সংস্কৃতি যখন লড়াইক্ষেত্র
Salil Chowdhury

সলিল চৌধুরীরা ছিলেন পরতে পরতে রাজনৈতিক সঙ্গীতকার

অভিযোগের উত্তরে সলিলের স্পষ্ট উত্তর ছিল, হারমনি ও অর্কেস্ট্রেশন যদি বিদেশি হয়, তবে পেনিসিলিনও বিদেশি। কারণ, সেটার উদ্ভাবনও পাশ্চাত্যেই ঘটেছে।

Advertisement

শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার

শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২২ ০৫:০৯
Share:

সমস্বর: আইপিটিএ-র সহযোদ্ধারা। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সলিল চৌধুরী, দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র প্রমুখ

লড়াইটা অ-সুরের বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল সুরের পথের সহযাত্রীদের সঙ্গে। সে এক দারুণ সময়। সকলে মিলে তখন নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখছেন। লড়াইয়ের নতুন গান তৈরি হচ্ছে। গণনাট্যের সপ্তম সর্বভারতীয় সম্মেলনে হেমাঙ্গ বিশ্বাস বললেন, সলিলের গানে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রতি ঝোঁক। তার এই হারমনি আর অর্কেস্ট্রেশনের বাড়াবাড়ি সাধারণ শ্রমজীবী জনতার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। আমাদের গান তৈরি করতে হবে পরম্পরাগত লোকসুরের উপরে লড়াই আন্দোলনের কথা যোগ করেই। মেনে নিলেন না সলিল চৌধুরী। বললেন, নতুন দিনের গান নতুন ভাষা দিয়েই তৈরি হবে। তাতে ঘটবে লোকায়ত ও শাস্ত্রীয়, পরম্পরাগত ও আধুনিক, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সঙ্গীতের মেলবন্ধন। এই সময়ের বহুমাত্রিকতা শুধু একরৈখিক মেলোডি দিয়ে ধরা সম্ভব নয়।

Advertisement

প্রসঙ্গত বলা যায়, রবীন্দ্রনাথও ‘সোনার কাঠি’ প্রবন্ধে একই কথা বলেছিলেন, “আমাদের সাহিত্যে চিত্রে সমুদ্রপারের রাজপুত্র এসে পৌঁচেছে। কিন্তু সংগীতে পৌঁছয় নি। সেইজন্যেই আজও সংগীত জাগতে দেরি করছে। অথচ আমাদের জীবন জেগে উঠেছে।”

অভিযোগের উত্তরে সলিলের স্পষ্ট উত্তর ছিল, হারমনি ও অর্কেস্ট্রেশন যদি বিদেশি হয়, তবে পেনিসিলিনও বিদেশি। কারণ, সেটার উদ্ভাবনও পাশ্চাত্যেই ঘটেছে। পেনিসিলিনও যেমন এক দিন পাশ্চাত্যে ছিল না, তেমনই হারমনি ও অর্কেস্ট্রেশনও পাশ্চাত্য সঙ্গীতে এসেছে একটা সময়ের পর। এর উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের সঙ্গে বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ভারতেও ইউরোপীয়দের আগমনের পর গ্রামীণ সঙ্গীতের আসরেও বেহালা, হারমোনিয়াম, ক্ল্যারিয়োনেট চলে এসেছে। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের অভিমত বদলে গিয়েছিল পরবর্তী জীবনে। আত্মজীবনীতে তিনি বলেছেন, “…বিষয়বস্তুর আলোচনাকে অগ্রাধিকার না দিয়ে এভাবে শুধু লোক আঙ্গিক নিয়ে বিতর্ক চালানো, ওটাও তো এক ধরনের ‘ফর্মালিজ়ম’। সলিলের ফর্মালিজ়ম-এর সমালোচনা করতে গিয়ে আমি নিজেও এক ধরনের ফর্মালিজ়ম-এর শিকার হয়েছিলাম। লড়াইটা হয়েছিল ফর্ম-এর।” পরে হেমাঙ্গ বিশ্বাসও রচনা করেন ‘শঙ্খচিল’-এর মতো গান, যা দেশি-বিদেশি নানা সুরের মিশ্রণে তৈরি।

Advertisement

আসলে লড়াইটাও শুধুমাত্র লোকায়ত বনাম পাশ্চাত্য সুরের ছিল না। ছিল আরও গভীরে। সে দিনের বিতর্ক প্রসঙ্গে হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেছেন, “স্তালিনের সেই বক্তব্য: International in content, national in form— এই ছিল আমার তাত্ত্বিক ভিত্তি।” এখন প্রশ্ন উঠবে, ফর্ম ও কনটেন্ট কি দু’টি স্বাধীন সত্তা? একটিকে কঠোর ভাবে আন্তর্জাতিক ও আর একটিকে একই ভাবে দেশি চেহারায় অবিকৃত রেখে কি কোনও শিল্প সৃষ্টি সম্ভব? হেমাঙ্গ বিশ্বাস সে দিন যা বোঝাতে চেয়েছিলেন তা হল, গানের ক্ষেত্রে সুর হচ্ছে ফর্ম যার চেহারা হবে ‘জাতীয়’ এবং বাণী কনটেন্ট, যাকে হতে হবে ‘আন্তর্জাতিক’।

প্রশ্ন হল, সুরকে ফর্ম ও বাণীকে কনটেন্ট বলা কতটা যুক্তিসঙ্গত? এই কথা মানলে বলতে হয় বাখ থেকে বেঠোফেন, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান থেকে বিসমিল্লা খান বা রবিশঙ্কর, এঁরা কেউই সারা জীবনে কোনও কনটেন্ট দেননি, শুধু ফর্মই বাজিয়ে গেছেন। আসলে গণসঙ্গীত নিজেই একটি সঙ্গীতের ফর্ম, যেমন রবীন্দ্রসঙ্গীত বা খেয়াল। সলিল চৌধুরীও জানতেন এটা, তাঁর গানেও ফর্ম ও কনটেন্ট পরস্পর বিচ্ছিন্ন থাকেনি কখনও।

১৯৫০-৫১ থেকে সলিল চৌধুরীর মনে প্রশ্ন জাগছে, গণনাট্যের গান কি শুধু লড়াই সংগ্রামের তাৎক্ষণিক আবেদনের সাময়িক সৃষ্টির মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখবে? গান কি তৈরি হবে শুধু মিছিল-হরতালের জন্য, আর গণসমাবেশকে উপলক্ষ করে? এখান থেকেই উঠে আসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি— সংস্কৃতি কি সংগ্রামের হাতিয়ারই শুধু? সর্বযুগেই তো সংস্কৃতি যতটা হাতিয়ার, তার চেয়ে অনেক বেশি যুদ্ধক্ষেত্র। তুলসীদাসের কাব্য থেকে কবীরের দোহা হয়ে মহাত্মা গান্ধীর ‘ঈশ্বর আল্লা তেরে নাম’-এ রামের রূপান্তর যে পথে ঘটে, সেটাও সংস্কৃতির ভিতরের দ্বন্দ্ব সংঘর্ষেরই ফল। ওই একই সাঙ্গীতিক দ্বন্দ্ব সংঘর্ষের আন্তঃপাঠ্যতার পথ ধরে মোহিনী চৌধুরীর ‘পৃথিবী আমারে চায়’ থেকে সলিল চৌধুরীর ‘আজ নয় গুনগুন গুঞ্জন প্রেমে’-র ‘পৃথিবী তোমারে যে চায়’-এর জন্ম হয়। এটাই সলিলের সঙ্গীতের বামপন্থা, যেখানে চিৎকৃত ডাক নেই, কিন্তু গভীরতর রাজনীতি রয়েছে।

এ ভাবেই রবীন্দ্রনাথের ‘কৃষ্ণকলি’ তেভাগার ‘সেই মেয়ে’-তে রূপান্তরিত হয়, কিংবা রূপকথার সাত ভাই চম্পা আর একটি পারুল বোন সমকালের মাটিতে এসে দাঁড়ায়। এই সময়পর্বের তাঁর সৃষ্টি ‘গাঁয়ের বধূ’ বা ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে’ নিয়ে গণনাট্যের অভ্যন্তরে তীব্র সমালোচিত হয়েছিলেন সলিল। বলা হয়েছিল, ‘আশা স্বপনের সমাধি’, ‘বিধি’, ‘কপালগুণে’— এই শব্দগুলি গণনাট্যের আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এর পরই সলিল চৌধুরীর সঙ্গে গণনাট্যের প্রত্যক্ষ সংস্রব ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু তাঁর শিল্পীসত্তা গণনাট্য ছেড়ে যায়নি কখনও। তাঁর সৃষ্টির গভীরে ডুব দিলেই বোঝা যায়, এক রাজনৈতিক সঙ্গীতকারই জেগে আছেন পরতে পরতে। ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ’-এর সুর থেকে ‘ক্লান্তি নামে গো’ এবং এর পাশাপাশি তারও কিছু দিন আগে লেখা ‘ও আলোর পথযাত্রী’ শুনলে ভিতরের রাজনীতির সংযোগ বোঝা যায়। গণসঙ্গীত থেকে প্রেমের গানে বার বার ফিরে আসা নৌকা বা পথের প্রসঙ্গের মধ্যেও নিহিত রয়েছে তাঁর রাজনীতির আভাস।

সলিল চৌধুরী বিশ্বাস করতেন, শিল্পের যথাযথ শিক্ষা ছাড়া সাংস্কৃতিক সংগ্রাম অসম্ভব। ওই একই সময়পর্বে পার্টির কাছে প্রদত্ত আ থিসিস অন কালচারাল মুভমেন্ট-এ ঋত্বিক ঘটক বলেছিলেন, সংস্কৃতি আন্দোলনের অগ্রসৈনিক হতে পারেন একমাত্র পূর্ণসময়ের শিল্পীরাই। শিল্প যাঁদের জীবনের অঙ্গ, শিল্পই যাঁদের জীবনধারণের মাধ্যম। সংস্কৃতির সংগ্রাম ও জীবনধারণের টানাপড়েন তিনি অনুভব করেছেন নিজের জীবনে। রণদিভে-পর্বে আন্ধেরির গণনাট্যের কমিউন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ট্রামশ্রমিক শিল্পী দশরথ লালের দুরবস্থাও দেখেছেন।

ফিরে আসি শুরুর প্রসঙ্গে। গণনাট্যের বম্বের সপ্তম সম্মেলনের ওই বিতর্কে প্রকৃতপক্ষে প্রতিফলন ঘটেছিল ওই সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির অন্দরে চলতে থাকা আদর্শগত টানাপড়েনের। ১৯৪৮ সালের কলকাতায় দ্বিতীয় কংগ্রেসে রণদিভের নেতৃত্বে ডাক দেওয়া হয় সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার; ওই পথেই ১৯৪৯ সালে ইলাহাবাদের ষষ্ঠ সর্বভারতীয় সম্মেলনে চরম কট্টরপন্থার পথ নেয় গণনাট্য। কট্টরপন্থার রাজনৈতিক রূপ ছিল ‘ইয়ে আজ়াদি ঝুটা হ্যায়’, আর সাংস্কৃতিক রূপ ছিল হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ‘মাউন্টব্যাটন মঙ্গল কাব্য’। বিগত সত্তর বছরে বহু চড়াই-উতরাই ভাঙাগড়া পেরিয়ে আজ কমিউনিস্ট আন্দোলন ভারতের সাংবিধানিক গণতন্ত্রের নেহরুভিয়ান ধাঁচ রক্ষার সংগ্রামকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়ে মহাত্মা গান্ধীকে অসাম্প্রদায়িক ভারতীয়ত্বের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরছে, অথচ বামপন্থার সংস্কৃতি রয়ে গেছে এখনও ‘রঘুপতি রাঘব মাউন্টব্যাটন’-এর কট্টরপন্থার যুগে। এখনও অনেকের কাছেই গণসঙ্গীত মানে একমাত্র সেই সঙ্গীত, যেখানে আছে ‘একচেটিয়া পুঁজিবাদ, সামন্ততন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা’। এমনও যুক্তি দেওয়া হয় যে, ‘শঙ্খচিল’ আসলে ‘সুরের ইন্দ্রজাল’ নির্মাণ মাত্র। ত্রিপুরার শহিদ গণসঙ্গীতশিল্পী ব্রজলাল অধিকারীর ‘লালকে কেন ভয় ওরে ভাই’-এ ‘লাল সুতায় কি গাঁথলে মালা দেয় না গলায় চিকন কালা’-কে মেনে নিতেও দ্বিধা।

কবে সলিল চৌধুরীর জন্মশতবর্ষ, তা নিয়ে বিতর্ক আছে কোনও কোনও মহলে। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, এই উপলক্ষে সঙ্গীতের রাজনীতির সেই লড়াইকে আবার ফিরিয়ে আনা।a

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন