ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের সামনে প্রতি দিন নূতন চ্যালেঞ্জ, প্রত্যহ কঠিন সিদ্ধান্তের ভার। কিন্তু তাহার মধ্যেও অযোধ্যা মামলার মতো দুরূহ এবং সংবেদনশীল চ্যালেঞ্জ হয়তো সহসা হাতে আসে না। স্বীকার করিতে হইবে, এই বিরাট চ্যালেঞ্জের সামনে যে স্পষ্টতা ও দৃঢ়তার সহিত সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় বিচারপতিরা অগ্রসর হইতেছেন, তাহা প্রশংসনীয়। প্রথমেই তাঁহারা মূল দ্বন্দ্বটিকে স্পষ্ট করিয়া দিয়াছেন যে, এই মামলা প্রধানত বাবরি মসজিদ-রামজন্মভূমি বিতর্কিত স্থানটিতে জমি সংক্রান্ত মামলা, ইহার মধ্যে কোনও তৃতীয় বিষয় বা তৃতীয় পক্ষের প্রবেশ অনভিপ্রেত। আট বৎসর আগে, ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইলাহাবাদ হাই কোর্ট যে রায় দিয়াছিল, তাহাতে তিন পক্ষের মধ্যে মোট জমির অধিকার ভাগ হইয়া যায়: এক-তৃতীয়াংশ করিয়া পায় সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড, নির্মোহী আখড়া এবং স্বয়ং রামলালা। সুপ্রিম কোর্টের পরিষ্কার নির্দেশ, এই রায়ের বিরুদ্ধে যাঁহারা আপিল করিয়াছেন, সেই সব আপিলের মূল কথাটি হইল জমির ভাগাভাগি, ফলে অন্য যে সকল অতিরিক্ত বাক্য ও অলংকার এখন মামলার বয়ানে ঢুকিতেছে, ‘কোটি কোটি হিন্দুর আবেগ’ ইত্যাদি মর্মে বাদী পক্ষের উকিলরা যে ধুয়া তুলিতেছেন, সেগুলি একেবারে বন্ধ হউক। জমি-সংক্রান্ত মামলায় ধর্ম, সংস্কার, রাজনীতি ইত্যাদি কোনও কিছুরই জায়গা নাই। জমি বিতর্কে দরকার, সংশ্লিষ্ট নথিপত্র। আপাতত বহু নথি জমা পড়িলেও কিছু কিছু ইংরাজি অনুবাদ ভিন্ন অর্থবোধক হইতেছে না। সুতরাং সুপ্রিম কোর্টের কাজ যদি সুষ্ঠু ভাবে করিতে হয়, সকল নথি যথাশীঘ্র যথাবিধি ‘এক্সিবিট’ হিসাবে আসা দরকার।
যে বিষয়টি আগে বিতর্কিত ছিল না, কেবল ধর্ম-রাজনীতির দৌলতেই যাহা বিতর্কিত হইয়া উঠিয়াছে, তাহা লইয়া প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলি অতি সক্রিয় হইয়া উঠিবে, তাহা অভিপ্রেত না হইলেও প্রত্যাশিত। বিচারবিভাগ যদি সেই অভিমুখ হইতে হাল অংশতও ঠিক দিকে ঘুরাইতে পারে, তাহা বড় সুসংবাদ। জমির অধিকারের সহিত এখানে যে ঐতিহাসিক স্থাপত্যটি ছিল, তাহা নির্মাণ ও ধ্বংসের প্রশ্নটিও আসিবেই। পাঁচশত বৎসর আগে যদি তাহা নির্মাণ হইয়া থাকে, আর পঁচিশ বৎসর আগে যদি তাহা ধর্মগুন্ডাদের দ্বারা ধ্বংস হইয়া থাকে, তাহা হইলে সেই নির্মাণ ও ধ্বংসের বিবেচনা নিশ্চয়ই এই মামলা হইতে সরাইয়া রাখা যাইবে না। করসেবকদের বাবরি মসজিদ ধ্বংস করিবার ঘটনা ভারতের ইতিহাসে একটি তুলনাবিহীন তালিবানি মুহূর্ত। তাই কেবল রামজন্মভূমির জমি-প্রশ্ন নহে, পাঁচশত বৎসরের মসজিদের জমি-অধিকারটিও বিচার করিতে হইবে বইকি। সংগত যুক্তিপথেই বিচারপতিরা এখন ভাবিতেছেন, সেই ধ্বস্ত মসজিদ পুনরায় ওই চত্বরেই কোথাও নূতন ভাবে নির্মাণ করা যায় কি না।
আসল কথা, যে কোনও জমির অধিকারের প্রশ্নেরই একটি সময়প্রেক্ষিত থাকে। অনাদি অতীতে ফিরিয়া গিয়া জমির অধিকারের মীমাংসা করা যায় না। রামলালার অনুরাগীরা যদি এক্সিবিট হিসাবে গোটা কুড়ি প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ আদালতে প্রদর্শনের জন্য আনেন, রামায়ণ বা গীতা বা রামচরিতমানসের মাধ্যমে জমির অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন, ত্রেতাযুগ কিংবা ত্রিশ হাজার বৎসর আগেকার কী প্রমাণপত্র আনিবেন ভাবিয়া নিজেরাই নাজেহাল হইয়া পড়েন, তাহা হইলে স্বভাবতই কেন্দ্রীয় বিষয়টি ‘জমি’ থাকে না, কেবল ‘ধর্মবিশ্বাস’-এ আটকাইয়া যায়। তাই কোন এক্সিবিটের কতখানি গ্রহণযোগ্যতা, তাহার ধর্মনিরপেক্ষ বস্তুসাপেক্ষ সিদ্ধান্ত লওয়া জরুরি। প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র, বিচারপতি অশোক ভূষণ ও আবদুল নাজিরের কাজটি মোটেই ঈর্ষণীয় নহে। কিন্তু উপায় নাই, ধর্মনিরপেক্ষ ও যুক্তিবাদী ভারতের ভবিষ্যৎ আপাতত তাঁহাদের হাতেই ন্যস্ত।