বসন্তের উৎসবে, আবিরে রঙিন আকাশে শোক আর মৃত্যু
Chicken Pox

দুঃসহের মধ্যেও এত রং

বসন্ত মানে টিকা নেওয়া, মেথির জল খাওয়া, গায়ে নিমের পাতা বুলানো এবং সাময়িক নির্বাসন। বিচ্ছিন্নবাস শুরু তো বসন্তেই।

Advertisement

ঈশানী দত্ত রায়

শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০২৩ ০৪:৫৭
Share:

এটা বসন্তেরই দৃশ্য। প্রতীকী ছবি।

রোদ্দুরের মধ্যে একটা ছোট্ট মাঠ পেরিয়ে আসছেন এক মহিলা। কাঁধে ব্যাগ। ওই মাঠেরই এক ধারে একটা একতলা বাড়ির জানলায় বসে রয়েছে তাঁর বালিকা–কন্যা। মায়ের পথ চেয়ে। অপেক্ষা। —এটা কি বসন্তের কোনও দৃশ্য হতে পারে?

Advertisement

এটা বসন্তেরই দৃশ্য।

বালিকার জলবসন্ত। তাই মা তাকে নিয়ে সদ্য নির্মিত একটি ঘরে বন্দি। মেয়ে কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর গিয়েছিলেন কর্মক্ষেত্রে। দরজার দূরে দাঁড়িয়ে বড় কন্যা, সেও বালিকা, রোজ দেখে যায় মাকে এবং মশারি-ঘরে থাকা বোনকে। বসন্তে বিরহী বালিকাকে সেই ঘরের কাছ থেকে সরিয়ে রাখাই দায়।

Advertisement

বসন্ত মানে টিকা নেওয়া, মেথির জল খাওয়া, গায়ে নিমের পাতা বুলানো এবং সাময়িক নির্বাসন। বিচ্ছিন্নবাস শুরু তো বসন্তেই। করোনা তো উত্তরসূরি বিচ্ছিন্নবাসের। সেই বিচ্ছিন্নবাসে মাকে একা পাওয়া যায়, বসে থাকা যায় জানলার তাকে, মাঠের দিকে তাকিয়ে, অনন্ত অপেক্ষার সেই তো অনুশীলন।

বালিকা তখনও বসন্ত-উৎসব দেখেনি। সে জানে, দোল মানে, দুই বোনে আবির খেলা, বালতির জলে আবির গুলে গায়ে ঢালা, পাড়ার দঙ্গল রাস্তায় তখনও বেরোয়, রাস্তার লোক দাঁড় করিয়ে পিচকিরি তাক করে শিশুরা। তার দিদিমা, সরু পাড়ের সাদা খোলের শাড়ি, আবিরের মধ্যে মেশান সুগন্ধি। এক পূর্ণিমার রাতে স্বামী এবং তার বছরখানেকের মধ্যে শিশুপুত্রকে হারানো সেই মহিলাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত, শিশুকন্যা এবং ঈশ্বর।

সাদার মধ্যে যে কত গোপন রং থাকে! মৃত্যুর গন্ধ নিয়ে বেড়ে ওঠে যে বসন্ত, সে গায় ‘কবে, তৃষিত এ মরু, ছাড়িয়া যাইব তোমারি রসাল নন্দনে।’ মথুরা, বৃন্দাবনে সাদা রং পরিহিতাদের গায়ে লাগে প্রাতিষ্ঠানিক দোলের রং, আবির খেলে ফোকলা দাঁত, হয়তো এই প্রথম, কিন্তু বসন্ত উদোম করে দেয়, সে কত একা, তোমার গায়ে রঙিন শাড়ি ওঠেনি, এক দিনের জন্য রং ধরেছে শুধু।

‘হোলি হ্যায়’ বলা উচ্ছল কিশোরীকে তাই সাদা রং পরাতেই হয়, যাতে পর্দার বাকি রঙের মধ্যে তাকে আলাদা দেখায়, দুঃখ গাঢ় হয় বসন্তের দিনে। জলবসন্ত হওয়া বালিকা বড় হয়ে দেখে ‘নায়ক’কে, সেই মুখ, যাতে বসন্তের দাগ আছে, কিন্তু মেকআপ নেই। দাগ আছে, তাই এত নিখাদ এবং সুন্দর। এবং একা।একা চাঁদেরও কলঙ্ক আছে পারু!

চাঁদ যা অস‌ংখ্য বসন্তের দাগে পরিপূর্ণ, বাস্তব যাকে বলে পাহাড়। চাঁদের পাহাড়, খন্দ, গর্ত। সেখানে একটি পদচিহ্ন মানবসভ্যতার বিরাট উল্লম্ফন, মুখস্থ করতে করতে কে জানত, জলবসন্ত হওয়া বালিকা ৫০ পেরিয়ে দেখবে, জলবসন্তেই মারা যাচ্ছে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ।

বসন্ত বলে কি মৃত্যু থেমে থাকবে? সে বড় ভয়ঙ্কর। সংক্রমণ আক্রান্ত করে শিশুকে।

চারিদিকে শিমুল, পলাশ, রৌদ্রপলাশ অফুরান, শিশুর দেহ নিয়ে বাবা হাঁটে, মায়ের মাথায় হাত রাখেন এক বৃদ্ধ, বাবা বা শ্বশুরমশাই। এত শোক, এত দুঃসহের মধ্যে মানায় এত রং!

শিশুর মুখে অক্সিজেন মাস্ক, বাবা তাকে নিয়ে ছোটেন হাসপাতাল চত্বরে, পাশে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে কাকা হয়তো বা, বা পাড়ার কাকু। শিশু কাঁদে। এই ছবি কি মানায় এত রঙিন আকাশে? কে তোমাকে ছাপতে বলেছে মৃত্যু, কে তোমাকে ছাপতে বলেছে আগুন, কে তোমাকে ছাপতে বলেছে কান্না?

তুমি নিয়ে এসো, ফুল, তুমি নিয়ে এসো পাখি, তুমি নিয়ে এসো নীল দিগন্তে ফুলের আগুন, তুমি কি জানো না, মৃত্যুই পৃথিবীর একমাত্র সত্য। সত্য এবং স্বাভাবিক। মৃত্যুর পর পরিজন কাঁদে, স্বাভাবিক। তুমি কি জানো না, এক দিন, শুধু এক দিন সমগ্র পৃথিবী সেই শোকের শরিক হয়, তারপর?

বসন্ত উৎসব।

সে-ই সত্য। তারপর এক দিন রোদ্দুরের মধ্যে বালিকার পাড়ার সেই ছোট্ট মাঠ ক্রমশ মহাপ্রস্থানের পথ হয়ে গ্রাস করে। একা, নিঃসঙ্গ হয়ে হেঁটে চল এবং এক সময় ঝরে পড় একে একে।আর যে যাবে শেষ পর্যন্ত, সে স্বর্গ পেতে পারে, সে জ্ঞানী কিন্তু সে সর্বহারা। নিজেকে ছাড়া আর তার কেউ নেই।

‘শীতরাত্রির প্রার্থনা’য় বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, ‘সেই প্রথম দিনে কে হাত রেখেছিলো তোমার হাতে, আজও তো মনে পড়ে তোমার, যাতে মনে পড়ে, ভুলতে না পারো, তাই অনেক ভুলতে হবে তোমাকে, যাতে পথ চলতে ভয় না পাও, ফেলে দিতে হবে অনেক জঞ্জাল, সাবধানের ভার, হ’তে হবে রিক্ত, হারাতে হবে যা-কিছু তোমার চেনা, যাতে পথের বাঁকে বাঁকে পুরোনোকে চিনতে পারো, নতুন ক’রে।’ একে কি তুমি বসন্ত বলবে আর?

বলবে, যদি পড়ে যাও কবির কথা ওই কবিতায়,

‘ডুবতে হবে মৃত্যুর তিমিরে, নয়তো কেমন ক’রে ফিরে আসবে আলোয়?

লুপ্ত হ’তে হবে পাতালে, নয়তো কেমন ক’রে ফিরে আসবে আলোয়?’

মহাপ্রস্থানের পথ তাই বসন্তের পথ।

তাই যাও এবং বসন্তে নির্বাসন নাও। মৃত্যুভয়, মৃত্যুশোক পলাশের পাপড়ি হয়ে পথের ধারের গাছ পূর্ণ করেছে। এই বসন্তে।

পলাশ তো আগুন। পুড়তেই হবে।

গণেশ পাইন বলেছিলেন,‘জীবন যে নশ্বর, তা-ই শুধু নয়, একে শেষ করে দিতে হয়। নিঃশেষ হয়ে যাওয়াটাও একটা শর্ত!’

এই জীবনকে তুমি বসন্ত বলো। চিরবসন্ত।

যাও, এই কথা, এই সমস্ত কবিতা, সমস্ত ভাব-ভালবাসা বলো গিয়ে সন্তানহারা বাবা-মাকে।

বলো, বলো, প্রতি মৃত্যুই মর্মান্তিক, কিন্তু মরসুমি হাওয়ায় জ্বর-কাশি হয়।

বলো, এই হাওয়ায় যেন আতঙ্ক ছড়ায় না কেউ।

বলো, আতঙ্কের হাওয়ায় জেলা হাসপাতাল রেফার করে।

বলো, বসন্ত এসে গ্যাছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন