Jim Corbett

শিকার তাঁকে বিমর্ষ করেছিল

১৯৩৯-এর ১০ জানুয়ারি বাঘ আসার পথটির দিকে বন্দুকের বদলে তাক করে ছিলেন ক্যামেরা! অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। নাম‌টি আন্দাজ করে ফেলেছেন অনেকেই— জিম করবেট।

শুভাশিস চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০২৫ ০৫:৪০
Share:

গাছ থেকে পড়ে চোট পেয়েছিলেন শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোক। মুভি ক্যামেরায় বাঘের ছবি তুলবেন বলে গাছের উপর একাগ্র বসেছিলেন, তবে তাঁর হাতে বন্দুক মানায় বলেই অনেকের বিশ্বাস। কারণ তিনি নরখাদক বাঘ আর লেপার্ডদের কাছে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। চম্পাবত, কুমায়ুন, মুক্তেশ্বর, রুদ্রপ্রয়াগ, থাক, মোহানের ভয়ানক বাঘেদের চিরঘুমে পাঠিয়েছেন। পরে তাঁর‌ই কলমে সেই শিকার-কাহিনি বিশ্ব জুড়ে আলোড়ন ফেলেছে। অথচ তিনিই সেই ১৯৩৯-এর ১০ জানুয়ারি বাঘ আসার পথটির দিকে বন্দুকের বদলে তাক করে ছিলেন ক্যামেরা! অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। নাম‌টি আন্দাজ করে ফেলেছেন অনেকেই— জিম করবেট।

১৯২৮-এ ষোলো মিলিমিটারের বেল অ্যান্ড হাওয়েল ক্যামেরা তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন বন্ধু লর্ড স্ট্র্যাথকোনা। সেই থেকে মুভি ক্যামেরায় আগ্রহ জিমের। অন্য বন্ধু বিজ্ঞানী ফ্রেডেরিক ওয়াল্টার চ্যাম্পিয়ন, বন্যপ্রাণ চিত্রগ্রহণের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব— করবেট তাঁর জল-জঙ্গল-বন্যপ্রাণের ছবি তোলার নেশাটা পরম মমতায় গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৩৮-এ করবেট কালাধুঙ্গিতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘জাঙ্গল স্টুডিয়ো’, সেই বছরেই বাঘের রাজকীয় গতিবিধির সিনে-ফোটোগ্রাফি করেছিলেন। ১৯৩৩-এর এপ্রিল-মে জুড়ে প্রচুর ছবি তুলেছেন কালাধুঙ্গির নয়াগাঁও, মালধন, রামগঙ্গার অববাহিকার— প্রকৃতি, বন্যপ্রাণ, নদী, মানুষ, মাছ ধরা...! কিছু রক্ষিত ব্রিটিশ ন্যাশনাল ফিল্ম আর্কাইভে।

করবেট যখন নরখাদকদের হত্যা করে ‘দেবদূত’ হয়ে উঠছেন, সমান্তরাল সময়ে নেমেছিলেন বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায়। ‘ইউনাইটেড প্রভিনসেস ব্রাঞ্চ অব দ্য প্রিজ়ারভেশান অব দ্য ফনা অব দি এম্পায়ার সোসাইটি’র স্থানীয় সচিব ছিলেন। করবেট এবং হাসান আবিদ জাফরি ইন্ডিয়ান ওয়াইল্ড লাইফ পত্রিকা প্রকাশ করেছেন। এক‌ই সময়ে সর্বভারতীয় বন্যপ্রাণ সম্মেলন আয়োজনের বিষয়ে করবেট এবং তাঁদের সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই সম্মেলনের অভিঘাতে ১৯৩৫-এ ‘ইউপি ন্যাশনাল পার্ক ল’ প্রণীত হয়। পরের বছর যাত্রা শুরু ভারতের প্রথম জাতীয় উদ্যানের— জিমের‌ই বন্ধু গভর্নর এবং বন্যপ্রাণ-বান্ধব উইলিয়াম ম্যালকম হেইলির নামে নাম ছিল ‘হেইলি ন্যাশনাল পার্ক’; স্বাধীন ভারতে, ১৯৫৬-য়, জিমের স্মৃতিতে নামকরণ— ‘জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক’।

১৯৩২-এ রিভিউ অব দি উইক পত্রিকায় ‘ওয়াইল্ড লাইফ ইন দ্য ভিলেজ— অ্যান অ্যাপিল’ প্রবন্ধটিকে বলা যায় বন্যপ্রাণ সংরক্ষণপন্থী হিসাবে তাঁর লিখিত আত্মপ্রকাশ। ওই পত্রিকায় ১৯৩৫-এ লেখেন— ‘এ লস্ট প্যারাডাইস: ফরেস্ট ফায়ারস ইন দ্য ফুটহিলস’। সংরক্ষণের কাজে সবার আগে দরকার জনমত, মানুষকে বন্যপ্রাণ রক্ষার গুরুত্ব বোঝাতে হবে, সরকারের পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে শিক্ষিত সমাজকে— আবেদনে স্পষ্ট উন্মত্ত শিকারপ্রেমী নন করবেট। শিকারকে ‘খেলা’ হিসাবে দেখায় ছিল অসন্তোষ। মানুষের প্রাণরক্ষার্থে কর্তব্য করেছেন নিঃশব্দে, প্রচার‌ও চাননি, বরং আফসোস বিমর্ষ করেছে। অরণ্যের প্রাণীরা নিজেদের শর্তে বেঁচে থাকুক— এই বিশ্বাসকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।

১৯৪৭ পর্যন্ত ‘নিজের দেশ’ ভারতে, বাকি জীবন আফ্রিকার কেনিয়াতে, আমৃত্যু বন্যপ্রাণ-কেন্দ্রিক ব্রতপালক। ১৯৩৩-এ নৈনিতাল মিউনিসিপ্যাল বোর্ডের সদস্য হিসাবে জিম পাখি শিকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব রাখেন, এপ্রিলে এলাকায় এটি কার্যকর হয়; বোর্ড সিদ্ধান্ত নেয় পাখিদের অভয়ারণ্য তৈরি হবে। কেনিয়ায় বসবাসকালেও বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ সমিতি স্থাপন করেন। এই জিম সত্তরোর্ধ্ব, তবু কাজে অরণ্যের মতো তরুণ, সবুজপ্রাণ। কেনিয়াতে করবেট বিশ্ব-স্কাউট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা লর্ড বাডেন-পাওয়েলের বাংলোটি কিনেছিলেন। সামনে পাখিদের জন্য জলাশয় কাটিয়ে দিয়েছিলেন। পাখিরা জিমের গায়ে, মাথায় বসত, হাত থেকে রুটি, কেক খেত। এই স্বর্গীয় দৃশ্যের রূপকারকে আর পাঁচ জন অসংবেদনশীল শিকারির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা অন্যায়।

ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রকাশিত জাঙ্গল স্টোরিজ় তাঁর প্রথম ব‌ই, ছাপা হয়েছিল মাত্র একশো কপি। অনেক পরে লেখা ম্যান-ইটার্স অব কুমায়ুন প্রকাশের প্রথম দুই বছরে (বম্বে ও নিউ ইয়র্ক সংস্করণ) বিক্রি হয়েছিল ৫,৩৬,০০০ কপি। ব‌ইটির স্বত্ব জিম দান করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে ভারতীয় সৈন্যদের চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল তাঁদের চিকিৎসায়। শিকারসাহিত্যের মোড় ঘোরানো বিখ্যাত ব‌ইগুলির গ্রন্থস্বত্ব দেন সংশ্লিষ্ট প্রকাশনার কর্মীদের কল্যাণার্থে।

জন্ম ১৮৭৫-এর ২৫ জুলাই, আজকের দিনটির ঠিক দেড়শো বছর আগে। ১৯৫৫-য় মৃত্যুর আগে শেষ কথাটি দিদি ম্যাগির উদ্দেশে: পৃথিবীটাকে তোমরা অন্যদের বসবাসের জন্য আরও ভাল জায়গা করে তোলার চেষ্টা করবে, আমার আশা। ২০১০ সালে রাশিয়ায় ২৯ জুলাই তারিখটি ঘোষিত হয় ‘আন্তর্জাতিক বাঘ দিবস’ হিসাবে। পনেরো বছর হল তারও। এ দিকে বাঘ নিয়ে প্রকৃত শুভচিন্তক ও হুজুগে-ট্যুরিস্টের আদিখ্যেতার দ্বন্দ্ব সমাস চলছে এখনও, ক্রমাগত।

ব্যাঘ্র দিবসের প্রাক্কালে জিম করবেটের সেই দূরদর্শী উক্তিটি ফিরে পড়তে পারি: বাঘ হল দরাজ-কলিজা ভদ্রলোক, সীমাহীন তার সাহস। ...বাঘের সপক্ষে জনমত গড়ে না উঠলে বাঘ লোপ পাবেই, আর তা হলে ভারতের শ্রেষ্ঠতম প্রাণীর বিলোপে ভারত হবে দরিদ্রতর।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন