Coronavirus

করোনা-যুদ্ধের পদাতিকরা

কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক অধ্যাদেশ দেখে এই স্বাস্থ্যকর্মীরা কি কিছুটা স্বস্তি পেলেন?

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২০ ০০:৩০
Share:

দক্ষিণ ২৪ পরগনার রায়দিঘি এলাকায় ভিড় দেখে সকলকে সরে যেতে বলেছিলেন এক আশাকর্মী। কথা না শুনে উল্টে তাঁকে মারধর করে স্থানীয় কিছু লোক। পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরায় এক আশাকর্মী সারা দিন কোভিড-১৯ নজরদারির কাজ সেরে বাড়িতে ঢুকতে পারেননি। তিনি ঘরে রোগ বয়ে আনছেন, এই অভিযোগে তাঁর জায়েরা তাঁকে নিগ্রহ করেন। ব্লক স্বাস্থ্যকর্তা গিয়ে ওই কর্মীকে উদ্ধার করেন। উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জে এক আশাকর্মীকে পাড়ার লোক বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি। এগরার এক পুর স্বাস্থ্যকর্মীকে এলাকার লোক একঘরে করেছিল।

Advertisement

কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক অধ্যাদেশ দেখে এই স্বাস্থ্যকর্মীরা কি কিছুটা স্বস্তি পেলেন? চিকিৎসক থেকে স্বাস্থ্যকর্মী, যে কাউকে কোভিড-১৯ নিবারণের কাজের জন্য হেনস্থা করলে কড়া শাস্তি দেওয়া হবে, বলছে এই আইন। জেলের মেয়াদ হতে পারে সাত বছর পর্যন্ত। এতে লোকে যদি সংযত হয়, ভাল। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, স্বাস্থ্যকর্মীর উপরে হামলা, মহিলাদের হেনস্থা, আইনের চোখে এগুলো তো বরাবরই অপরাধ। সরকারি কাজে বাধাদানও দণ্ডনীয়। তা হলে মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীদের নিগ্রহ হয়ে চলেছে কী করে? পুলিশ-প্রশাসন, কিংবা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের সুরক্ষায় কতটা সক্রিয়?

রাজ্যে গ্রামস্তরে প্রায় ৫২ হাজার আশাকর্মী, এবং ১২৭টি পুরসভা ও পুরনিগমে প্রায় আট হাজার পুর-স্বাস্থ্যকর্মী এখন করোনা মোকাবিলার কাজে নিযুক্ত। এঁরা সকলেই গ্রামাঞ্চল বা মফস্সলের অভাবের সংসারের মেয়ে-বউ। অনেকেই তাঁর পরিবারের একমাত্র রোজগেরে, অনেকে বিবাহবিচ্ছিন্না, বা বিধবা। একা মানুষ করছেন সন্তানদের।

Advertisement

এই মেয়েরা এখন যেন শাঁখের করাতের মধ্যে পড়েছেন। এক দিকে কাজের প্রবল চাপ। পিপিই দূরে থাক, মুখোশ-গ্লাভসও অধিকাংশের কাছে পৌঁছয়নি, স্যানিটাইজ়ারও নেই। সেই অবস্থায় বাড়ি-বাড়ি গিয়ে লুকিয়ে-থাকা আক্রান্ত খুঁজতে হচ্ছে। পরিবারের কে বাইরে আছে, তার তালিকা তৈরি, অতি স্পর্শকাতর এলাকায় ঢুকে রেশন, খাবার বিলি, সবই করতে হচ্ছে। এমনকি কিছু কোয়রান্টিন কেন্দ্রে স্বাস্থ্যকর্মীদের দিয়ে জ্বরও মাপানো হচ্ছে!

পশ্চিমবঙ্গ আশা কর্মী ইউনিয়নের সম্পাদিকা ইসমতারা খাতুন জানাচ্ছিলেন, হয়তো কোনও বাড়িতে কেউ জ্বর গোপন করে আছেন বা ভিন রাজ্য থেকে জ্বর নিয়ে এসে কাউকে জানাননি— আশাকর্মী সেই বাড়িতে গিয়ে তাঁকে চিহ্নিত করেছেন এবং হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছেন। সেই জন্য তাঁকে কথা শুনতে হচ্ছে। উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার, এমনকি খুনের হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। আশাকর্মী তাঁর নিজের পাশে কাউকে পাচ্ছেন না।

জীবন বিপন্ন করে এই কাজের জন্য তাঁদের ভাতা বাড়েনি, বরং কমেছে। কারণ মা ও শিশুর স্বাস্থ্যপরীক্ষা, টিকাকরণ, ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়া-কুষ্ঠের মতো বিভিন্ন কর্মসূচিতে কাজ করে আশা ও স্বাস্থ্যকর্মীরা যে অতিরিক্ত কাজ-প্রতি টাকা পেতেন, সে সব কাজ করোনার জন্য প্রায় বন্ধ। ফলে মাসিক রোজগার প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। সম্প্রতি কেন্দ্রের জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের অধিকর্তা রাজ্যগুলিকে একটি চিঠিতে রাজ্যগুলোকে বলেছেন, প্রচলিত কর্মসূচির জন্য রাজ্য সরকারেরা যেন আশাকর্মীদের দু’হাজার টাকা করে উৎসাহভাতা দেন। সেই সঙ্গে কোভিডের কাজ করানোর জন্য তাঁদের প্রতি মাসে অতিরিক্ত এক হাজার টাকা দেওয়া যেতে পারে। এ রাজ্য দেবে কি? এখনও অবধি আশ্বাস মেলেনি।

চিকিৎসকদের এক সপ্তাহ ডিউটির পর সাত দিন বিশ্রাম দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু এই মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরন্তর কাজের মাঝে বিশ্রামের কথা কেউ ভাবেননি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষিত করোনা-বিমায় আশাকর্মীদের নাম রয়েছে, কিন্তু পুর-স্বাস্থ্যকর্মীদের ভাগ্যে সেটুকুও জোটেনি।

খাতায় কলমে এই মেয়েরা স্বেচ্ছাকর্মী। তাই প্রতিবাদ করতে সাহস পান না— যদি কাজ চলে যায়? অধিকাংশ আশাকর্মীর কাছে মাসে ৩৫০০ টাকা আর পুর স্বাস্থ্যকর্মীদের মাসিক ৩১২৫ টাকার বেতনটুকুই বেঁচে থাকার সম্বল। এই অসহায়তার জন্য তাঁদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া সহজে উপেক্ষিত হয়। তার উপর সংক্রামক এক মারণব্যাধির মোকাবিলায় নামার জন্য পাড়ার লোক একঘরে করছেন, কলতলায় জল নেওয়া বা পুকুরে স্নান বন্ধ করে দিচ্ছেন। নিজের বাড়িতেও আত্মীয়েরা কাজ ছেড়ে দিতে চাপ দিচ্ছেন, হাঁড়ি আলাদা করে দিচ্ছেন, বা কথা বলা বন্ধ করছেন।

ভুলে গেলে চলবে না, আশাকর্মী ও পুর স্বাস্থ্যকর্মীরা চিকিৎসা পরিষেবার অন্যতম ‘ফ্রন্টলাইনার।’ তাঁরা ছাড়া রাজ্যের বিস্তীর্ণ জেলা ও পুরসভা এলাকায় কোভিড-১৯ প্রতিরোধের কাজ স্তব্ধ হয়ে যাবে। তাই এঁদের নিগ্রহ বন্ধ তো করতেই হবে। তার সঙ্গে দরকার এই কর্মীদের সার্বিক আর্থ-সামাজিক সুরক্ষা। এই মেয়েদের সুরক্ষিত না করলে কিন্তু মহামারির থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement