সরকারের পরিসংখ্যান প্রকাশে অনীহা, অতএব অনুমান ভরসা
Poverty

দারিদ্রের হিসাব কষা দায়

তেন্ডুলকর কমিটির দারিদ্ররেখার সীমা হল গ্রামাঞ্চলে মাসে মাথাপিছু ৮১৬ টাকা আর শহরাঞ্চলে ১০০০ টাকা (যা বিশ্বব্যাঙ্কের দারিদ্ররেখার কাছাকাছি)।

Advertisement

মৈত্রীশ ঘটক

শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০২২ ০৫:১৬
Share:

দারিদ্র নিয়ে ভারতে এই মুহূর্তে প্রামাণ্য সরকারি পরিসংখ্যানের বড়ই অভাব। ফাইল চিত্র।

দারিদ্র নিয়ে ভারতে এই মুহূর্তে প্রামাণ্য সরকারি পরিসংখ্যানের বড়ই অভাব। তাই গত এক দশকে জনসংখ্যার কত শতাংশ দারিদ্ররেখার তলায় আছেন, তা নিয়ে এই মুহূর্তে কোনও নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। অতএব, সাম্প্রতিক কালে ভারতে দারিদ্র বেড়েছে না কমেছে, বলা খুব কঠিন।

Advertisement

গত শতকের পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় ভারতে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের নেতৃত্বে জাতীয় নমুনাভিত্তিক সমীক্ষার পত্তন হয়, যা কোনও দেশের জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান নিয়ে নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান সঙ্কলন করার পদ্ধতি হিসাবে সারা পৃথিবীতে অগ্রগণ্য মনে করা হয়। কোনও দেশে জনসাধারণের পরিসংখ্যান সংগ্রহ করার মূল সমস্যা হল, সবার সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব নয়, তাই বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে র‌্যান্ডম স্যাম্পল বা যদৃচ্ছ নমুনা সংগ্রহ করলে তবেই তার থেকে সারা দেশের একটা সম্ভাব্য চিত্র পাওয়া যায়। ১৯৫০ সালে প্রথম যে সমীক্ষা হয়, তাতে নমুনায় ছিল হাজার দুয়েক গ্রাম ও আবাসিক অঞ্চল— ক্রমে তা বেড়ে চোদ্দো হাজারে দাঁড়ায়। ১৯৫১ থেকে ২০১২ অবধি একান্নটি পর্বে এই সমীক্ষা করা হয়েছে, যা ভারতে দারিদ্র ও গড় জীবনযাত্রার মান নিয়ে যা কিছু লেখা হয়েছে, তার মূল ভিত্তি— সারা পৃথিবীতে এতটা সময় জুড়ে এমন ধারাবাহিক পরিসংখ্যান আর কোথাও নেই।

সমস্যা হল, ২০১৭-১৮ সালে জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থার (ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অর্গানাইজ়েশন বা এনএসএসও, যাকে ২০১৯ সালে সেন্ট্রাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অফিসের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অর্গানাইজ়েশন গঠিত হয়) সর্বশেষ রিপোর্টটি প্রস্তুত হওয়ার পর, সেটা প্রকাশ করা হবে না বলে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ হিসাবে পরিসংখ্যানের মান নিয়ে সংশয়ের কথা বলা হয়, কিন্তু সমীক্ষার ঠিক কোন স্তরে সমস্যা, তা না বলায় এবং সেই রিপোর্টটি প্রকাশ করে গবেষকদের সে বিষয়ে মত দেওয়ার অবকাশ না দেওয়ায় সন্দেহ থেকে যায় যে, ফলাফল সন্তোষজনক না হওয়াতেই এই পদক্ষেপ। সেই খসড়া রিপোর্টটির কপি এক সাংবাদিকের প্রয়াসে ফাঁস হয়ে গিয়ে কিছু গবেষকের হাতে আসে। তাঁদের এক জন হলেন শ্রীনিবাসন সুব্রহ্মণ্যন, যাঁর প্রাথমিক বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, ২০১১-১২’র তুলনায় দারিদ্র খানিকটা বেড়েছে শুধু নয়, সারা দেশে পারিবারিক গড় ব্যয় কমেছে— যার সঙ্গে জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হারের উজ্জ্বল ছবিটি বেমানান।

Advertisement

দারিদ্র বেড়েছে না কমেছে, দারিদ্ররেখাটি যথাযথ কি না, মূল্যবৃদ্ধির হারকে ঠিক ভাবে ধরা হচ্ছে কি না, এ সব নিয়ে বিতর্ক আগেও হয়েছে— কিন্তু পরিসংখ্যান সুলভ হওয়ায় সেই বিতর্ক থেকে প্রশ্নগুলোর উত্তর সম্বন্ধে অন্তত একটা আন্দাজ পাওয়া যেত। এখন নমুনাভিত্তিক সমীক্ষালব্ধ পরিসংখ্যানের অভাবে নানা গবেষক পরোক্ষ নানা পদ্ধতি অবলম্বন করে ভারতে দারিদ্রের চেহারাটি ধরার চেষ্টা করছেন, কিন্তু নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখলে এ নিয়ে কোনও নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা মুশকিল।

এক জনের জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম কতটা আয় প্রয়োজন, তার ভিত্তিতে দারিদ্ররেখা ধার্য করা হয়। আয়ের চেয়ে জনসংখ্যার একটা বড় অংশের ক্ষেত্রে ব্যয়ের পরিমাণ যথাযথ ভাবে ধার্য করা সোজা— কারণ, অনেকেরই আয়ের নিশ্চয়তা বা বাঁধা ধরন নেই। তাই জাতীয় সমীক্ষা থেকে ব্যয়ের পরিসংখ্যান সংগ্রহ করা হয়। এর থেকে দারিদ্র পরিমাপ করার জন্য তিনটি জিনিস দরকার— সমীক্ষা থেকে পাওয়া বিভিন্ন পরিবারের ব্যয়ের বিন্যাস; দারিদ্ররেখা; এবং মূল্যবৃদ্ধির বাৎসরিক সূচক, যা না থাকলে আগের পর্বের পাওয়া হিসাবের তুলনায় দারিদ্র কতটা কমেছে বা বেড়েছে, সেই তুলনা করা যায় না।

জাতীয় নমুনা সমীক্ষার থেকে পাওয়া সর্বশেষ পরিসংখ্যান পাওয়া যায় ২০১১-১২ সালের জন্য। দারিদ্ররেখার বিভিন্ন সংজ্ঞা আছে। তেন্ডুলকর কমিটির দারিদ্ররেখার সীমা হল গ্রামাঞ্চলে মাসে মাথাপিছু ৮১৬ টাকা আর শহরাঞ্চলে ১০০০ টাকা (যা বিশ্বব্যাঙ্কের দারিদ্ররেখার কাছাকাছি)। মূল্যবৃদ্ধির হার ব্যবহার করে বর্তমান সময়ে এই সীমাগুলো দাঁড়াবে যথাক্রমে মাসে ১৩০০ টাকা আর ১৬০০ টাকার মতো। এই টাকায় এক মাস চালানোর কথা ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে, এটা দারিদ্র মাপার জন্যে খুবই রক্ষণশীল মাপকাঠি। রঙ্গরাজন কমিটি ২০১৪ সালে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে প্রস্তাব দেয় যে, এই দারিদ্ররেখার মান ২৫% মতো বাড়ানো হোক। ২০১১-১২ সালে তেন্ডুলকর কমিটির দারিদ্ররেখা অনুযায়ী ভারতে ২২% মানুষ অতিদরিদ্র বলে চিহ্নিত হবেন, আর রঙ্গরাজন কমিটির দারিদ্ররেখা অনুযায়ী এই অনুপাতটি দাঁড়াবে ৩০%। বিশ্বব্যাঙ্কের দারিদ্ররেখা ব্যবহার করলে দারিদ্রের অনুপাত দাঁড়ায় ২২.৫%।

তার পর এক দশক কেটে গেছে, কিন্তু দারিদ্র নিয়ে কোনও নতুন সরকারি পরিসংখ্যান নেই— কারণ, ২০১৭-১৮ সালের রিপোর্টটি প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মাস ছয়েক আগে প্রায় একই সময়ে আন্তৰ্জাতিক অর্থভান্ডার ও বিশ্ব ব্যাঙ্কের দু’টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়, তাতে পরোক্ষ নানা উপায় ব্যবহার করে ভারতে সাম্প্রতিক দারিদ্রের হার নিয়ে কিছু অনুমানভিত্তিক তথ্য পাওয়া যায়।

প্রথম গবেষণাপত্রটির লেখক সুরজিৎ ভল্ল (যিনি ২০১৮ সাল অবধি প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ছিলেন), করণ ভাসিন, এবং অরভিন্দ ভিরমানি। যে-হেতু পরিবারভিত্তিক সমীক্ষালব্ধ পরিসংখ্যান নেই, তাই তাঁরা জাতীয় আয়ের পরিসংখ্যান থেকে ভোগ্যদ্রব্যের উপর ব্যয়ের হিসাব থেকে গড় মাথাপিছু ব্যয় ২০১১-১২’র পরে কতটা বেড়ে থাকতে পারে, তা অনুমান করার চেষ্টা করেছেন। সবার ব্যয়, এমনকি অতিদরিদ্রদেরও ব্যয়, একই হারে বেড়েছে, এটা ধরে নিয়ে তাঁরা দেখাচ্ছেন যে, অতিমারি শুরু হওয়ার ঠিক আগে বিশ্বব্যাঙ্কের দারিদ্ররেখা অনুযায়ী দারিদ্রের হার ৩.৪% মতো দাঁড়ায়। ২০১১-১২’র ২২.৫% অনুপাতটির তুলনায় এক দশকের কম সময়ে দারিদ্র এই হারে কমলে তা সারা বিশ্বে খুবই চমকপ্রদ সাফল্যের উদাহরণ হত। কিন্তু জাতীয় স্তরে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হারের শ্লথগতির ছবির সঙ্গে এটা মেলানো মুশকিল।

আসলে এই পদ্ধতির সমস্যা অনেকগুলো। প্ৰথমত, জাতীয় আয়ের পরিসংখ্যান আর পরিবারভিত্তিক সমীক্ষা যে ভাবে সংগৃহীত হয়, তা সম্পূর্ণ আলাদা, ফলে দুই পদ্ধতি থেকে প্রাপ্ত ব্যয়ের হিসাবের গড় বৃদ্ধির হার সমান হবে, তা মনে করার কোনও কারণ নেই, ঠিক যেমন কোনও বাজারে কত বিক্রি হল, সেই হিসাব থেকে সে অঞ্চলে দরিদ্র পরিবারগুলির গড় ব্যয় অনুমান করা মুশকিল। দ্বিতীয়ত, এই সময়ে জাতীয় আয় বৃদ্ধির হারের পরিসংখ্যানে অতিরঞ্জন আছে, এই নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। তৃতীয়ত, সেই বৃদ্ধির হার যদি প্রামাণ্যও হত, বিভিন্ন আর্থিক শ্রেণির মানুষের সবার ব্যয় সেই একই হারে বেড়েছে, এমন দাবির সমর্থনে কোনও প্রমাণ নেই।

দ্বিতীয় গবেষণাপত্রটির লেখক সুতীর্থ সিংহ রায় ও রয় ভ্যান ডের ওয়াইড অন্য পথে পরিসংখ্যানের অভাবের সমস্যার মোকাবিলা করেছেন। সেন্টার ফর মনিটরিং দি ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই) ২০১৪ সালের পর থেকে বছরে একাধিক বার পরিবারভিত্তিক সমীক্ষা করে চলেছে। তাঁরা সেই বিকল্প পরিসংখ্যান ব্যবহার করে দেখাচ্ছেন যে, চরম দারিদ্র কমলেও অতিমারির ঠিক আগে ভারতের অন্তত ১০% মানুষ বিশ্ব ব্যাঙ্কের দারিদ্ররেখার নীচে ছিলেন। তবে এই পদ্ধতিরও সমস্যা আছে— ২০১১-১২ সালের জাতীয় নমুনা সংস্থার আর সিএমআইই-র নমুনা পদ্ধতির মধ্যে অনেক ফারাক, এবং একাধিক বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে, সিএমআইই-র সমীক্ষা যে ভাবে করা হয়, তাতে অতিদরিদ্র শ্রেণির একটা উল্লেখযোগ্য অংশ তার আওতায় আসে না। ফলে, এই গবেষণাপত্রেও দারিদ্রের হার যতটা কমেছে বলা হচ্ছে, আদৌ ততটা না-ই কমে থাকতে পারে।

সমীক্ষাভিত্তিক প্রামাণ্য পরিসংখ্যান না থাকলে যা হয়, তা কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ভাষায়, ‘বাকি যা-কিছু, সবই যে অনুমিতি’। ২০২২-২৩ সালে আবার জাতীয় নমুনা সমীক্ষার সর্বশেষ পরিসংখ্যান প্রকাশ হলে দারিদ্রের একটা ছবি পেয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ২০১১ সালের পরে দশ বছর পেরিয়ে গিয়েছে, তাও ২০২১-এর জনসুমারির পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়নি, তাই খুব বেশি আশাবাদী হওয়া মুশকিল। দারিদ্র নিয়ে এই যে বিতর্ক, তার পিছনে অন্য এক দারিদ্র বড়ই প্রকট— সরকারি পরিসংখ্যানের দারিদ্র। সেই সমস্যা আগের জমানা থেকে নিশ্চিত ভাবেই বেড়েছে।

অর্থনীতি বিভাগ, লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন