বছর কুড়ি আগের কথা। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী তখন রাজনাথ সিংহ। এক দিন বার্তা এল, মহেন্দ্র সিংহ টিকায়েত হাজার হাজার কৃষক নিয়ে লখনউ আসছেন। টিকায়েত এক বার লখনউতে ঢুকে পড়লে কী হবে, কেউ জানে না। তাই তাঁকে কোনও মতেই ঢুকতে দেওয়া যাবে না। শহরে ঢোকার রাস্তায় ব্যারিকেড করে দিতে হবে।
আশঙ্কা অমূলক নয়। কারণ তার আগেই পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষক নেতা টিকায়েত দিল্লির বোট ক্লাব দখল করে ফেলে রাজীব গাঁধীর সরকারকে নাকানিচোবানি খাইয়েছেন। তার পরে দু’বার লখনউতে ধর্নায় বসেছেন। এক বার লাখ দুয়েক কৃষককে সঙ্গে নিয়ে, অন্য বার মাসখানেক ধরে।
রাজনাথ পুলিশ-কর্তাদের বললেন, টিকায়েত আসুন। তাঁর সমাবেশের জন্য জায়গা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হোক। টিকায়েত হাজার হাজার কৃষক নিয়ে লখনউতে ঢুকলেন। সমাবেশ হল। কিন্তু এ বার তিনি নতুন বায়না ধরলেন। দলবল নিয়ে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে দাবি পেশ করবেন। ফের পুলিশের বড়কর্তারা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ছুটলেন। তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন ঘিরে ব্যারিকেড বসাবেন। রাজনাথ বললেন, কোনও ব্যারিকেডের দরকার নেই। টিকায়েত সকলকে নিয়ে আসুন। তিনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে কৃষকদের স্বাগত জানাবেন। কারণ, কৃষকরা ভগবানের স্বরূপ। তেমনটাই হল। টিকায়েত দলবল নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনে ঢুকে, দাবিদাওয়া জানিয়ে, চা-জল খেয়ে ঠান্ডা হয়ে বাড়ি ফিরলেন।
এ গল্প শুনিয়েছিলেন রাজনাথ নিজেই। ২০১৫-র অক্টোবরে, দিল্লিতে। প্রয়াত মহেন্দ্র সিংহ টিকায়েতের ৮০তম জন্মবার্ষিকীতে। অনুষ্ঠানে হাজির মহেন্দ্র-পুত্র রাকেশ টিকায়েতকে দেখিয়ে হাসতে হাসতে রাজনাথ বলেছিলেন, রাকেশও সে দিন বাবার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী নিবাসে ঢুকেছিলেন। ফেরার সময় মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারখানা মাথায় করে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই চেয়ার এখনও টিকায়েতদের বাড়িতে রয়েছে।
এই রাকেশ টিকায়েতকে নিয়েই অধুনা মোদী সরকার নাজেহাল। ২৬ জানুয়ারি লালকেল্লায় হাঙ্গামার পরে ব্যাকফুটে চলে যাওয়া কৃষক আন্দোলন ফের রাকেশ টিকায়েতকে ঘিরে জোরদার হয়েছে। দীর্ঘ দিনের বিবাদ ভুলে জাঠ, মুসলিম সমাজ ফের একজোট। নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ দানা বাঁধছে। নতুন করে হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষকরা দিল্লির সীমানায় জড়ো হচ্ছেন। তাঁদের ঠেকাতে দিল্লি এখন কার্যত দুর্গে পরিণত। লোহা, কংক্রিটের ব্যারিকেড, কাঁটাতার, লোহার পেরেক, জলকামান, কাঁদানে গ্যাস, লাঠি, ঢাল, বন্দুক নিয়ে হাজারে হাজারে পুলিশ, আধাসেনা।
গুপী-বাঘা থাকলে হয়তো গান ধরত, ‘সেনা দেখে লাগে ভয়!’
আসলে ভয় কার? রাজার? কিসের এত ভয়?
তার থেকেও বড় প্রশ্ন, রাজনৈতিক বিরোধীদের কাবু করতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী নরেন্দ্র মোদী সরকার কি রাস্তার বিক্ষোভ সামলাতে জানে না?
গত ছ’বছরের ট্র্যাক-রেকর্ড ঘাঁটলে দেখা যাবে, কেন্দ্রের সরকার বিক্ষোভের মোকাবিলায় একটাই অস্ত্র প্রয়োগ করে। যেন তেন প্রকারেণ আন্দোলনকারীদের ‘দেশদ্রোহী’ তকমা দেওয়া। কাশ্মীরের মানুষ রাস্তায় নামলে বরাবরই তার পিছনে পাকিস্তান বা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের হাত রয়েছে বলা হয়। বর্তমান সরকারের জমানায় হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়েও একই কৌশল নেওয়া হয়েছে। সর্বত্র ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’-এর সন্ধান মিলেছে। ৩৭০ রদ, সিএএ-এনআরসি’র বিরুদ্ধে আন্দোলনেও একই হাতিয়ার। বিপত্তি হল কৃষকদের বিরুদ্ধেও একই কৌশল নিতে গিয়ে।
তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে শিখ ও জাঠরা দিল্লির সীমানায় চলে আসার পরে পিছনে খালিস্তানি সংগঠনের হাত রয়েছে বলতে বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা দেরি করেননি। মাঝে মাঝে শহুরে নকশাল, পাকিস্তানের মদতের অভিযোগও উঠেছে। আবার এই ‘খালিস্তানি মদতে পুষ্ট’ কৃষক নেতাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা দফায় দফায় বৈঠকে বসেছেন। তাঁদের অনেক দাবি মেনে নিতে রাজি হয়েছেন। এমনকি তিন কৃষি আইন দেড় বছরের জন্য শিকেয় তুলে রাখতেও সায় দিয়েছেন।
মুশকিল হল, দেশদ্রোহী, খালিস্তানি, শহুরে নকশাল বলে তকমা দিতে হলে একটা মুখ লাগে। জেএনইউ-তে নাহয় কানহাইয়া কুমার, উমর খালিদদের ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ বলা হয়েছিল। লাখো কৃষকের মধ্যে থেকে কাকে খালিস্তানি বলা হবে? কোথায় দেশবিরোধী শক্তি-র খোঁজ মিলবে?
প্রধানমন্ত্রী প্রথম থেকেই অভিযোগ তুলছেন, কৃষক আন্দোলনের পিছনে বিরোধীরা রয়েছেন। লালকেল্লায় হাঙ্গামার পরের দিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর বিজেপির মঞ্চ থেকে অভিযোগ তোলেন, রাহুল গাঁধী কৃষকদের উস্কানি দিচ্ছেন। দেশে অস্থিরতা তৈরিরও চেষ্টা করছেন। শুনে কংগ্রেস নেতারাও অবাক। উত্তরপ্রদেশের অমেঠীতে হেরে যাওয়া রাহুলের কথায় সে রাজ্যের কৃষকরা গাজ়িপুরে এসে জড়ো হচ্ছেন?
বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা বলবেন, সরকারের মন্ত্রীরা কি কৃষকদের সঙ্গে আলোচনায় বসেননি? কৃষক নেতাদের অধিকাংশ দাবি কি সরকার মেনে নিতে রাজি হয়নি? খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কি কৃষক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেননি?
তাতে ভুল নেই। সমস্যা হল, অনেক দাবি মেনে নিয়েও মোদী সরকারের মন্ত্রীরা কৃষকদের বিক্ষোভ তুলে নিতে রাজি করাতে পারেননি। সরকারের হয়ে যাঁরা আলোচনায় বসছেন, তাঁদের কথায় কৃষক নেতাদের আস্থা রয়েছে কি না, সেটাও ভাবা দরকার। কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিংহ তোমর মোদী সরকারের তেমন ওজনদার নেতা বলে পরিচিত নন। সরকারের আর এক প্রতিনিধি শিল্প-বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়াল। দীর্ঘ দিন বিজেপির কোষাধ্যক্ষ থাকা ও মুম্বইয়ের বাসিন্দা হওয়ার সুবাদে তাঁর সঙ্গে শিল্পপতিদের ঘনিষ্ঠতা অস্বাভাবিক নয়। দুই মন্ত্রী সব দাবি মেনে নিয়েও কৃষক নেতাদের একটাই কথা বলেছেন— কৃষি আইন প্রত্যাহার করা যাবে না, এর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সম্মান জড়িত। কারণ প্রধানমন্ত্রী নিজে বহু বার কৃষি আইনের পক্ষে সওয়াল করেছেন। যে কারণে সুপ্রিম কোর্টও প্রশ্ন তুলেছে, এর মধ্যে এত সম্মানের প্রশ্ন কোথা থেকে আসে?
বিহারের সুশীল মোদীর মতো অনেক বিজেপি নেতাই মনে করছেন, রাজনাথ সিংহ বা প্রয়াত অরুণ জেটলি সামনে থাকলে কৃষক নেতাদের বুঝিয়ে ফেলা যেত। হয়তো তাঁরা তিন কৃষি আইন পাশে সরিয়ে রেখে কৃষকদের সঙ্গে এমনিই কথাবার্তা বলতেন। হাত জড়িয়ে ধরতেন। ব্যক্তিগত স্তরে মধুর সম্পর্ক তৈরি করে ফেলতেন। যেমন ভাবে রাজনীতিকরা আন্দোলনকারীদের মন জয়ের চেষ্টা করেন। দাবিদাওয়া নিয়ে দর কষাকষি তো পরে হয়।
আবার রাস্তার বিক্ষোভ সামলানোর একমাত্র উপায় আন্দোলনকারীদের সব দাবি হাসি মুখে মেনে নেওয়াও নয়। অণ্ণা হজারে লোকপালের দাবিতে দিল্লিতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরুর পরে মনমোহন সরকার মন্ত্রী ও আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধিদের নিয়ে যৌথ কমিটি তৈরি করে। তাতে প্রণব মুখোপাধ্যায় থাকতে রাজি হননি। কারণ প্রণববাবু মনে করতেন, লোকপাল দুর্নীতির সমাধান নয়। কিন্তু সনিয়া গাঁধী চেয়েছিলেন, প্রণব কমিটিতে থাকুন। তিনি প্রয়োজনে মেজাজ চড়িয়ে আন্দোলনকারীদের দাবিয়ে রাখতে পারবেন।
অণ্ণা হজারের পিছনে কেউ নিয়ম করে খালিস্তানি, শহুরে নকশাল, পাকিস্তান বা বিজেপি-আরএসএসের হাত খোঁজেনি। রাজনাথ সিংহও টিকায়েতকে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনে স্বাগত জানানোর আগে তাঁর পিছনে নকশাল বা পাকিস্তানের মদত রয়েছে বলে অভিযোগ তোলেননি। বা, কৃষক আন্দোলনকারীদের রুখতে পুলিশ-আধাসেনা নামিয়ে দেননি। তিনি জানতেন, দেশের কৃষকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কোনও লাভ হয় না।
দিল্লির সীমানায় গুপী-বাঘা হাজির হলে নিশ্চয়ই গান ধরত, ‘তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল!’