আদায় করে। অতিবৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীকে তো কিছুই করতে হয় না, তাদের মাথায় স্বতঃপ্রণোদিত ঝরে পড়ে কৃপার বৃষ্টি। তবে, সেচহীন জমির দরিদ্র কৃষক কেন পথ হাঁটবেন— দীর্ঘ দীর্ঘ পথ? কত পথ হাঁটলে তাঁদের দাবি পূরণ হবে? তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট ফসল বিমা থেকে প্রিমিয়ামের অগাধ মুনাফা যাঁরা করেছেন, সেই কর্পোরেটদের তো এক পা-ও হাঁটতে হয়নি!