TMC

ত্রিপুরায় রাজনীতির নতুন বাঁক

মণিপুরে ২০১২ সালে শক্তিশালী বিরোধী দল হয়ে উঠেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। এখন সেখানে সংগঠনের অস্তিত্ব প্রশ্নের মুখে। অরুণাচল প্রদেশেও তথৈবচ।

Advertisement

উত্তম সাহা

শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৪:৫৫
Share:

সাল ১৯৯৯। ত্রিপুরার নির্বাচনী ইতিহাসে নাম লেখায় তৃণমূল কংগ্রেস। লোকসভা নির্বাচনে সুধীররঞ্জন মজুমদার ঘাসফুল প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। বামফ্রন্ট প্রার্থী সমর চৌধুরী নির্বাচিত হলেও দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন তৃণমূল প্রার্থী। কিন্তু পরবর্তী দেড় দশক ত্রিপুরায় ‘দিদি’-র কথা আর সে ভাবে শোনা গেল না।

Advertisement

সাল ২০১৬। ছয় কংগ্রেস বিধায়ক তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিলেন। নেতৃত্বে সুদীপ রায়বর্মন। রাজ্য জুড়ে হইহই রইরই। কিন্তু পরের বছরই সবাই একযোগে বিজেপিতে নাম লেখান।

এর পরই ২০২১। না সুধীররঞ্জনের মতো বড়মাপের কোনও নেতা সামনে এসেছেন, না সুদীপ রায়বর্মনের মতো কেউ গুচ্ছ-বিধায়ক নিয়ে দলে যোগ দিয়েছেন। এ পর্যন্ত বড় দলত্যাগী কয়েক জন। এঁদের পক্ষে তৃণমূল কংগ্রেসকে রাজ্যের ৬০ আসনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। বিজেপিই এই প্রায়-অসম্ভব কাজটিকে সম্ভব করে দিয়েছে। কংগ্রেস-টিইউজেএস আমলে এই কাজটাই করেছিলেন অতি উৎসাহীরা। বিরোধী কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেওয়ার সঙ্কল্প নিয়ে তাঁরা সাধারণ জনতাকে বামফ্রন্টের দিকেই ঠেলে দিয়েছিলেন। ১৯৮৮-৯৩ সালে যত নির্বাচন, উপনির্বাচন হয়েছে কংগ্রেস ব্যাপক ভাবে বিজয়ী হয়। কিন্তু ১৯৯৩ সালের ভোটে তাদের ৯টি আসন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। যুব সমিতি পেয়েছিল একটিমাত্র আসন। সেই যে পরাস্ত হয়, আর কংগ্রেসের পক্ষে ক্ষমতার কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব হয়নি।

Advertisement

সাধারণ মানুষ বিরোধীদের খুঁজে বেড়ান, নিজেদের মনের কথা, প্রাণের বেদনা প্রকাশের জন্য। গত তিন বছরে ত্রিপুরায় ওই জায়গায় বিরাট শূন্যতা দেখা দিয়েছিল। গত বিধানসভা ভোটে পরাজয়ের পরে সিপিএম নেতারা আক্ষরিক অর্থেই ঘর থেকে বার হননি। বহু জায়গায় দলীয় কর্মীরা মার খেয়েছেন, কেউ প্রতিরোধের কথা ভাবতে পারেননি। সেখানেই এ বার তৃণমূল কংগ্রেস মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে। কোথাও তেমন সংগঠন নেই। বিজেপির সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার মতো অবস্থা তো নয়ই। কিন্তু খোয়াই মামলা থেকে শুরু করে বিলোনিয়ায় দুই সাংসদের শারীরিক হেনস্থার অভিযোগ, আমবাসার ঘটনা এবং সব শেষে হোটেলে বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া, গাড়ির চালক-মালিকদের হুমকি, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদযাত্রায় অনুমতি না দেওয়া ইত্যাদি তৃণমূলকে ত্রিপুরায় জায়গা করে দিয়েছে। মার খেয়েও মাঠ ছেড়ে না পালানোর মানসিকতা বিজেপি-বিরোধী তরুণদের নজর কেড়েছে।

তবে এও ঠিক, তৃণমূল কংগ্রেস এখনও ঠিকঠাক বিরোধী দল হয়ে ওঠেনি। হইহল্লা করে নিজেদের অস্তিত্বের কথা জানানো আর ভরসার জায়গা তৈরি করা এক নয়। ২০২৩-এর এখনও অনেক দিন বাকি। তৃণমূলকে প্রমাণ করতে হবে, তাঁরা আন্তরিক ভাবেই চাইছেন ত্রিপুরায় সংগঠন করতে।

এটা প্রমাণ করতে পারেনি বলেই উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন রাজ্যে বিধায়ক জিতিয়ে এনেও তৃণমূল ধরে রাখতে পারেনি। অসমে ২০০১ সালে জামালুদ্দিন আহমেদ তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে বিধায়ক হন। ২০১১ সালের নির্বাচনে জেতেন দীপেন পাঠক। কাউকে দল ধরে রাখতে পারেনি। কারণ, জামালুদ্দিন বা দীপেন যে বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেখানে দলীয় নেতৃত্বের অবদান ছিল না, তাঁদের ধরে রাখার তাগিদও দলের ছিল না। একই কথা বলা চলে, মণিপুর, অরুণাচল প্রদেশের বেলায়। মণিপুরে ২০১২ সালে শক্তিশালী বিরোধী দল হয়ে উঠেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। এখন সেখানে সংগঠনের অস্তিত্ব প্রশ্নের মুখে। অরুণাচল প্রদেশেও তথৈবচ।

কিন্তু ২০২১-র তৃণমূল কংগ্রেসকে শুরু থেকেই ভিন্ন চেহারায় দেখা যাচ্ছে। কর্মী থাক বা না থাক, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ত্রিপুরায় এসে পড়ে থাকছেন। তৃণমূলকে তৃণমূলে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। কোথা থেকে নেতা আসছেন, মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন, সে সব বড় প্রশ্ন নয়। নৃপেন চক্রবর্তী, বিপ্লবকুমার দেব ত্রিপুরাতে থেকে রাজনীতি করেননি।

আবার গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিষিয়ে উঠেছিল বলেই ১৯৯৩ সালে ত্রিপুরার ভোটাররা যে ভাবে সরকার বদলে দিয়েছিল, ২০২৩-এ সে রকম আশা করা ঠিক হবে না। দু’টি সরকারের মধ্যে বিরাট পার্থক্য। ২৮ বছরে সাম্প্রদায়িক বিভাজন তীব্র হয়ে উঠেছে। ধর্মের কথা বলেই সরকার এখন কেন্দ্রে-রাজ্যে। আবেগের ভোটে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিয়ে কতটা প্রশ্ন উঠবে, তা বলা মুশকিল। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক হিংসায় তৃণমূল কংগ্রেসকে দায়ী করে বিজেপি এরই মধ্যে প্রচারে নেমেছে। একে অনেকে একেবারে ফেলে দিতে পারছেন না। এর চেয়েও বড় বিষয় তিপ্রা মথা। এ বছরই প্রদ্যোতকিশোর দেববর্মনের দলটি ত্রিপুরা জনজাতি স্বশাসিত পরিষদ দখল করেছে। ‘গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড’ কতটা বাস্তব, সে ভিন্ন বিতর্ক। কিন্তু জনজাতিদের নেতা হয়ে উঠেছেন প্রদ্যোতকিশোর। তাঁকে সঙ্গে না নিলে বিজেপিবিরোধী ভোটে বিরাট বিভাজন ঘটতে পারে। আবার তিপ্রা মথা-কে সঙ্গে নিয়ে চলারও বিপদ রয়েছে। ‘গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড’-এর কথা বলে ইতিমধ্যে এঁরা বাঙালিদের কাছে ভয়ের কারণ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির ভোট নিজেদের দিকে টানা কঠিন হবে, যদি তিপ্রা মথার সঙ্গে তাঁদের জোট বা বোঝাপড়া ঘটে।

দু’বছর পরে ত্রিপুরায় তৃণমূল কংগ্রেস কত আসন পাবে, তা এমন নানা সমীকরণের উপর নির্ভরশীল। তবে কিনা, ত্রিপুরার মাটিতে ঘাসফুল ফোটাতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যে ভাবে আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছেন, তা ধরে রাখা গেলে উত্তর-পূর্বের অন্য রাজ্যেও এই দল শক্তিশালী হবে বলে মনে হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন