রাহুল গাঁধী। ছবি পিটিআই।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নিরবচ্ছিন্ন ক্ষয়ের চলৎ-চিত্রটি উত্তরোত্তর অতিমাত্রায় কুদর্শন হইয়া উঠিতেছে। ‘জাতীয়’ অভিধাটি এই দলের পক্ষে এখন যেন এক নিষ্ঠুর পরিহাস। দেশের অধিকাংশ রাজ্যেই তাহার শক্তি বলিতে বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নাই। লোকসভা নির্বাচনে পর পর দুই বার মোট আসনসংখ্যার দশ শতাংশে পৌঁছাইতে ব্যর্থ; টিমটিম করিয়া ক্ষমতার প্রদীপ জ্বলিতেছে মুষ্টিমেয় রাজ্যে; তাহারও কিছু ইতিমধ্যে মোদী-শাহের ফুৎকারে নিবিয়াছে, যথা মধ্যপ্রদেশ; কোথাও বা প্রদীপের প্রধান জ্বালানি-শক্তি সরবরাহ করিতেছে জোটসঙ্গী, যে সঙ্গী চিরকাল প্রতিপক্ষ ছিল, যথা মহারাষ্ট্র; বিহার নির্বাচনে মহাজোটের শরিক হিসাবে সত্তরটি আসনে প্রার্থী দিয়া এই দল ডাঙায় তুলিতে পারিয়াছে মাত্র উনিশ বিধায়ককে— কেবল নিজে ডুবে নাই, জোটকেও ডুবাইয়াছে। এমন অবস্থায় দলনেতারা সমবেত ভাবে হৃতশক্তি পুনরুদ্ধারে যত্নবান হইবেন, ইহাই প্রত্যাশিত এবং জরুরি। কিন্তু ঘটিতেছে তাহার বিপরীত। নানা মাপের নানান নেতা দলের সমস্যা লইয়া নানাবিধ বিরূপ মন্তব্য নিক্ষেপ করিতেছেন, আবার অন্যরা সেই মন্তব্য খণ্ডন করিয়া পাল্টা বার্তা বা বিবৃতি দিয়া চলিয়াছেন। কংগ্রেসে এমন ‘উন্মুক্ত অন্তঃকলহ’ নূতন নহে, কিন্তু যে দল অস্তিত্বের সঙ্কটে আপন্ন এবং রাজনীতির মঞ্চে কার্যত অপ্রাসঙ্গিক, তাহার নেতাদের এই দৈনন্দিন তরজা কেবল দুর্ভাগ্যজনক নহে, একই সঙ্গে হাস্যকর এবং করুণ।
দীর্ঘকাল ধরিয়া সমস্ত প্রশ্নে এই দল যে ‘হাই কমান্ড’-এর নির্দেশনায় চলিয়াছে, প্রতি পদে যাহার মুখ চাহিয়া এবং আঁচল ধরিয়া থাকিয়াছে, যে কোনও সাফল্যের কৃতিত্ব যাহার আমানতে জমা করিয়াছে, এই পরিণতির দায়ও সেই সর্বোচ্চ নেতৃত্ব অস্বীকার করিতে পারে না। ২০১৪ সালের বিপর্যয়ের পরে দলের পুনরুজ্জীবন ঘটাইতে নিজেদের অক্ষমতা তাঁহারা বার বার প্রমাণ করিয়াছেন। এক কথায় বলিলে, রাহুল গাঁধী দলনেতা হিসাবে ব্যর্থ। কিন্তু গত লোকসভা নির্বাচনে ভরাডুবির পরেও তিনি কার্যত দলের সমস্ত নেতাকেই ব্যর্থতার দায়ে অভিযুক্ত করিয়াছিলেন, নিজেকে বাদ দিয়া। অতঃপর সভাপতির আসন হইতে তাঁহার সরিয়া দাঁড়াইবার পদক্ষেপটিতেও দায় স্বীকারের বদলে আহত অভিমানই প্রকট ছিল। এবং, তাহার পরেও, দল নিজেকে মন্থন করিয়া নূতন পথে চলিবার কোনও চেষ্টাই করিল না, সনিয়া গাঁধী ‘অন্তর্বর্তী সভাপতি’ হইয়া পুনরাগমন করিলেন! বছর ঘুরিয়া গিয়াছে, এখনও তিনি অন্তর্বর্তী সভাপতি। নূতন করিয়া দলের ‘সাংগঠনিক নির্বাচন’-এর প্রস্তুতি হইতেছে। দৃশ্যত, এই উদ্যোগের প্রকৃত লক্ষ্য রাহুল গাঁধীকে সভাপতির পদে ফিরাইয়া আনা!
অথচ ভারতীয় গণতন্ত্রের এখন কংগ্রেসকে প্রয়োজন ছিল। সঙ্ঘ পরিবারের আগ্রাসী সংখ্যাগুরুবাদের প্রতিস্পর্ধী বিকল্প হিসাবে সর্বভারতীয় স্তরে একটি ধর্মনিরপেক্ষ, সামাজিক ভাবে উদারপন্থী এবং আর্থিক সংস্কারের প্রতি অনুকূল রাজনৈতিক মঞ্চ কেবল আবশ্যক নহে, কার্যত অপরিহার্য। সেই ভূমিকায় কংগ্রেসের স্বাভাবিক যোগ্যতা ও প্রাসঙ্গিকতা ছিল। একাকী নহে, বিভিন্ন রাজ্যের বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির সহিত সমন্বয়ের ভিত্তিতে একটি যথার্থ যুক্তরাষ্ট্রীয় বিকল্প নির্মাণে এই দল প্রধান ভূমিকা লইতে পারিত। তাহার জন্য আপন নীতি, আদর্শ এবং অবস্থান স্থির করা দরকার ছিল। সর্বাগ্রে প্রয়োজন ছিল আত্মপ্রত্যয়ের সহিত আপনাকে নূতন করিয়া গড়িয়া তুলিবার। কিন্তু এই সকল বিষয়ে ভাবিবার বিন্দুমাত্র বাসনাও বোধ করি আজ আর ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নাই। এক দিকে গাঁধী পরিবারের আশ্রয়, অন্য দিকে নরম হিন্দুত্বের উপবীত— একশো পঁয়ত্রিশ বৎসর বয়সি দলটি সোজা কৃষ্ণগহ্বরের দিকে চলিতেছে। অবিচল পদক্ষেপে।