Mass Layoff

গণ-ছাঁটাইয়ের নেপথ্যে

কোভিডজনিত লকডাউনের শুরুর দিকে প্রায় সব অর্থনৈতিক পূর্বাভাসই ছিল নেতিবাচক। বড় তথ্যপ্রযুক্তিতেও নতুন নিয়োগে বিধিনিষেধ ছিল।

Advertisement

প্রত্যয় মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০২৩ ০৫:৩৬
Share:

পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, ২০২২-এ তথ্যপ্রযুক্তিতে বিশ্বে আড়াই লক্ষেরও বেশি কর্মী ছাঁটাই হয়েছে। প্রতীকী চিত্র।

ভারতীয় বংশোদ্ভূত চতুর্দশী তনভি মরুপল্লি আমেরিকার আরকানসা-য় তার বাড়ি থেকে হঠাৎ এক দিন উধাও হয়ে যায়। তার মা এর কিছু দিন আগে একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা থেকে ছাঁটাই হওয়ার ফলে তাঁকে ভারতে ফিরে আসতে হয়েছিল, বাবার চাকরিরও টলমল অবস্থা, প্রায়ই তাঁরা আমেরিকার পাট চুকিয়ে পাকাপাকি ভারতে ফেরার পরিকল্পনা করতেন, সেই আশঙ্কাতেই হয়তো। মাস দুয়েক পরে বহু দূরে ফ্লরিডায় তনভিকে পাওয়া যায়। এই আশঙ্কা এখন আমেরিকায় তথ্যপ্রযুক্তিতে কর্মরত বহু ভারতীয় পরিবারেই প্রবল।

Advertisement

পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, ২০২২-এ তথ্যপ্রযুক্তিতে বিশ্বে আড়াই লক্ষেরও বেশি কর্মী ছাঁটাই হয়েছে। সংস্থাগুলির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই ছাঁটাই বিশ্বজোড়া মন্দার সম্ভাবনা, কোভিডজনিত সাপ্লাই-চেন সমস্যা, ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে। সিলিকন ভ্যালির বড় নামগুলো— গুগল, মাইক্রোসফটের কর্ণধাররা ‘গভীর দুঃখ’ প্রকাশ করেছেন।

পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে মুনাফাই ঈশ্বর, যার কেন্দ্রে থাকে পুঁজির বাজার ও লগ্নিকারীদের কায়েমি স্বার্থ। অতিসরলীকরণ করে বলা যায়, বাজার চাঙ্গা থাকলে কর্মী সংখ্যা বাড়ালে শেয়ার বাজারের সূচক বেড়ে যায় কোম্পানির সার্বিক বৃদ্ধি দেখে, বৃহৎ লগ্নিকারীদের মুনাফা হয় বিরাট, তার কিছু অণু-পরমাণু পেয়েই কর্মীরাও নিজেদের মধ্যে ইঁদুর দৌড়ে শামিল হন। বাজার মন্দা হলে ছাঁটাই করে কমানো হয় খরচ। উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে বাজার থেকে কিনে নেওয়া হয় বিশাল অঙ্কের নিজেদের শেয়ার (স্টক-বাইব্যাক)। বাজারে এ ভাবে শেয়ারের সরবরাহ কৃত্রিম ভাবে কমিয়ে মূল্য বাড়িয়ে দেওয়া হয়। তাতে প্রযুক্তিবিদদের কপাল পুড়লেও লগ্নিকারীরা খুশি।

Advertisement

কোভিডজনিত লকডাউনের শুরুর দিকে প্রায় সব অর্থনৈতিক পূর্বাভাসই ছিল নেতিবাচক। বড় তথ্যপ্রযুক্তিতেও নতুন নিয়োগে বিধিনিষেধ ছিল। আবার তখন কাজে সবচেয়ে কম অসুবিধায় পড়েছেন এই ক্ষেত্রের কর্মীরাই। উৎপাদন ক্ষমতা অটুট থাকা, আর লকডাউনে ই-কমার্সের উপর আমাদের অতিনির্ভরশীলতার ফলস্বরূপ গুগল অ্যামাজ়ন ফেসবুক বা মাইক্রোসফট-এর মতো সংস্থার শেয়ার-সূচক বাড়তে থাকে অস্বাভাবিক হারে। অভূতপূর্ব কর্মী নিয়োগও চলতে থাকে। যদিও একই সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় কোভিডে লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষের (যাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে বাধ্য হন) প্রাণ যেতে থাকে, তথ্যপ্রযুক্তিতে তখন এক অন্য ‘বসন্ত’।

তাবড় পুঁজিপতিরা কী করে ভেবে নিলেন এই বসন্ত চিরকাল চলবে? শেয়ার বাজারের সূচক ছাড়া আর কোনও সংখ্যাই কি তাঁদের চোখে পড়েনি? যাঁদের বুদ্ধির উপর ভরসা করে মানবজাতি আজ ভিনগ্রহে সাম্রাজ্য স্থাপনের পরিকল্পনা করছে, তাঁদের শেষে এমন বুদ্ধিভ্রম হল?

সিলিকন ভ্যালিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এই দানবীয় তথ্যপ্রযুক্তি ফার্মগুলিকে বাইরে থেকে যেমন সৃষ্টিশীল চিন্তাধারার মহামিলন বলে মনে হয়, আসলে তা মাত্র ক’টি বিভাগেই সীমিত। বেশির ভাগ বিভাগেই কর্মী হাতে রাখা হয় কোনও নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছাড়া, কর্মকর্তাদের পোর্টফোলিয়োর ওজন দেখাতে। নিয়োগও চলতে থাকে তাল মিলিয়ে। স্টার্ট-আপ অবস্থায় কিন্তু কাজের পরিবেশ থাকে অনেকটাই সৃষ্টিশীল, প্রত্যেক কর্মীর কাজ সেখানে গুরুত্বপূর্ণ। সৃষ্টিশীল পরিবেশ শেষে বিরাট আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় কী ভাবে? একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা অবশ্যই শেয়ার বাজারে নথিভুক্ত হওয়া। বিশ্বব্যাপী লগ্নিকারীদের পুঁজি কেন্দ্রীভূত হয় একটি প্রতিষ্ঠানে, তা সামলাতে গড়া হয় নিত্যনতুন কর্পোরেট কাঠামো ও বিশাল কর্মকর্তা-দল, যাঁরা লগ্নিরও বড় অংশীদার। সংস্থার মূল চালিকাশক্তি উদ্ভাবক ও প্রযুক্তিবিদদের থেকে ক্রমশ এঁদের হাতে চলে যায়, যাঁদের একমাত্র লক্ষ্য স্বল্পমেয়াদি মুনাফা ও ক্রমবর্ধমান শেয়ার সূচক। উদ্ভাবন হয়ে যায় গৌণ। এর পর একটি বড় সংস্থা বিশাল হয়ে ওঠে অন্য ছোট উদ্ভাবনশীল সংস্থাকে গ্রাস করে এবং একত্রীকরণের মাধ্যমে। গড়ে ওঠে বিশাল সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা, অর্থনীতিবিদ ইয়ানিস ভারুফাকিস-এর মতে ‘টেকনো-ফিউডালিজ়ম’ বা প্রযুক্তি-সামন্ততন্ত্র। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেকটাই আজ নিয়ন্ত্রিত এই বিশাল সংস্থাগুলির দ্বারা, অথচ এদের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ কুক্ষিগত স্বল্প সংখ্যক বৃহৎ লগ্নিকারীদের দ্বারা। এই সামন্ততন্ত্রকে বাজারের অনিশ্চয়তা থেকে বাঁচাতে কখনও ‘প্রয়োজনীয়’ হয়ে পড়ে গণ-ছাঁটাই। মাসুল দিতে হয় তনভির পরিবারের মতো সাধারণ মানুষকে।

কিন্তু এর বিকল্প কী হতে পারে? ইয়ানিস এমন এক ব্যবস্থার কথা কল্পনা করেছেন, যার মূলে আছে শেয়ার বাজারের অবলুপ্তি ও মালিকানার সুষম বণ্টন, অর্থাৎ কর্মী-সমবায়ের মাধ্যমে সুবৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলির পরিচালনা। একই রকম ভাবনার প্রতিফলন ভাস্কর সুঙ্কারার দ্য সোশ্যালিস্ট মানিফেস্টো-তেও, সেখানে এ ধরনের ব্যবস্থা কী করে মানুষের ইনসেন্টিভ-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা যায় তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। বিকল্প খুঁজে পাওয়ার কাজটি সহজ নয়, তবে বিভিন্ন বিকল্প গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করলে হয়তো আমরা মুনাফা ও লোভসর্বস্ব ব্যবস্থা থেকে একটি মানবতাকেন্দ্রিক ব্যবস্থার দিকে ধীরে ধীরে এগোতে পারব। নয়তো এই গণ-ছাঁটাই ভবিষ্যতে আরও বড় আকারে হতে পারে, বিশেষত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জেরে লক্ষাধিক কাজের প্রয়োজন ফুরোনো যখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন