History

নতুন সত্তাপরিচয়ের দিশারি

রাজবংশী জনজাতির মধ্যে শ্রেণি-সচেতনতা গড়ে তুলতে শুরু করেছিলেন পঞ্চানন বর্মাই।

Advertisement

ঈশা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৪:২৬
Share:

এখনকার কোচবিহার, এবং কোচবিহার সংলগ্ন ছিটমহল— এক সময় সমস্তটাই ছিল রংপুরের অন্তর্ভুক্ত। সেই জেলার মুখ্য জনজাতি কোচেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন রাজবংশী জনজাতির অংশ। তাঁরা সামগ্রিক ভাবে কোচ বলেই পরিচিত হতেন।

Advertisement

১৮৯১-র জনগণনায় যখন পৃথক ভাবে জাতের নথিকরণের প্রয়োজন হল, তখন প্রতিবাদ জানালেন রাজবংশীরা। তাঁরা কোচ জাতির অন্তর্গত হয়ে জনগণনায় থাকতে চান না।

রাজবংশীদের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করার সেই চেষ্টা রূপ পায় জননেতা রায় সাহেব পঞ্চানন বর্মার হাত ধরে। ১৪ ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্মদিন। দিনটিতে রাজ্য সরকারের শিক্ষাপ্রাঙ্গণে ঘোষিত ছুটি উদ্‌যাপিত হয়, আর প্রশ্নরা বুদবুদের মতো ভাসে। কে ছিলেন পঞ্চানন বর্মা? কেন মনে রাখিনি তাঁকে?

Advertisement

অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন রাজবংশী পরিবারে জন্ম নেন পঞ্চানন বর্মা (ছবিতে)। তাই অনেক রাজবংশী শিক্ষাবঞ্চিত হলেও, পড়াশোনার সুযোগটুকু পেয়েছিলেন তিনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই সঙ্গে সংস্কৃতে স্নাতকোত্তর এবং ওকালতির পরীক্ষা পাশ করেন। ১৯০১-এ প্র্যাকটিস শুরু করেন রংপুর কোর্টে। সেখানেই অনুভব করেন অন্ত্যজ শ্রেণিভুক্তির কারণে বিচ্ছিন্নকরণের প্রবণতা। এক সঙ্গে খাওয়া তো দূর, কেউ কাছে বসতেও চাইত না। যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগও পেতেন না।

রাজবংশী জনজাতির মধ্যে শ্রেণি-সচেতনতা গড়ে তুলতে শুরু করেছিলেন পঞ্চানন বর্মাই। জোর দেন প্রথাগত শিক্ষা, বিশেষত ইংরেজি জানার উপর। শুরু করেন রাজনৈতিক তদবির, যাতে রাজবংশী আন্দোলন পায়ের তলায় জমি পায়। ১৯০৬ সালের বরিশালের কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। কলকাতায় কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু আশানুরূপ ফল না পেয়ে, কোচবিহারে ফিরে আসেন। কোচবিহারের ভূপ রাজাদের সঙ্গে রাজবংশী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বৈরিতা ছিল। তা সত্ত্বেও আয়োজন করেন মহামিলন সভার। সেখানে ব্রাহ্মণসমাজের অমত সত্ত্বেও অসংখ্য রাজবংশী সামাজিক ভাবে পৈতে ধারণের অধিকার গ্রহণ করেন। বাড়তে থাকে ভূপ রাজাদের সঙ্গে শত্রুতা।

কংগ্রেস নেতাদের আশ্বাস না পাওয়ায় এবং ভূপ রাজাদের ক্রমাগত শত্রুতার ফলে একটিই পথ খোলা ছিল পঞ্চানন বর্মার কাছে— ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে কিছুটা সৌহার্দ স্থাপনের পথ। রাজবংশীদের উন্নয়নের স্বার্থে সেই চেষ্টাই করেন। এই চেষ্টার ফলে ১৯১১-র জনগণনায় রাজবংশীদের কোচ জাতির থেকে ভিন্ন হিসাবে উল্লেখ করা হয়। যোগ করা হয় ক্ষত্রিয় পরিচয়।

কিছু দিনেই শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ১৯১৪-য় পঞ্চানন বর্মার উৎসাহে রাজবংশীরা তাঁদের ক্ষত্রিয় ধর্ম প্রমাণের জন্য যোগদান করেন ব্রিটিশ ভারতীয় আর্মিতে। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘রায় সাহেব’ উপাধি প্রদান করেন। ব্রিটিশ মিত্রতা আরও কিছুটা পাকাপোক্ত হয়।

১৯১৯-এ গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট (মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিফর্মস)- এর নির্দেশ অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের জন্য, সীমিত অংশগ্রহণকারী নিয়ে ভারতে নির্বাচন হয়। ১৯২০-তে রংপুর নির্বাচনী কেন্দ্র থেকে বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে নির্বাচিত হন পঞ্চানন বর্মা। নির্বাচনে জয়লাভ তাঁকে অবিভক্ত বাংলার রাজনীতিতে তো বটেই, ভারতীয় রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। তিনিই প্রথম লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে মহিলাদের ভোটদানের অধিকার নিয়ে লড়াই করেন। আরও উৎসাহ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন রাজবংশীদের উন্নয়নে। রাজবংশী নারী-পুরুষ উভয়েরই শিক্ষাকে সমান গুরুত্ব দেন। রায় সাহেবের এত দিনের চেষ্টার সুফল দেখা দিতে থাকে রাজবংশী সমাজজীবনের সর্বত্র।

দলিত নারীপুরুষের এতখানি আলোয় বেরিয়ে আসা মেনে নিতে পারে কি মূল সমাজ? শুরু হয় রাজবংশীদের উপর অত্যাচার, নারী অপহরণ। প্রত্যুত্তরে রায় সাহেব লেখেন কামতাপুরি ভাষার বিখ্যাত কবিতা— ‘ধাং ধারি মাও’। ‘নারী রক্ষা সমিতি’ স্থাপন করেন, রাজবংশীদের অস্ত্রশিক্ষা, লাঠিখেলা শেখানো শুরু করেন।

গ্রামীণ রাজবংশী সমাজে চিরকালই জোতদার ও মহাজনদের অত্যাচার ছিল। রুখে দাঁড়াতে, রায় সাহেব রাজবংশীদের নিজস্ব ব্যাঙ্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন। তৈরি হয় বর্মা কোম্পানি। পরে ১৯২১-এ স্থাপিত হয় ক্ষত্রিয় ব্যাঙ্ক। তারা রাজবংশী চাষি ও ব্যবসায়ীদের কম সুদের হারে ধার দিত। যাতে, তাঁদের মহাজনদের শরণাপন্ন না হতে হয়।

ভূপ রাজাদের সঙ্গে বিরোধিতা তো ছিলই, কিন্তু ১৯২৬ সালে কোচবিহারের তৎকালীন রাজা জগদীপেন্দ্রনারায়ণ ভূপ নিষেধাজ্ঞা জারি করেন যে, পঞ্চানন বর্মা কোচবিহারে প্রবেশ করতে পারবেন না। নানা ভাবে লুকিয়ে প্রবেশ করার চেষ্টা করেন তিনি। কখনও সফল হন, কখনও হননি। এই সংগ্রামের মধ্যেই ১৯৩৫-এ কলকাতাতে তাঁর জীবনাবসান হয়।

রাজবংশী জনজাতি আলোর মুখ দেখেছিল পঞ্চানন বর্মার হাত ধরে। তাঁদের দাবি মেনে, ১৯২১ এবং ১৯৩১ সালের জনগণনায় তাঁদের উল্লেখ করা হয় ক্ষত্রিয় জাতি বলে। শিক্ষা এবং ইংরেজির প্রসার হয়। স্থাপিত হয় গ্রামীণ মণ্ডলী, যাতে একত্র হয়ে জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারেন রাজবংশীরা।

পঞ্চানন বর্মা আজও তাঁদের কাছে আদরের, সম্মানের ঠাকুর পঞ্চানন, রায় সাহেব। কোচবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও বর্তমানে পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়। এ ইতিহাস মনে রাখার দায়িত্ব কি আমাদেরও নয়?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement