গত মাসে গ্রামের এক বাসিন্দা মারা যান এবং তাঁর আত্মীয় অসুস্থ হন। গ্রামের মোড়ল নকুল ওরাওঁ দৈবজ্ঞানে জানতে পারে, এই সবের জন্য দায়ী ওই গ্রামেরই এক বৃদ্ধা কাতো দেবীর তুকতাক। বিষয়টা সে গ্রামবাসীর মধ্যে চাউর করে দেয়। ৬ জুলাই প্রায় আড়াইশো লোক নিয়ে সভা বসিয়ে কাতো দেবীর বিচার হয়। তাঁর বক্তব্যে কান দেওয়ার প্রশ্নই নেই। কারণ, তিনি তো ‘ডায়ন’। গ্রামবাসীরা কাতো দেবীর বাড়ি ঘিরে ফেলে বাড়ির সদস্যদের প্রবল মারধর করে। আগুন লাগিয়ে দেয়। কাতো দেবী-সহ বাড়ির পাঁচ জনকে খুন করে দেহ জ্বালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তাঁর কিশোর নাতি কোনও মতে পালিয়ে মামার বাড়ি যায় ও পুলিশে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ আধপোড়া দেহগুলি উদ্ধার করে।
এই মুহূর্তে দ্বিতীয় ভারতীয় হিসাবে শুভাংশু শুক্ল মহাকাশ থেকে ফেরত এসেছেন। এ দেশের আধবুড়ো স্বাধীনতা চাঁদ ছুঁয়েছে। ভারতের আত্মায় এআই কিলবিল করছে। আমরা ‘ডিজিটাল’ হয়েছি। আর এই সব ঝকঝকে তথ্যকে দাঁড়িপাল্লার এক দিকে রেখে অন্য দিকে চেপে বসেছে বিহারের পূর্ণিয়া জেলার তেতগামা গ্রামের ওরাওঁ পরিবারের পাঁচ আদিবাসীর কাবাব হয়ে যাওয়া শরীর।
ডাইনি-হত্যার ভারতীয় বৃত্তান্তে পুরুষের আর্তনাদ নেই, তা নয়; এমনকি শিশুরাও নিহত হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই (৯৮ শতাংশের বেশি) ‘ডাইনি’ তকমা এবং তার দরুন নির্যাতন, মৃত্যু এই সব জোটে নারীরই কপালে। বিশেষত যে দরিদ্র, অশিক্ষিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ বৈষম্যের ছাতার তলায় দাঁড়িয়ে আধিপত্যের খুদকুঁড়ো কুড়োয়, নারী সেখানে আক্রমণের ঘোষিত লক্ষ্য। আর তাই, মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী সোমা চৌধুরীর মতে, অঞ্চলভেদে ডাইনি নিধনের অছিলা ভিন্ন হলেও আদতে এর পিছনে থাকে তীব্র নারীবিদ্বেষ। বিশেষত দলিত, আদিবাসী বা জনজাতির নারীবিদ্বেষ। বহু পুরনো এই ধারা। আজকের নয়। দ্বাদশ শতাব্দীতে গোবর্ধন আচার্য তাঁর আর্যসপ্তশতী-তে লিখেছেন, “সখী ধীর পা ফেলে চল। তোমার উদ্ধত আচরণ দেখে পল্লীপতি ডাকিনী বলে দণ্ডবিধান করতে পারেন।”
ডাইনি সন্দেহে মানুষ খুন বহু প্রাচীন কাল থেকেই প্রচলিত, ইউরোপে, আমেরিকাতেও। এ দেশে এই নথি সংরক্ষণের কাজ সুচারু ভাবে শুরু করতে লেগে গিয়েছে অষ্টাদশ শতকের প্রায় অন্তিম ভাগ। সমাজপতি, মোড়ল, তান্ত্রিক বা ওঝা জাতীয় স্বনিযুক্ত ‘নেতা’রা বহুকাল ধরেই এলাকার কোনও নারীকে অশুভ শক্তি হিসাবে চিহ্নিত করে ওই অঞ্চলের যাবতীয় অমঙ্গলের দায় তাঁর উপর চাপিয়ে দিয়ে থাকে। এলাকাবাসী প্রভাবিত হয়, তাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মন অশিক্ষা, অপশিক্ষার দ্বারা উত্তেজিত ও হিংস্র হয়ে ওঠে। ‘শাস্তি’র তালিকায় থাকে শারীরিক নির্যাতন, চুল কামিয়ে দেওয়া, ধর্ষণ, একঘরে করা, বর্জ্য খেতে বাধ্য করা, এবং হত্যা। ‘সতীদাহ’ প্রথার চেয়েও নাকি ‘ডাইনি’ সন্দেহে নারীমেধ বেশি এ দেশের ইতিহাসে। অভিযুক্ত নারীর চোখে এই নিয়মে লঙ্কাবাটা ঘষে দেওয়া হত। তাঁকে গাছ থেকে উল্টো করে ঝুলিয়ে দেওয়া হত খোলা আগুনের উপর। ১৮৮৬ সালে কুনকু নামের এক মহিলার কথা জানা যায়, যাঁকে গাছ থেকে ঝুলিয়ে তাঁর হাত দু’টি ডুবিয়ে রাখা হয়েছিল ফুটন্ত তেলে। পরে কুনকুকে হত্যাই করা হয়।
ভারতে ডাইনি সন্দেহে নিহত মহিলাদের ৩২ শতাংশ দলিত সমাজের সদস্য, যাঁরা শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সমানাধিকারের ধারণা থেকে অনেকাংশেই বঞ্চিত। এর সঙ্গে যোগ হয় ব্যক্তিগত শত্রুতা, সম্পত্তির লোভ, যৌনতার লোভ। অসহায়, সঙ্গীহীনা এবং অনেক ক্ষেত্রে এই প্রথা আসলে সন্তানহীনা নারীকে কব্জা করা ও তাঁর সম্পত্তি লুটে নেওয়ার পথ। দেশের ৬৫ শতাংশ ‘ডাইনি’ সন্দেহে হত্যা সংঘটিত হয় ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওড়িশা ও ছত্তীসগঢ়ে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর দেওয়া তথ্যে প্রকাশ, ২০০০-১৬ এই সময়কালের মধ্যে ভারতে ২৫০০ জন এবং ২০১৬-২০২১‘এর মধ্যে ৬৬৩ জন মহিলা ডাইনি হত্যার নামে খুন হয়েছেন। সোনার মেডেল অবশ্য একা ঝাড়খণ্ডই ছিনিয়ে নেবে। ২০২২ সালের তথ্য জানাচ্ছে, সেই সময় ওই রাজ্যে গড়ে প্রত্যহ তিনটি করে ডাইনি হত্যা হত— ডাইনি প্রথা বিরোধী আইন ১৯৯৯ সালে পাশ হওয়া সত্ত্বেও। বিহারও কম যায়নি। ২০২৩-২৪‘এ ৭৫০০০ মহিলা ডাইনি হওয়ার ভয়ে দিন কাটিয়েছেন।
প্রশ্ন হল, ‘গণতান্ত্রিক’ ভারতে এখনও এমন প্রথা চলছে কী ভাবে? শুধু তো এই প্রথা নয়, চলছে নরবলিও। অসম, ছত্তীসগঢ়, তেলঙ্গানা, রাজস্থান, গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ, এমনকি দিল্লিতেও নরবলি হয়েছে বলে খবর। এনসিআরবি-র তথ্য বলছে, ২০১৪-২২‘এর মধ্যে ভারতের সবচেয়ে শিক্ষিত রাজ্য কেরলে ১০০টির বেশি নরবলি হয়েছে। আসলে এ দেশে সম্পদের মতো স্বাস্থ্য, শিক্ষাও একটি সুবিধাভোগী শ্রেণির কুক্ষিগত। সাধারণের জন্য এ সবের বরাদ্দ যৎসামান্যই। আর সেই ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করছে কুসংস্কারজনিত হিংসার ঘোর অন্ধকার। আগামী কাল ৭৯তম বার লাল কেল্লায় স্বাধীনতার পতাকা উঠবে। কে জানে, সেই ভারতে জেগে থাকবে কত স্বাধীনতা হরণ, অধিকারহরণের কলঙ্ক।
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে