নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।
সে দিন গঙ্গারাম হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে দিল্লি অফিসে আসছিলাম অটোরিকশায় চেপে।
রাস্তায় খুব যানজট। অটোরিকশা চালক খুব উত্তেজিত সেই বিভ্রাটে। তাঁর নাম নরেশ। বিহারের আড়া জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা। নরেশ রাগের সঙ্গে বলেছিলেন, নরেন্দ্র মোদী যে ধনীদের দৌরাত্ম্য থামাতে চাইছেন, তা হলে তো তিনি এই দিল্লির বড়লোকদের এক একটি পরিবারের পাঁচ-ছ’টি করে গাড়ি কেনাটা তো বন্ধ করতে পারেন। প্রচণ্ড বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব করে নরেশ বললেন, ‘‘জানেন তো, চিনদেশে বড়লোকদেরও সাইকেল চালিয়ে অফিসে যেতে হয়। সরকার সেটা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে সে দেশে।’’
নরেশকে জিজ্ঞাসা করলাম, মোদীর নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েআপনার কী মনে হচ্ছে? এতে কি সত্যিই গরিবদের উপকার হবে? এ প্রশ্নে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন নরেশ। বললে, ‘‘শুনুন, আমরা হলাম বিহারের বানিয়া। মোদীকেও ভোট দিয়েছিলাম। এ বারেও ভেবেছিলাম নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে বড়লোকেরা বেশ ঢিট হয়ে যাবে। কিন্তু কোথায় কী? আমার বাবা গ্রামের কৃষকদের কাছ থেকে ধান আর গম কিনে শহরে ব্যাপারিদের কাছে এসে বিক্রি করে। এ বার হঠাৎ পুরনো নোট বাতিল এমন একটা সময়ে হয় যখন বাবা ধান-গম কিনে ফেলেছে, কারণ তখন ছিল ফসল উৎপাদনের সময়। কিন্তু শহরের ব্যাপারিরা সে টাকা নগদে দিয়েছিল পুরনো নোটে। বাবার খুবই কষ্ট হয়েছে। অনেক ব্যাপারির কাছ থেকে এখনও টাকা পায়নি নতুন নোটের অভাবে।
আমি বললাম, মোদীজি তো বলছেন, কষ্টটা শুধুমাত্র কিছু দিনের জন্য, কিছু দিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে। তখন তো আপনারা ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড ব্যবহার করবেন। এ দেশে এসে যাবে প্লাস্টিক মানি।
আরও এক ধাপ সুর চড়ালেন নরেশ। অটোর স্টিয়ারিংয়ের কান ধরে মোচড় দিয়ে গর্জন ছেড়ে বললেন, ‘‘দেখুন, যদি অত পড়াশোনা জানতাম, তা হলে তো আর অটো চালাতাম না। আপনার মতো অটোর পিছনে বসতাম। আমরা দু’ভাই। দু’জনেই দিল্লিতে অটো চালাই। লেখাপড়া করিনি। তাই তো দু’ভাই দিল্লি চলে এসে এই দুঃখের ধান্দা করছি। তা মোদীজি আগে এ দেশের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যবস্থাটা করুন না। তা হলে তো এটিএম-ক্রেডিট কার্ড-পেটিএম এ সব খুব করব আমরা।’’
চমকে গেলাম নরেশের এ কথা শুনে। এ তো অমর্ত্য সেনের কথা বলছেন ওই অটোচালক! নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ বলেছেন, ভারতে আশু প্রয়োজন প্রাথমিক স্বাস্থ্য ও প্রাথমিক শিক্ষা। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা হল একটা সমাজের মেরুদণ্ড। অমর্ত্য সেন কে তা জানেন না নন-রেসিডেন্ট বিহারি নরেশ। কিন্তু দার্শনিকের মতো মোক্ষম একটা সত্যি কথা বলেছেন। আমি দেখেছি, জানেন, এ দেশে এই অটোরিকশা চালক, ট্যাক্সি ড্রাইভার, নাপিত অথবা চা বিক্রেতারা অনেকেই খুব বড় মাপের দার্শনিক। তা সে দিল্লিই হোক আর লখনউ-পটনা-কলকাতা।
নরেশের সঙ্গে আমিও একমত, এই সিদ্ধান্তগ্রহণে যতটা দীর্ঘমেয়াদি সদিচ্ছা ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল নাটক। আর এই নাটকীয়তার উদ্দেশ্য একটাই, দেশের ভেতর ভোটের রাজনীতিতেও বাজিমাত করা। এ-ও ছিল নরেন্দ্র মোদীর পলিটিকস অফ অপটিকস্। আকস্মিক আর্থিক সংস্কারের চেষ্টা যে প্রথম ভারতই করছে এমন নয়। ১৯৮৭ সালে বর্মা, ১৯৯১ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, ২০০৯ সালের উত্তর কোরিয়া করেছে কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ। বর্মায় বিদ্রোহ হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো হয়ে গিয়েছে। উত্তর কোরিয়ায় চূড়ান্ত খাদ্যসঙ্কট শুরু হয়ে যায়।
নরেন্দ্র মোদীর এই বিমুদ্রাকরণের সিদ্ধান্তও এই একই রকম কার্বাইড দিয়ে দ্রুত ফল পাকানোর চেষ্টা। যথেষ্ট হোমওয়ার্ক না করেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা। মোদী ভেবেছিলেন এই সিদ্ধান্তগ্রহণে গোটা দেশের গরিব মানুষের কাছে তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করবেন। কালোবাজারি বন্ধ করে তিনি লোভী ধনী সমাজকে একটা ভয়ঙ্কর ধাক্কা দেবেন। ভারতের সামগ্রিক জিডিপি-র এক পঞ্চমাংশ হল কালো টাকা। এটা ২০১০-এ বিশ্বব্যাঙ্কের ‘এস্টিমেশন’ ছিল। ভোটের সময় মোদী বলেছিলেন ভারতের কালো টাকার অর্থনীতির বিনাশ ঘটাবেন। এই সিদ্ধান্ত মোদীর নির্বাচনী ইস্তেহারের বাস্তবায়ন। এর জন্য গোটা দেশ জুড়ে তিনি প্রচুর হাততালি পাবেন এমনটাই তো প্রত্যাশিত ছিল।
উদ্দেশ্য ছিল, ভারতের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় আরও টাকা ঢুকবে, ভারতের করদাতাদের সংখ্যা আরও প্রসারিত হবে, সরকারি রাজকোষে দুর্নীতিগ্রস্তদের ফাঁকি দেওয়া টাকা ফেরত আসবে। জাল নোটের ষড়যন্ত্র আপাতত বন্ধ হবে। আধুনিক ডিজিটাল মুদ্রাহীন এক নতুন ভারত নির্মাণের স্থপতি হবেন মোদী।
বাস্তবে কিন্তু এক ভিন্ন চিত্র দেখা গেল। প্রথমত, ধনীতন্ত্র আদৌ এতে কোনও ভাবেই বিপর্যস্ত হল না। যে ধনী গোষ্ঠীকে বিদেশি সমাজবিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ‘প্লুটোক্রেসি’। ভারতে সেই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর তেমন কোনও অসুবিধাই হয়নি। কেননা, কালো অর্থনীতির মধ্যে কালো নোট গড়পড়তা শতকরা পাঁচ থেকে ছ’ভাগ মাত্র। অন্যান্য নানা ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ককে এড়িয়েই ধনী কালো অর্থনীতির পৃষ্ঠপোষক হতে পারেন। ভারতীয় কর্মীদের শতকরা চার থেকে পাঁচ ভাগ হল অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক। তাঁদের বেতন হয় টাকায়। তাঁদের মালিকেরা তাঁদের টাকা দিতে পারছেন না পুরনো টাকা চলছে না বলে। উপভোক্তা-নির্ভর ব্যবসায় শতকরা ৯৮ ভাগ হল ক্যাশ টাকায়। ব্যাঙ্কে টাকার যোগান নিয়েও সমস্যাগুলি মেটেনি। প্রতি মাসে তিন বিলিয়ন নোট ছাপার ক্ষমতা ছিল ভারতীয় নোট ছাপাখানায়। আর শেষ মুহূর্তে জানানোয় টাকা ছাপানোর জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যায়নি।
আসলে এ দেশে গরিব মানুষের কল্যাণের জন্য অগ্রাধিকার হওয়া দরকার শ্রম-সংস্কারে। প্রকৃত আর্থিক সংস্কার না করে আচমকা ক্যাশলেস, পরে লেসক্যাশ সমাজ গঠনের ঘোষণা করে গোলপোস্ট পরিবর্তন করেছেন মোদী। কিন্তু এ সব করার আগে মোদীর উচিত ছিল আরও ভাবা। আরও আলোচনা করা।
ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না। এই সহজ-সরল লোক-উপদেশটি মোদীর জানা প্রয়োজন। যে দেশে টাকার বিনিময় হয় শতকরা ৯৮ ভাগ, চিনের চেয়েও বেশি (৯০ ভাগ), ব্রাজিল ৮৫ ও আমেরিকায় শতকরা ৫৫ ভাগ সে দেশে এই সিদ্ধান্ত আচমকা ঘোষণা করাতে কী বীরত্ব প্রকাশ পেল?
(এখন থেকে ‘শাহি সমাচার’ বুধবারের পরিবর্তে প্রতি বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হবে।)