Racial Discrimination

দলিত, তাই ওরা আত্মঘাতী?

গত বছর জুলাই মাসে দিল্লির এমস সম্পর্কে সংসদীয় কমিটির একটি প্রতিবেদন দেখিয়েছে, পরীক্ষার ফল থেকে শিক্ষকপদে নিয়োগ, সর্বত্র দলিত-জনজাতিদের প্রতি বৈষম্য কাজ করে চলেছে এই প্রতিষ্ঠানে।

Advertisement

নরেন্দ্রনাথ আইচ

শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০২৩ ০৫:৩১
Share:

পরিবার জানিয়েছে, মৃত্যুর আগের মাসে বাড়ি এসেছিল দর্শন। প্রতীকী ছবি।

চুনী কোটাল, রোহিত ভেমুলার স্মৃতি ফিরিয়ে আনল বম্বে আইআইটি-র আঠারো বছরের ছাত্র দর্শন সোলাঙ্কির আত্মহত্যা। ১২ ফেব্রুয়ারি হস্টেলের সাততলার ঘর থেকে ঝাঁপ দিয়েছিল দর্শন। পরিবারের অভিযোগ, ক্যাম্পাসে জাতিগত বৈষম্যের মুখোমুখি হওয়ার গ্লানিতেই সে এই পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। যদিও বম্বে আইআইটি-র অভ্যন্তরীণ কমিটির রিপোর্ট বলেছে, পরীক্ষায় খারাপ ফলই দর্শনের আত্মহত্যার প্রধান কারণ। জাতির ভিত্তিতে বৈষম্য বা হেনস্থার প্রমাণ তাঁরা প্রাথমিক ভাবে পাননি। কমিটির এগারো জন সদস্যের সাত জনই ছিলেন অধ্যাপক— পরীক্ষার ফলই যে তাঁদের কাছে গুরুত্ব পাবে, তা হয়তো আশ্চর্য নয়। তবু প্রশ্ন রয়েই যায়: মাত্র তিন মাস আগে ভর্তি হওয়া এক ছাত্র একটা সিমেস্টার-এ একটি বিষয়ের ফল খারাপ হওয়াতেই এমন চরম পদক্ষেপ করল কেন? আমদাবাদ থেকে মুম্বইতে পড়তে আসা ছেলেটির মানসিক অবস্থা কেমন ছিল?

Advertisement

পরিবার জানিয়েছে, মৃত্যুর আগের মাসে বাড়ি এসেছিল দর্শন। তখন সে বলেছিল, তার সহপাঠীরা যখন জানতে পারে সে তফসিলি জাতির ছাত্র, তখন থেকেই তাদের আচরণ বদলে যায়। অবৈতনিক শিক্ষার যে সুযোগ সে পেয়েছিল, সেটাও হয়ে ওঠে বিদ্রুপ ও আক্রোশের বিষয়। বার বার অপদস্থ হওয়ার জন্য মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে ছিল দর্শন।

কী ছিল দর্শনের মৃত্যুর কারণ, তা নিয়ে অনুসন্ধান চলছে। কিন্তু বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার উদ্বেগজনক। ডিসেম্বর ২০২১-এ কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান সংসদে জানিয়েছিলেন, তার আগের সাত বছরে দেশের বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১২২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এঁদের মধ্যে সর্বাধিক বিভিন্ন কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে (৩৭), তার পর আইআইটিগুলিতে (৩৪)। সংখ্যার নিরিখে সবচেয়ে বেশি ওবিসি (৪১) এবং দলিত (২৪) ছাত্রছাত্রীরা। রোহিত ভেমুলা বা পায়েল তাড়ভির আত্মহত্যা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না।

Advertisement

গত বছর জুলাই মাসে দিল্লির এমস সম্পর্কে সংসদীয় কমিটির একটি প্রতিবেদন দেখিয়েছে, পরীক্ষার ফল থেকে শিক্ষকপদে নিয়োগ, সর্বত্র দলিত-জনজাতিদের প্রতি বৈষম্য কাজ করে চলেছে এই প্রতিষ্ঠানে। থিয়োরি পেপারে পাশ করার পরেও প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষায় ফেল করানো হচ্ছে তাদের, শিক্ষকদের নানা পদ শূন্য থাকলেও যথেষ্ট যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দলিত-জনজাতি আবেদনকারীদের মধ্যে থেকে কাউকে নেওয়া হচ্ছে না ‘যোগ্যতার অভাব’ দর্শিয়ে। চুক্তিতে দলিত-জনজাতিদের নেওয়া হলে, পদটি নিয়মিত হলে বাদ দেওয়া হচ্ছে। স্নাতকোত্তর স্তরে দলিত-জনজাতি ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা সংরক্ষিত আসনের চাইতে কম। ‘সুপারস্পেশালিটি’ পাঠ্যক্রমে সংরক্ষণ নেই, সেখানে একটি আসনেও দলিত-জনজাতি নেই। কেন এমন হচ্ছে? শিক্ষায় বৈষম্য, নিয়োগে বৈষম্য, অথবা অপর কোন ব্যাপকতর কারণ এমন ভয়ানক জাতি-বৈষম্য তৈরি করছে?

গত বছর অগস্টে লোকসভায় একটি প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রক জানিয়েছে, ভারতের পঁয়তাল্লিশটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র একটির উপাচার্য তফসিলি জাতি, আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জনজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত। বারো হাজার শিক্ষকপদের মধ্যে আট হাজারেরও বেশি পদে রয়েছেন বর্ণহিন্দুরা। দলিত শিক্ষকের সংখ্যা ১৩০৬, জনজাতি শিক্ষক ৫৬৮। সংরক্ষণ নীতি অনুসারে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ১০০৫ ‘প্রফেসর’ পদের পঁচাত্তরটি তফসিলি জনজাতির জন্য সংরক্ষিত, রয়েছেন ১৫ জন। আর তফসিলি জাতির জন্য ১৫১টি পদ রয়েছে, শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছেন মাত্র ৬৯টি পদে।

মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের ২০১৬-র একটি তথ্যে দেখা যাচ্ছে, দলিত শিক্ষার্থীদের প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণিতে ভর্তির হার (২০১৪-১৫) জাতীয় গড়ের থেকে বেশি ছিল। তা সত্ত্বেও উচ্চশিক্ষায় তাদের ভর্তির হার (১৯.১ শতাংশ) জাতীয় গড়ের নীচে (২৪.৩ শতাংশ)। দারিদ্র ও জাতিগত বৈষম্যের জোড়া ফলা সামাজিক প্রগতিকে টেনে রাখছে। দিনমজুরি, খেতমজুরিতে নিযুক্তির হার যেখানে সারা দেশের গড় চব্বিশ শতাংশ, সেখানে দলিত ও জনজাতিদের মধ্যে এই হার যথাক্রমে চল্লিশ শতাংশ ও ছত্রিশ শতাংশ। দলিত ও জনজাতিদের বিরুদ্ধে ঘটা অপরাধগুলো নথিভুক্ত হওয়ার পরেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশি তদন্ত অসম্পূর্ণ থাকে। দলিতদের ক্ষেত্রে অর্ধেক, ও জনজাতিদের ক্ষেত্রে তিনটিতে একটি মামলা আদালতে বিচারাধীন পড়ে থাকে। অর্থাৎ সমাজ কেবল জন্মপরিচয়ের জন্য যে নিপীড়ন করছে, প্রাতিষ্ঠানিক উপায়ে তার প্রতিকার পাওয়ার আশা সামান্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পুলিশ, আদালত, কোথাও দলিত তরুণ-তরুণীরা নিজের অধিকার বা মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে না, বরং অনবরত শিক্ষাক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে তাদের ‘অনধিকার প্রবেশ’-এর তত্ত্বে বিদ্ধ হতে থাকে।

অম্বেডকর বলেছিলেন শিক্ষা হল বাঘের দুধ, যে খাবে সে গর্জন করবে। দেশের সংবিধান, আইনকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দলিত-জনজাতিদের সেই ‘জ্ঞানাঞ্জন শলাকা’-র স্পর্শ থেকে দূরে রাখার এক ধরনের কাঠামোগত সন্ত্রাস ঘটেই চলেছে। এক এক জন রোহিত, পায়েল বা দর্শনের মৃত্যু সেই নগ্ন বাস্তবকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন