কর্নাটকে ভোট এবং ধর্মীয় মেরুকরণের তাড়া
Bajrang Dal

উগ্রতার শরণাপন্ন

মূল অভিযুক্ত পুনীত কেরেহাল্লি সেই বজরং দলের সক্রিয় নেতা। গত বছর জুলাইতে কর্নাটকেরই মেঙ্গালুরুতে ১৯ বছরের মাসুদকে গণধোলাই দেওয়া হয়।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১১ মে ২০২৩ ০৪:৩১
Share:

অসহিষ্ণু: কর্নাটকে কংগ্রেসের ভোট-ইস্তাহারের বিরুদ্ধে বজরং দলের কর্মীদের ক্ষোভ প্রদর্শন, দেহরাদুন, ৪ মে। ছবি: পিটিআই।

মনু মানেসর ওরফে মোহিত যাদব হরিয়ানার মানেসরে বজরং দলের জেলা সভাপতি। ফেসবুকে তাঁর অনুগামীর সংখ্যা প্রায় ৮৩ হাজার। ইউটিউবে তাঁর ভক্ত ২ লক্ষের বেশি। মনু ও তাঁর দলবল কী ভাবে গাড়ি-বাইকে চেপে হাইওয়েতে গরু পাচারকারীদের তাড়া করে, কী ভাবে তাঁদের পথ আটকে গরু উদ্ধার করে, তার অসংখ্য রোমহর্ষক দৃশ্য সেই ইউটিউব চ্যানেলে দেখা যায়।

Advertisement

এই পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। তিন মাস আগে হরিয়ানার ভিওয়ানিতে একটি পোড়া গাড়ির ভিতর থেকে দু’টি দগ্ধ দেহ উদ্ধার হয়। পুলিশের তদন্তে জানা গেল, পোড়া মৃতদেহ দু’টি ২৫ বছরের নাসির ও ৩৫ বছরের জুনেইদের। বাড়ি রাজস্থানের ভরতপুরে। গরু পাচারকারী সন্দেহে তাঁদের আটক করে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। তার পরে তাঁদের গাড়িতেই মৃতদেহ চাপিয়ে ২০০ কিলোমিটার দূরে ভিওয়ানিতে নিয়ে গিয়ে গাড়িসুদ্ধ আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। খুনের মামলায় মনু মানেসরের নাম প্রধান অভিযুক্ত হিসাবে উঠে আসে।

হরিয়ানার এই ঘটনা ওড়িশায় খ্রিস্টান মিশনারি গ্রাহাম স্টেনস ও তাঁর দুই শিশুপুত্রকে পুড়িয়ে মারার স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছিল। সেই ঘটনাতেও প্রধান অভিযুক্ত ছিলেন বজরং দলের নেতা দারা সিংহ।

Advertisement

গত মাসে বেঙ্গালুরু থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে সাথানুর থানার কাছে ৩৫ বছরের ইদ্রিস পাশার মৃতদেহ উদ্ধার হয়। ইদ্রিসকেও গরু পাচারকারী সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়েছিল। মূল অভিযুক্ত পুনীত কেরেহাল্লি সেই বজরং দলের সক্রিয় নেতা। গত বছর জুলাইতে কর্নাটকেরই মেঙ্গালুরুতে ১৯ বছরের মাসুদকে গণধোলাই দেওয়া হয়। দু’দিন পরে প্রাণ হারানো মাসুদের দোষ ছিল, সে একটি বাছুর কিনেছিল পুষবে বলে। ধৃত আট জনের সকলেই গলায় গেরুয়া চাদর ঝোলানো বজরং দলের নেতা। কেউ গোরক্ষা প্রমুখ, কেউ সুরক্ষা প্রমুখ।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অবশ্য এ ভাবে গোরক্ষার নামে কারও নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়াটা পছন্দ করেন না। তিনি অনেক দিন আগেই বলে দিয়েছিলেন, হিংসা কোনও সমস্যার সমাধান নয়। কেন্দ্রে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রাজ্যে রাজ্যে হঠাৎ গোরক্ষক বাহিনীর তাণ্ডব শুরু হলেও প্রধানমন্ত্রী এ সব নিয়ে নীরব ছিলেন। বছর ছয়েক আগে আমদাবাদে এক অনুষ্ঠানে তিনি আচমকাই জোর গলায় বলেছিলেন, গোরক্ষার নামে কারও হত্যা সঠিক নয়। আইন আইনের কাজ করবে। নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার অধিকার কারও নেই। গোরক্ষা, গোভক্তির আদর্শ উদাহরণ হিসাবে সে দিন মহাত্মা গান্ধী, বিনোবা ভাবেকেও স্মরণ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী।

তার পরে অবশ্য ছ’বছর কেটে গিয়েছে। বজরং দলের নেতারা হয়তো প্রধানমন্ত্রীর কথা ভুলে গিয়েছেন! প্রধানমন্ত্রীও বোধ হয় তার জন্য অভিমান করেননি! আর তাই কর্নাটকে কংগ্রেস নির্বাচনী ইস্তাহারে বজরং দলকে নিষিদ্ধ করার কথা বলতেই নরেন্দ্র মোদী বজরং দলের রক্ষাকর্তা হিসাবে মাঠে নেমে পড়েছেন। একের পর এক জনসভায় ‘জয় বজরংবলী’ বলে হনুমানের জয়ধ্বনি দিয়েছেন। হনুমান-ভক্ত বজরং দলকে নিষিদ্ধ করার কথা বলে কংগ্রেস রামলালার পরে হনুমানকেই অপমান করেছে বলে অভিযোগ তুলেছেন। এবং বিজেপিকে ভোট দিলেই যে এই ‘অপমানের জবাব’ দেওয়া যাবে, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন।

কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদীর সরকার গত ন’বছর ধরে কাজ করছে। কর্নাটকে গত চার বছর ধরে বিজেপি সরকার কাজ করছে। প্রশ্ন হল, উন্নয়নের ‘ডাবল এঞ্জিন’ থাকা সত্ত্বেও ভোট চাইতে নরেন্দ্র মোদীর বজরংবলীর শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন পড়ল কেন? যে আরএসএস-এর আঁতুড়ঘর থেকে প্রচারক হিসাবে নরেন্দ্র মোদীর উত্থান, সেই আরএসএস-কে বজরং দলের পিতা না বলে পিতামহ বলা চলে। রামমন্দির আন্দোলনে তাজা রক্ত আমদানির জন্য বিশ্ব হিন্দু পরিষদ তার যুব সংগঠন হিসাবে বজরং দল তৈরি করেছিল। নেতৃত্বের ভার দেওয়া হয় আরএসএস প্রচারক ও অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের পুরনো নেতা বিনয় কাটিয়ারকে। বজরং দলের উত্থান তাই রামমন্দির আন্দোলনের জোয়ারে ভর করেই। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ করসেবকের ডাক দিয়েছে। জনসমক্ষে বজরং দীক্ষা অনুষ্ঠান করে রামমন্দির আন্দোলনের বাহিনী তৈরির কাজও শুরু হয়েছে। হাতে ত্রিশূল, তরোয়াল হাতে বজরং দলের তরুণ বাহিনী রামমন্দির তৈরির শিলা হাতে যাত্রা শুরু করেছে। সাধারণত গরিব বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে উঠে আসা, চাকরি বা রোজগারের সুযোগ দেখতে না পেয়ে হতাশায় ভোগা তরুণরাই এ সবের প্রতি আকর্ষিত হন। বজরং দলও তার ব্যতিক্রম ছিল না। গলায় রামনাম লেখা গেরুয়া চাদর ঝুলিয়ে বজরং দল তাঁদের সামনে নতুন পরিচিতি, জীবনের উদ্দেশ্য হাজির করেছিল। বিনয় কাটিয়ার ফৈজ়াবাদ থেকে লোকসভা ভোটে জিতে সাংসদ হয়েছেন। বজরং দলের নেতা-কর্মীরাও যেন উপরে ওঠার সিঁড়ি দেখতে পেয়েছেন।রামমন্দির আন্দোলনকে রাজনৈতিক ভাবে কাজে লাগিয়ে যে বিজেপির রাজনৈতিক উত্থান সম্ভব, তা লালকৃষ্ণ আডবাণী আঁচ করতে পেরেছিলেন। সেই ভাবনা থেকেই গুজরাতের সোমনাথ থেকে অযোধ্যা পর্যন্ত রথযাত্রার সূচনা। নরেন্দ্র মোদী তখন গুজরাত বিজেপির সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। গুজরাতের সড়কের দু’পাশে মিছিল করে রথযাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব তিনিই বজরং দলকে দিয়েছিলেন। যেখানে যেখানে রথ থামবে, সেখানে জনসভায় ভিড় জড়ো করার দায়িত্বও ছিল বজরং দলের তরুণদের উপরে। উগ্র হিন্দুত্বে মজে থাকা বজরং দলের তরুণরা আডবাণীর কপালে রক্ততিলক লেপে দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানাতেন। তাঁর হাতে পেয়ালা ভর্তি রক্ত তুলে দিতেন।

লালকৃষ্ণ আডবাণী অবশ্য জানতেন, শুধু উগ্র হিন্দুত্বের প্রতীক হয়ে গোটা দেশে ভোটে জেতা সম্ভব নয়। মাড় দেওয়া ধোপদুরস্ত ধুতি-কুর্তা পরিহিত আডবাণী শহুরে উচ্চ-মধ্যবিত্তের সামনেও নিজেকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। তাই তিনিই এক সময় বজরং দলকে রক্ত ভর্তি পেয়ালা হাতে তুলে দেওয়ার প্রথা বন্ধ করার নির্দেশ দেন। দিল্লিতে রথযাত্রার সময় বজরং দলের বাহিনীর হাতে অস্ত্রশস্ত্র দেখে তিনি ধমকও দিয়েছিলেন।

রামমন্দির আন্দোলনের ফয়দা বিজেপি পুরোটাই তুলেছিল। নিষেধাজ্ঞা চেপেছিল বজরং দলের উপরে। অটলবিহারী বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী হলেন, তখন তিনি উগ্র হিন্দুত্ব ছেড়ে সুশাসনে মন দিলেন। বজরং দল প্রান্তিক সংগঠন হয়ে পড়ে রইল। একই ভাবে নরেন্দ্র মোদীও ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার আগে টের পেয়েছিলেন, উগ্র হিন্দুত্বের ভরসায় গোটা দেশের মন জেতা সম্ভব নয়। তাই হিন্দুত্বের বদলে প্রধানমন্ত্রীর গদিতে পৌঁছতে উন্নয়ন, নিজের সুশাসক ও শিল্প-বন্ধু ভাবমূর্তিকে কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি।

বজরং দলের অস্তিত্ব অবশ্য মুছে যায়নি। ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে হামলা থেকে হিজাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, হালাল মাংস নিয়ে হাঙ্গামা থেকে গোরক্ষক বাহিনীর নামে তাণ্ডব, বজরং দল নিজের কাজ করে গিয়েছে। প্রয়োজনে বিজেপি নেতারাই বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতাদের বজরং দলের উপরে রাশ টানতে বলেছেন। নরেন্দ্র মোদী যেমন গোরক্ষার নামে আইন তুলে নিতে মানা করেছিলেন। তাতে কিছুই থেমে যায়নি। বিজেপি-শাসিত রাজ্যে বজরং দলের সংগঠন ফুলে ফেঁপে উঠেছে। প্রতি সপ্তাহে বজরং দলের বলোপাসনা কেন্দ্র বা কুস্তি শেখার আখড়ায় ভিড় জমেছে। হরিয়ানার মতো যে সব রাজ্য বেকারত্বের হারে শীর্ষে, সেখানে বজরং দলের রমরমা আরও বেড়েছে। ধর্মীয় মেরুকরণের প্রয়োজনে সেই বজরং দলকেই আবার মাঠে নামানো হয়েছে।

কর্নাটকের ভোটপ্রচারে নরেন্দ্র মোদীর ‘জয় বজরংবলী’ বলে জয়ধ্বনি এক প্রকার বৃত্ত সম্পূর্ণ হওয়া। অতীতে তিনিই আডবাণীর রথযাত্রার আয়োজনে বজরং দলকে কাজে লাগিয়েছিলেন। আগামী বছর লোকসভা নির্বাচনের আগে নিজের বিজয়রথের যাত্রা অব্যাহত রাখতে মোদী কর্নাটকে ফের সেই বজরং দলকেই স্মরণ করলেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন