Coronavirus

বন্ধ পরিবহণ, মাঠেই শুকোচ্ছে ফসল

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে ‘লকডাউন’ শুরু হওয়ার পরে মূলত পরিবহণ ব্যবস্থা অনিয়মিত হয়ে পড়ায় ধাক্কা খেয়েছে কৃষিপণ্যের বাজারজাত করার প্রক্রিয়া। তার জেরে মাঠের ফসল মাঠেই নষ্ট হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। রাজ্যের নানা প্রান্তের সঙ্গে এই পরিস্থিতির শিকার পুরুলিয়ার চাষিরাও। লিখছেন শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডলগত কয়েক বছর ধরেই কৃষি ও উদ্যানপালন দফতর জেলায় আনাজ চাষে জোর দিচ্ছে। ‘আতমা’ প্রকল্পে কৃষি-দল গড়ে অনেকটা সমবায় পদ্ধতির ধাঁচে কৃষকদের আনাজ চাষে মাঠে নামাচ্ছে কৃষি দফতর।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২০ ০২:৪৯
Share:

জমিতে পড়ে থেকে হলুদ হয়ে গিয়েছে শসা। পুরুলিয়ার বান্দোয়ানের একটি জমিতে। ছবি: রথীন্দ্রনাথ মাহাতো

কৃষিপণ্য বাজারজাত করার কাজটা বরাবরই হয় শৃঙ্খলপথে। এই শৃঙ্খলের একেবারে নীচে থাকে চাষি। তার পরে ধাপে ধাপে ফড়েদের মাধ্যমে বাজার এবং সেখান থেকে পাইকারি বিক্রেতা বা আড়তদারের হাত ঘুরে মাঠের ফসল পৌঁছয় শেষ ধাপে অর্থাৎ ক্রেতার কাছে।

Advertisement

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে ‘লকডাউন’ শুরু হওয়ার পরে মূলত পরিবহণ ব্যবস্থা অনিয়মিত হয়ে পড়ায় ধাক্কা খেয়েছে কৃষিপণ্যের বাজারজাত করার সেই শৃঙ্খল। তার জেরে মাঠের ফসল মাঠেই নষ্ট হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। রাজ্যের নানা প্রান্তের সঙ্গে এই পরিস্থিতির শিকার পুরুলিয়ার চাষিরাও।

গত কয়েক বছর ধরেই কৃষি ও উদ্যানপালন দফতর জেলায় আনাজ চাষে জোর দিচ্ছে। ‘আতমা’ প্রকল্পে কৃষি-দল গড়ে অনেকটা সমবায় পদ্ধতির ধাঁচে কৃষকদের আনাজ চাষে মাঠে নামাচ্ছে কৃষি দফতর। পুরুলিয়ার মতো চাষে বৃষ্টিনির্ভর জেলায় আমন ধান চাষ মানেই যে আশা-আশঙ্কার দোলাচল, তা চাষি মাত্রেই জানেন। পাশাপাশি, পুরুলিয়ায় নিচু জমি বা ‘বহাল’-এর পরিমাণও কম। বেশির ভাগই উঁচু ‘কানালি’ ও ‘বাইদ’ প্রকৃতির জমি। এই প্রকারের জমিতে বৃষ্টির জল জমে না। বয়ে চলে যায়।

Advertisement

তাই শুধু আমন ধান চাষ করে আর্থিক সাবলম্বী হওয়াটা অন্তত এ জেলার ক্ষেত্রে আকাশকুসুম কল্পনাই। এই পরিস্থিতির বদল ঘটাতে আনাজ চাষে জোর দেওয়া শুরু। যার নিট ফল, বর্তমানে আনাজ চাষের এলাকা অনেকটাই বেড়েছে জেলায়। পুরুলিয়ার বড় শহরগুলির আনাজের চাহিদার বড় অংশই মিটিয়ে ফেলতে পারছেন জেলার আনাজ চাষিরাই। শুধু তাই নয়, ঝালদা মহকুমার চাষিরা লাগোয়া ঝাড়খণ্ডেও নানা ধরনের আনাজ পাঠাচ্ছেন।

আরও পড়ুন: নূতন দুনিয়া

এ মরসুমেও জেলার বিরাট অংশে আনাজ চাষ করেছেন চাষিরা। ফলনও হয়েছে প্রত্যাশামতো। তবে ছবিটা বদলাতে শুরু করে মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে। ‘লকডাউন’ শুরু হওয়ায় বন্ধ হয় ট্রেন চলাচল। জেলা, জেলার বাইরে বিভিন্ন অংশেও গাড়ি চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। আনাজবাহী গাড়ির ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হলেও শাক-সবজির মতো কৃষিপণ্য বাজারজাত করার মতো পরিবহণ এক অর্থে বন্ধই। ফলে, ফসল চাষিরা বাজারে নিয়ে যেতে পারছেন না। সেখানে ফড়েদের মাধ্যমেই মূলত চাষিরা পাইকারি বিক্রেতা বা আড়তদারদের কাছে আনাজ বিক্রি করেন। খুব কম চাষিই আছেন যাঁরা সরাসরি বাজারে বসে আনাজ বিক্রি করেন। শুধু তাই নয়, অনেক সময়ে ফড়েরাও সরাসরি গ্রামে এসে চাষিদের কাছ থেকে বস্তাবন্দি করে আনাজ কিনে নিয়ে যান। ‘লকডাউন’-এর জেরে সেই প্রক্রিয়াও ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি, বাজারে ক্রেতার সংখ্যাতেও ঘাটতি পড়েছে। সম্মিলিত ফলে আনাজ বাজারজাত করার গোটা ব্যবস্থাই কার্যত ভেঙে পড়েছে।

গরমের শুরুতে চাষিরা যেমন গ্রীষ্মকালীন আনাজ চাষ করেন, তেমন অনেক চাষি শীতের শেষ দিকের আনাজ, যেমন—ফুলকপি, বাঁধাকপিও চাষ করে থাকেন। ‘লকডাউন’-এর জেরে এখন বিঘার পর বিঘা জমি জুড়ে শসা, লাউ, কুমড়ো, ঢ্যাঁড়শের মতো গরমের আনাজের সঙ্গে পড়ে রয়েছে শীতকালীন ফুলকপি, বাঁধাকপিও। পরিস্থিতি কোন জায়গায় পৌঁছেছে, তা কয়েকটি ঘটনাতেই স্পষ্ট।

সাঁতুড়ির দণ্ডহিত গ্রামের চাষিরা অন্তত ৩৫-৪০ বিঘা জমি জুড়ে পুদিনার চাষ করেন। সেই পুদিনা তাঁরা নিয়ে যান পশ্চিম বর্ধমানের আসানসোল ও বার্নপুরের বাজারে। দৈনিক কয়েক টন পুদিনা সাঁতুড়ি থেকে আসানসোলে যায়। মার্চ থেকে মে, এই তিন মাসে গ্রামের প্রতি চাষি পুদিনা বিক্রি করেই আয় করেন অন্তত দেড় লক্ষের বেশি টাকা।

অথচ ‘লকডাউন’-এর জন্য মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে মাঠেই পড়ে রয়েছে ফসল। বাধ্য হয়ে পুদিনা কেটে মাঠের ধারে ফেলে দিচ্ছেন চাষিরা। পরিবহণ বন্ধ থাকায় ঝালদা থেকে ঝাড়খণ্ডে আনাজ রফতানিও বন্ধ। এই মহকুমার বিভিন্ন এলাকা থেকে আনাজ গাড়িতে করে চলে যেত পড়শি ঝাড়খণ্ডের রাঁচী, বোকারো, জামসেদপুরের মতো এলাকাগুলিতে।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে চাষিরা স্থানীয় ভাবে আনাজ বিক্রি করছেন। তবে ফড়েরা গ্রামে পৌঁছতে না পারায় বিপদে পড়েছেন মূলত প্রান্তিক চাষিরাই। কারণ, তাঁদের অনেকের পক্ষেই গাড়ি ভাড়া করে পড়শি রাজ্যের বাজারে গিয়ে সেখানে বসে আনাজ বিক্রি করা সম্ভবপর নয়। আর সুযোগ বুঝে অনেক ক্ষেত্রে গাড়ির বেশি ভাড়া হাঁকা হচ্ছে, এমন অভিযোগও সামনে আসছে। ঝালদা এলাকার অনেক চাষিই মহাজনদের কাছে ঋণ নিয়ে এ মরসুমে টোম্যাটো চাষ করছেন। ‘লকডাউন’-এর জেরে তাঁদের অনেকেরই ফসল এখন মাঠে শুকোচ্ছে। হাতেগোনা যে কয়েক জন ফড়ে বা পাইকারি বিক্রেতা আসছেন, তাঁরাও টোম্যাটো কিনছেন কেজি প্রতি তিন-চার টাকা দামে। অনেক চাষিই যে বাধ্য হয়ে উৎপাদিত আনাজ ঘরের গবাদি পশুদের খাইয়ে দিচ্ছেন, এমন ছবি গাঁ-গঞ্জে ঢুঁ মারলেই চোখে পড়ছে। এ দিকে, বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক না হলে আনাজের দাম যেমন আকাশ ছোঁয়ার আশঙ্কা থাকছে, তেমনই তৈরি হতে পারে সাময়িক খাদ্য-সঙ্কটও। পর্যাপ্ত উৎপাদন সত্ত্বেও এমন অবস্থা তৈরি হলে তা হবে অত্যম্ত দুর্ভাগ্যজনক।

সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা, ‘লকডাউন’ না উঠলে আনাজ বাজারজাত করার শৃঙ্খল স্বাভাবিক ছন্দে ফিরবে না। তাই আপাতত চাষিদের আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার মতো পরামর্শও তাঁরা দিতে পারছেন না। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে কিছুটা হলেও আনাজ ‘সুফল বাংলা’র মতো সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে বাজারজাত করতে পারতেন চাষিরা। কিন্তু প্রান্তিক এই জেলায় সেই প্রকল্পের সুবিধা পাওয়া নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান চাষিরা।

৩ মে পর্যন্ত ‘লকডাউন’-এর মেয়াদ বর্ধিত হলেও কৃষিক্ষেত্রে পরিবহণ স্বাভাবিক রাখার বার্তা দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। তা ঠিকমতো কার্যকর হলে ফসল বাজারজাত করার সমস্যা মিটবে। আপাতত সেই আশায় বুক বাঁধছেন চাষিরা।

আরও পড়ুন: সম্পাদক সমীপেষু: বিধ্বস্ত মহানগর

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন