করোনা এমনই সংক্রামক জীবাণু যা জীবিত, মৃতপ্রায় ও মৃত— সবার থেকেই কেড়ে নিয়েছে মানবিকতার মূল অভিপ্রকাশ— স্নেহের স্পর্শ। সমাজে থেকেও আমরা সবাই একা; মানুষ এখন মানুষের থেকে অনেকটাই দূরে। বা মানুষের পাশে দাঁড়াবার একমাত্র উপায় গৃহবন্দি হওয়া। জাতীয় সড়কের উদ্ধত ট্রাকের মতো বড় বড় হরফে জানান দিচ্ছে সাবধানবাণী: দূরত্ব বজায় রাখুন।
পরিস্থিতি কতটা নাগালের বাইরে গেলে নির্দ্বিধায় আরোপ করা যায় এমন এক ‘সমাজ-বিরুদ্ধ’ স্বাস্থ্যবিধি? দুনিয়া জুড়ে করোনা মোকাবিলার ঢাল হিসেবে খাড়া করা হয়েছে বিচিত্র এক সুরক্ষা-কবজকে— ‘সামাজিক দূরত্ব’। সেই বন্দি অবস্থার কবলে এখন আপনি, আমি ও অনেকেই। সাবধানতা ও সতর্কতার স্বার্থে এই ‘সামাজিক দূরত্বই’ এখন অন্যতম প্রতিষেধক। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তা মেনে নিতে হচ্ছে। কিন্তু, কতখানি হলে ‘সামাজিক দূরত্ব’ পর্যাপ্ত হয়? সেই সঠিক ও নিশ্চিত গণনা কি ফিতে দিয়ে, বা স্বেচ্ছা-গৃহবন্দি অবস্থান দিয়ে মাপা সম্ভব? ক’জন মানুষের পক্ষে সে দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব?
শরীর আর সমাজ, আর যা-ই হোক, সমার্থক শব্দ নয়। তাই শরীরিক দূরত্ব ও সামাজিক দূরত্বের মধ্যে কিছু ধারণামূলক পার্থক্য আছে। পাশ্চাত্য বা প্রতিপত্তিসম্পন্ন দেশগুলি বা ইতিপূর্বে বিচ্ছিন্ন সমাজ চোখ বন্ধ করে ধরে নেয় যে সামাজিক দূরত্ব মানে শারীরিক দূরত্বও বটে। সেখানে স্বাভাবিক অবস্থাতেও মানুষ মানুষের সঙ্গে যথেষ্ট সামাজিক/শারীরিক/আক্ষরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলে। কিন্তু যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব ও রোজকার রুজি-রুটির অবিরাম ও অক্লান্ত সন্ধান মানুষের টুঁটি চেপে ধরে, সেখানে ‘দূরত্ব’ মানে এক চরম বিলাসিতা— খেটে খাওয়া মানুষের নাগালের অনেকটাই বাইরে।
কোনও এক ট্রেনের কামরায়, হাজার মানুষের ভিড় সাক্ষ্য রাখে চূড়ান্ত ঘেঁষাঘেঁষির— শারীরিক দূরত্ব সেখানে অসম্ভব। এক চালের নীচে পাঁচ ব্যক্তির দিবারাত্রি বসবাস মনে করিয়ে দেয় বাধ্যতামূলক সহাবস্থান— শারীরিক দূরত্ব সেখানে অবাস্তব। একশো ত্রিশ কোটি জনসংখ্যার উপমহাদেশে অধিকাংশ বাজারে, জনপথে, জনপরিবহণে, আবাসনে, মাঠে, ঘাটে, দফতরে— ‘ঠাসাঠাসি’ এক অতি পরিচিত স্বাভাবিক সামাজিক পরিস্থিতি যা অনস্বীকার্য ও অনিবার্য। আমাদের অধিকাংশ আর্থসামাজিক আদানপ্রদান ও বিনিময়, আজও সঞ্চালিত হয় সশরীরে। এ-হেন অবস্থায় শারীরিক উপস্থিতি বাদ দিলে, বা বাদ দিতে বাধ্য করলে, সমাজ বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। পারিবারিক সমষ্টি, প্রাদেশিক সমষ্টি, মাতাগত সমষ্টি, শ্রেণি-জাতি-কর্মগত সমষ্টি এবং বিভিন্ন প্রকারের জনসমাগম, আমাদের জনজীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জর্জরিত। এ জনজীবন আমাদের মজ্জায়— আমাদের জীবনচর্যার মূলে। কোনও এক অদৃশ্য ভাইরাস-আতঙ্ক ও সংক্রমণের ভয় এত কোটি মানুষের এত দিনের অভ্যাসকে আমূল পাল্টে দিতে পারবে কি? কোনও সাবান বা স্যানিটাইজ়ার দিয়ে তা ধুয়ে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। ঠিক যেমন করোনা-ভয় বলছে না— ‘মুখাবরণ সরিয়ে দেওয়ালে পিক ফেলার প্রবণতাকে আটকাও’।
এ ছাড়া হাত, হাতল, আসবাব, বাসনকোসন, জামাকাপড়, কাগজপত্র, যন্ত্রপাতি, টাকাপয়সা, ইত্যাদি না ছোঁয়া কি সম্ভব? বা, সেগুলোকে কত বার, কত ভাবে, কত ক্ষণ ধোবেন— সে ঘরেই হোক বা বাইরে? তা ছাড়া কারখানার শ্রমিক, মুটে-মজুর, ফুল-ফল-সবজি-মাছ বিক্রেতা, ফেরিওয়ালা, সাফাই কর্মচারী, পিয়ন, কাজের মাসি, রান্নার ঠাকুর ও আরও অজস্র কর্মজীবী মানুষ, যাদেরকে বহু পথ ঘুরে, বহু বার বাস-ট্রেন পাল্টে কর্মস্থলে পৌঁছতেই হয় প্রতিনিয়ত— তাঁদের কাছে ‘ঘরে বসে কাজ’ এক অলীক, অকল্পনীয়, আজগুবি ধারণা নয় কি? ঘরে বসে ইন্টারনেট ও কম্পিউটারে ‘কনফারেন্স কল’ করে কাজ করার সুবিধে ও অধিকার ক’জনের? সংগঠিত সেক্টরে থাকা মানুষজনের— যাঁদের সংখ্যা মোট কর্মরত মানুষের পাঁচ শতাংশ বা তারও কম!
এ দেশে ‘সামাজিক দূরত্ব’ তৈরি করা দুঃসাধ্য হলেও তা অনাবশ্যক, এমনটা এক বারও বলছি না। কিন্তু যে সকল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষজনের পক্ষে সেই দূরত্ব বজায় রেখে জীবিকা নির্ধারণ অসম্ভব, তাঁদের সুরক্ষার্থে অবিলম্বে প্রয়োজন ব্যাপক আকারে করোনা-পরীক্ষার মাত্রাবৃদ্ধি। কিছু দিন আগে পর্যন্তও কেবলমাত্র বিদেশফেরত বা সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আশা মানুষজনকেই করোনা-পরীক্ষার জন্য উপযুক্ত মনে করা হচ্ছিল। উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও বাকিদের গ্রাহ্য করা হচ্ছিল না। যার ফলে নিঃসন্দেহে সংক্রমণের পথ আরও প্রশস্ত হয়েছে ইতিমধ্যেই।
প্রতিরোধ ও সাবধানতা জরুরি। বিনোদন, রেস্তরাঁ, থিয়েটার, ক্লাবঘর, ক্লাসঘর কিছু দিনের জন্য বন্ধ করার সঙ্গে প্রয়োজন রোগী চিহ্নিত করার জন্য বিপুল উদ্যম ও তার পরিকাঠামো নির্মাণ। ছুটির দিনের ‘জন-কার্ফু’ শেষে সান্ধ্য তালি ও থালি বাজিয়ে মহামারি প্রতিরোধ করা যায় না। প্রয়োজন শক্ত পদক্ষেপ ও সুপরিকল্পিত কর্মসূচি।
সমাজতত্ত্ব বিভাগ, শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়