চিরপরিচিত কোলাপুরি চপ্পল যে হঠাৎ আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে পারে, কে জানত! দিনকয়েক আগে খবরে দেখা গেল, ইটালির এক বিশ্বখ্যাত বিলাসবহুল ফ্যাশন ব্র্যান্ড তাদের পুরুষদের ‘স্প্রিং-সামার ২০২৬’ ফ্যাশন শো-তে ‘টো রিং স্যান্ডাল’ নামে যা প্রদর্শন করল, তা হুবহু কোলাপুরি চপ্পলের মতো দেখতে। ২০১৯-এ জিআই ট্যাগপ্রাপ্ত এই চপ্পলের উৎপত্তি দ্বাদশ শতাব্দীতে, পশ্চিম মহারাষ্ট্রের কোলাপুরে। ভারতের বাজারে বড় জোর দু’হাজার টাকা দাম টি-স্ট্র্যাপযুক্ত এই চপ্পলের। ইটালির ব্র্যান্ডটি সেই চপ্পলই বিশ্ববাজারে বিক্রি করবে বহু গুণ দামে। তাতেও নাহয় আপত্তি থাকত না, কিন্তু, তারা এই চপ্পল বিক্রি করবে ভারতীয় কারিগরদের কোনও রকম কৃতিত্ব না দিয়ে; ভারতীয় সংস্কৃতির নামোল্লেখ মাত্র না করে।
এমন ঘটনা অবশ্য এই প্রথম নয়। ২০১৮ সালে এক পত্রিকার প্রচ্ছদে ফরাসি ফ্যাশন দুনিয়ার এক অতিবৃহৎ সংস্থার একটি পোশাক অভিনেত্রী সোনম কপূরকে পরে থাকতে দেখে অনেকে চমকে যান। নকশাটি যিনি বানিয়েছিলেন, অটোইমিউন ডিজ়অর্ডারে ভোগা সেই মানুষটি কয়েক দশক আগে যোগব্যায়ামের বিভিন্ন ভঙ্গিমা দিয়ে তৈরি করেছিলেন একটি পদ্মের দু’পাশে যোগাভ্যাসরত মূর্তির নকশা। সেই নকশা দিয়ে দুই দশক ধরে পোশাক বানানোর পর হঠাৎ পত্রিকার প্রচ্ছদে ওই একই মোটিফ দেখে তাঁর অবিশ্বাস্য লেগেছিল।
আর এক বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন হাউসের নতুন ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর তাঁর প্রদর্শনীতে ‘মুকাইশ’ কাজ ব্যবহার করলেন, যা বানাতে ১২ জন ভারতীয় কারিগর ৩৪ দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। সংস্থাটি তাঁদের কোনও কৃতিত্ব দেয়নি।
কী ভাবে আন্তর্জাতিক ফ্যাশন হাউসগুলো প্রায়শই প্রকৃত উৎপত্তিস্থলের কোনও উল্লেখ ছাড়াই ভারতীয় উপমহাদেশীয় শিল্পরীতিগুলিকে নতুন মোড়কে— অনেক সময় নতুন নাম দিয়ে— বিক্রি করে কোটি কোটি টাকার মুনাফা অর্জন করে, সেই অবজ্ঞা ও স্পর্ধার ইতিহাস আমাদের অজানা থেকে যায়। সুপ্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডগুলির এই অনৈতিক আচরণের কারণ অজ্ঞতা নয়। বরং উদাসীনতা। ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক ব্র্যান্ডের সঙ্গেই দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত মানুষেরা জড়িয়ে রয়েছেন। আবার বর্তমান ফ্যাশন জগতে দক্ষিণ এশীয় ডিজ়াইনারদের প্রতিনিধিত্বও অনস্বীকার্য, যাঁদের সৃষ্টি দুনিয়ার সব বিলাসপণ্যের বিপণিতে মজুত। তা হলে কেন এই উদাসীনতা?
এই নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে ঋতু কুমারের কস্টিউমস অ্যান্ড টেক্সটাইলস অব রয়্যাল ইন্ডিয়া বইটিতে। ১৯৬০-এর দশকের ভারত যখন উপনিবেশ-পরবর্তী স্থবিরতার সঙ্গে লড়ছিল, তখন শিল্পের ইতিহাস ও মিউজ়িয়োলজির ছাত্রী ঋতু কুমারের পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুরের এক দল ব্লক প্রিন্টিং বিশেষজ্ঞ কারিগরের সঙ্গে দেখা হয়। এই ব্লক প্রিন্টিং-এর এক বিশাল সংগ্রহ তত দিনে ইংল্যান্ড আত্তীকৃত করে নিয়েছে। ল্যাঙ্কাশায়ারে এই নকশাগুলির প্রতিলিপি তৈরি করে ঔপনিবেশিক ভারতে পাঠানো হত। ক্ষতিগ্রস্ত হতেন ভারতীয় হস্তশিল্পীরা। ঋতুর বই তুলে ধরে ঔপনিবেশিক শাসনে অবশিল্পায়নের পাশাপাশি ভারতীয় শিল্পরীতি আত্মসাৎ করার ইতিহাসও। শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী পর্বে ১৮৬৬ সালে প্রকাশিত জন ফোর্বস ওয়াটসনের দ্য কালেকশনস অব দ্য টেক্সটাইলস ম্যানুফ্যাকচারার্স অব ইন্ডিয়া বইটি তৎকালীন ইংল্যান্ডের উৎপাদন-সংস্থাগুলির কাছে পৌঁছে দেয় ভারতীয় বয়ন, মুদ্রণ, সূচিশিল্পের কলাকৌশলের খুঁটিনাটি— যা পক্ষান্তরে ভারতের নকশাগুলোকে বিশ্ববাজারে বিলিয়ে দিতে সাহায্য করে।
যে ব্রিটিশরা পরিকল্পিত ভাবে ভারতীয় হস্তশিল্পকে নষ্ট করেছিল, তারাই বয়নশিল্পের এই জ্ঞান নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছিল। স্কটল্যান্ডের শহর পেসলিতে ‘জ্যাকুয়ার্ড’ তাঁতে জামওয়ার শাল বোনা শুরু হয়, যা কাশ্মীরি তাঁতিদের কাজ কেড়ে নেয়। এখন ইটালির বিলাসদ্রব্য বিক্রেতার নিজস্ব ওয়েবসাইটে গেলে দেখা যায় ‘পেসলি-প্রিন্টেড’ চামড়ার ব্যাগ, ‘ক্যাশ্মিয়ের’ (কাশ্মীরি শাল) প্রভৃতি কী অস্বাভাবিক মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। ফ্রান্সের মুলহাউসে ভারতের পূর্ব উপকূল ও গাঙ্গেয় সমভূমির শিন্ৎজ ছিটকাপড়ের অনুকরণ শুরু হয়। অন্য দিকে, ভারতীয় উৎপাদকদের উপর অত্যধিক শুল্ক আরোপিত হয়। ঋতুর মতে, তখনই ভারতীয়দের এই চুরির বিরুদ্ধে প্রবল ভাবে আওয়াজ তোলা উচিত ছিল। কোলাপুরি-কাণ্ডে সমাজমাধ্যমে সাংস্কৃতিক অধিগ্রহণের তীব্র অভিযোগ সেই ফ্যাশন সংস্থাকে জুতোর ভারতীয় যোগসূত্র স্বীকার করে বিবৃতি জারি করতে বাধ্য করেছে।
ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী শিল্পঘরানার বৈচিত্র বহুবর্ণময়। স্বভাবতই তা ফ্যাশনসচেতন ক্রেতার কাছে এতটা সমাদৃত। বর্তমান যুগের ফ্যাশন সংস্কৃতি পুরনো সভ্যতাগুলির উপাদান নিয়ে নিজেদের পুনরুজ্জীবিত করে চলেছে। অনেক ভারতীয় ডিজ়াইনারও পশ্চিমি দর্শন ও সভ্যতার উপাদান নিয়ে নিজেদের পসরা সাজিয়েছেন। সে ঋণ তাঁরা স্বীকারও করেছেন। আসলে পোশাকে ব্যবহৃত নকশা, রং, বা কারুকার্য কেবলমাত্র পোশাকবিক্রেতার নিজস্ব উৎপাদন নয়, বরং তা কারিগর, শিল্পধারা, এবং আঞ্চলিক ঐতিহ্যের এক শৈল্পিক বহিঃপ্রকাশ। এই উত্তরাধিকারকে অস্বীকার করলে তা আর সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান থাকে না, হয়ে ওঠে দখলদারি।
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে