economically weak

আর্থিক ভাবে দুর্বলদের জন্য সংরক্ষণ কি সত্যিই সহায়ক হবে? না কি পুরোটাই শুধু রাজনীতি?

গণতান্ত্রিক দেশে বৈষম্য দূর করাই হল সরকারের প্রাথমিক দায়। জাতপাতের অঙ্কে তৈরি বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যেই সংরক্ষণের শুরু।

Advertisement

সুপর্ণ পাঠক

শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২২ ১৬:১৩
Share:

জাতপাতের অঙ্কে তৈরি বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যেই সংরক্ষণের শুরু। ছবি: এএফপি।

স্কুলটা যে খুব ছোট তা বলা যাবে না। প্রায় ১৮০০ ছাত্র। বাংলা মাধ্যম হয়েও সরকারি নয় এবং ছাত্রদের পড়ার খরচও আজকের হিসাবে নগণ্যই বলতে হবে। হাজার টাকার মতো। আর সেই স্কুলের এক অশিক্ষক কর্মচারী পড়েছিলেন বিরাট আতান্তরে। ছেলে জয়েন্টে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে সুযোগ পেয়েছে। পাশ করলে পরিবারের একটা সুরাহা হয়। কিন্তু তাঁর যা আয়, তা দিয়ে এই খরচ আসলে সুস্থ ভবিষ্যতের জন্য বিরাট বিনিয়োগ!

Advertisement

বিনিয়োগই বললাম। কারণ, দৈনন্দিন বাজার খরচ সামলে যে সংসারে উদ্বৃত্তের খাতায় পড়ে থাকে শূন্য, সেই সংসারে বড় হওয়া সন্তানের জন্য মা-বাবার পক্ষে এই খরচ সামলানো মানে নিত্যদিনের বাজার খরচ কমানো। কিন্তু তা কমিয়েও হিসাব মেলে না। তাই হাত পাততেই হয়! হ্যাঁ। ছেলেটি পাশ করে গিয়েছে। কিন্তু তাকে পাশ করানোর পিছনে তার বাবার বহু হিতাকাঙ্ক্ষীর অবদান রয়েছে।

আর প্রশ্নটা এখানেই। সংরক্ষণ। কিন্তু কী ভাবে এবং কাদের জন্য?

Advertisement

আর তারও আগে আরও একটা প্রশ্ন। আর্থিক ভাবে দুর্বল কারা? ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা আর্থিক ভাবে দুর্বলদের জন্য সংরক্ষণ বিলটি মেনে নেয় এবং তার পর নানান অনুমোদন প্রক্রিয়া শেষে আইন হিসাবে সেটি রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায়। সাংবিধানিক নয়, এই অভিযোগে শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হয় ইয়ুথ ফর ইকুয়ালিটি নামে একটি অসরকারি সংস্থা। যার পরিণতিতে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের একটি বেঞ্চে তিন জনের রায় আইনটির পক্ষে যাওয়ায় সংরক্ষণটি সংবিধান বিরোধী নয়, এই স্বীকৃতি পেয়ে যায়।

বছরে ৮ লক্ষ টাকার নীচে পারিবারিক আয় (সম্পত্তিও ধরা হবে এই অঙ্কে) যাদের, সেই পরিবারের সন্তানরা কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষালয়ে এবং চাকরিতে সুযোগ পাওয়ার অধিকারী হবেন এই আইনের বলে। নির্দিষ্ট কোটার ভিত্তিতে। রাজ্য সরকারগুলি এই আইন মেনে, এমনকি আয়ের সীমা নিজেদের রাজ্যের প্রয়োজন মেনে, এই সংরক্ষণের রাস্তায় হাঁটতে পারবে।

কিন্তু তাতে কি সমস্যাটি মিটবে? যে প্রশ্নটা এই সংরক্ষণ ঘিরে উঠেছে সেটা কিন্তু গভীর। গণতান্ত্রিক দেশে

বৈষম্য দূর করাই হল সরকারের প্রাথমিক দায়। জাতপাতের অঙ্কে তৈরি বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যেই সংরক্ষণের শুরু। শুধু আমাদের দেশেই নয়, গণতান্ত্রিক অন্যান্য দেশেও সংরক্ষণ এই একই যুক্তিতে মেনে নেওয়া হয়েছে। এর লক্ষ্য তো একটাই। জাত, গায়ের রং বা অন্য কোনও কারণে দেশের নাগরিকরা যেন তাঁদের অধিকার থেকে বঞ্চিত না হন। কিন্তু অধিকারই শেষ কথা নয়। সেই অধিকার ভোগ করার অধিকারও সৃষ্টি করার দায় শুধু সমাজের উপর নয়, বর্তায় সরকারের উপরও।

জাত ও পাতে বিভাজিত ভারতে নিচু বর্ণের নাগরিক উচ্চবর্ণ অধ্যুষিত শিক্ষাঙ্গনে পা রাখার সামাজিক অধিকারে বঞ্চিত ছিল। এই বঞ্চনা এখন আইনের চোখে অপরাধ। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও এবং সংরক্ষণ সত্ত্বেও আমরা কিন্তু উঁচু বর্ণের হাতে নিচু বর্ণের নাগরিকের গণধোলাইয়ের কথা সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত দেখি। অপরাধের ধরন বিচিত্র। কয়েক বছর আগে তামিলনাড়ুর গ্রামে উচ্চবর্ণ অধ্যুষিত অঞ্চল দিয়ে নিম্নবর্ণের মৃত ব্যক্তিকে দাহ করতে নিয়ে যাওয়া নিয়ে উচ্চবর্ণের উচ্চকিত আপত্তি থেকে অতি সম্প্রতি রাজস্থানে এক নিম্নবর্ণের নাগরিকের উচ্চবর্ণের গ্রামের নির্দিষ্ট অঞ্চলে জল খাওয়ার অপরাধে পিটুনি খেয়ে মৃত্যুর কথা পড়েছি।

তার মানে অবশ্যই এটা নয় যে, সংরক্ষণের কোনও ফলই স্বাধীন ভারতবর্ষের নাগরিক ভোগ করেনি বা করছে না। আজ সংরক্ষিত শ্রেণির সন্তানরা উচ্চশিক্ষা লাভ করার সুযোগ পাচ্ছে এই বঞ্চনার আবহেও। আইআইটি-র মতো প্রতিষ্ঠানে পা রাখার সুযোগ পাচ্ছে যা সংরক্ষণ না থাকলে সম্ভব হত না এই হারে। শুধু উচ্চশিক্ষা নয়, স্কুলে পড়ারই হয়ত সুযোগ থাকত আরও কম।

এই সত্য স্বীকার করে নিয়েই আমরা এগোই। প্রশ্নটা হল সুযোগ তৈরিই কি শেষ কথা? না সেই অধিকার নেওয়ার সুযোগ তৈরিটাও জরুরি? খাতায়কলমে সুযোগ থাকলেও তা তো শুধুই দেখনদারি। তাকে কার্যকর করার ভূমিটাও তো তৈরি করতে হবে!

বছরে ৮ লক্ষ টাকা মানে মাসে ৬৬ হাজার টাকা পারিবারিক রোজগার। সরকারি ভাবে স্বীকার করে নেওয়া হল যে, এই আয়ও ভারতে যথেষ্ট নয়। উন্নয়নের দাবিতে এই স্বীকারোক্তি যে আসলে উন্নয়নের দাবির অস্বীকার, তা মানতেই হবে। কিন্তু তা অন্য আলোচনা।

ফেরা যাক মূল আলোচনায়। এই সংরক্ষণের সুযোগ নেওয়ার দাবিদার হিসাবে মাসিক ৬৬ লক্ষ টাকা পারিবারিক আয়ের সন্তানকে মেনে নেওয়া হল। কিন্তু উচ্চশিক্ষার খরচ এই পরিবারগুলি কী ভাবে বহন করবে তার কোনও নির্দেশ এই সংরক্ষণের আইনে বলা আছে বলে জানা নেই।

এগিয়ে যাওয়া যাক। আমরা সবাই জানি সরকার শিক্ষা পরিকাঠামোয় টাকা না ঢেলে বেসরকারি ক্ষেত্রের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও এখন বেসরকারি বিনিয়োগের রমরমা। সরকারি প্রযুক্তি শিক্ষাকেন্দ্রেও পড়াশোনার খরচ সামলানো আর্থিক ভাবে দুর্বল শ্রেণির মানুষের পক্ষে সহজসাধ্য নয়। সরকারি কর্মসংস্থানও ক্রমাগত সঙ্কুচিত হচ্ছে।

তাই এই সংরক্ষণ ভাল না মন্দ, সে তর্ককে পাশে সরিয়ে প্রাথমিক প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতেই হবে। যে পরিবারের মাসিক আয় মাসে ৬৬ হাজার টাকার কম, সেই পরিবারের সন্তান তো একটা অধিকার পেল। কিন্তু তার প্রয়োগ সে কী ভাবে করবে? লেখার শুরুতে যাঁর কথা ছিল, তাঁর সন্তান জয়েন্ট উতরেই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ঢুকেছিল। কিন্তু ঋণের টাকা পারিবারিক রোজগারে অপরিশোধ্য বলে পরিবারকে হাত পাততে হয়েছিল।।এই আর্থিক অনুষঙ্গ ছাড়া এই সংরক্ষণ কী ভাবে এদের সহায়ক হবে সেই প্রশ্নটার উত্তর কিন্তু প্রয়োজনীয়। না কি এর পুরোটাই রাজনীতি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন