নিজের পিছু পিছু যাওয়া

রেগে যাওয়া আসলে একটা পারফর্মিং আর্ট!

ক্যাফের স্পিকারে মৃদু আওয়াজে গান বাজছিল, তার সঙ্গে তাল দিচ্ছিল শিশির। আড় চোখে দেখলেন শিবুদা। তপেশদের দিকে ফিরে বললেন, ‘‘দেখ। এ ভাবেই অভ্যস্ত হয় লোকে। শপিং মলে গান শুনিয়ে প্রাইমিং-এর কথা বলেছিলাম, মনে আছে?

Advertisement

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

সামনে ধূমায়িত ক্যাপুচিনো, কিন্তু শিবুদার কপালে গভীর ভাঁজ। তপেশরা আজ তাঁকে ঠাঁইনাড়া করেছে। পাকড়াও করে এনেছে ক্যাফেতে। এবং, সেখানে ঢুকে ইস্তক শিবুদার ভ্রুকুটি বন্ধ হচ্ছে না।

Advertisement

‘‘এক দিনই তো, শিবুদা’’, সূর্য বলে। ‘‘কাল থেকেই আবার ব্যাক টু গোপালের দোকান।’’

‘‘ঠিক জানিস?’’ উত্তর দেন শিবুদা। ‘‘আমিও যে তোদের মতোই অভ্যস্ত হয়ে যাব না দেড়শো টাকায় এক কাপ কফি খেতে, কে বলতে পারে?’’

Advertisement

‘‘তা হলে তো ল্যাটা চুকেই গেল!’’ ফুট কাটে তপেশ। গার্লিক ব্রেডের টুকরো তুলে কামড় দেয়।

‘‘দুধ ফেটিয়ে ফেনা তুলে এসপ্রেসোর ওপর ঢালছে, আর তোদের কান মুলে দেড়শোটা টাকা নিচ্ছে। অভ্যস্ত হয়ে যাব এতে?’’ কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন শিবুদা। তপেশ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, হাত তুলে থামালেন। ‘‘হয়ে যেতেও পারি, জানিস। গোটা দুনিয়া তো এ ভাবেই অভ্যস্ত হয়।’’

ক্যাফের স্পিকারে মৃদু আওয়াজে গান বাজছিল, তার সঙ্গে তাল দিচ্ছিল শিশির। আড় চোখে দেখলেন শিবুদা। তপেশদের দিকে ফিরে বললেন, ‘‘দেখ। এ ভাবেই অভ্যস্ত হয় লোকে। শপিং মলে গান শুনিয়ে প্রাইমিং-এর কথা বলেছিলাম, মনে আছে? এখানেও ঠিক তা-ই হচ্ছে। শিশির বুঝতেও পারবে না, যে ভাল লাগা নিয়ে আজ ও এই ক্যাফে থেকে বেরোবে, তার কতটা কফির জন্য, আর কতটা এই গানগুলোর জন্য। যে হেতু কফিটা সচেতন ভাবে খাচ্ছে, কফি খেতেই এসেছে, আর গানটা জাস্ট চলছে, কাজেই ভাল লাগার কারণ হিসেবে কফিটাই মনে থাকবে। পরে যে দিন ভাল কফি খেতে ইচ্ছে হবে, বা ভাল সময় কাটাতে চাইবে, এই ক্যাফের কথা মনে পড়বে শিশিরের।’’

আরও পড়ুন: ‘এইচআইভি নিয়েও আর পাঁচটা মানুষের মতোই বেঁচে আছি ১১ বছর’

‘‘যাচ্চলে! দুনিয়ার সব কিছুকেই তো এক খাপে পুরে দিচ্ছেন মশাই।’’ আপত্তি করে তপেশ। ‘‘শুধু গান বাজিয়েই যদি খদ্দের ফিরিয়ে আনা যেত, গোটা দুনিয়া জুড়ে সব দোকান গান বাজাত না?’’

‘‘কান দুটো খোলা রাখ, দেখবি তা-ই বাজাচ্ছে। শুধু গান নয় অবিশ্যি, আরও অনেক কিছু। কিন্তু, সেটা আসল কথা নয়।’’ শিবুদার কফি শেষ। বললেন, ‘‘বাইরে থেকে একটা সিগারেট টেনে আসি। তার পর বলছি।’’

শিবুদা আর শিশির উঠে যায়। সূর্য বলে, ‘‘কথাটা কিন্তু ফেলে দেওয়ার মতো নয়। ভেবে দেখ, শপিংয়ের এক্সপেরিয়েন্সটা অ্যাক্রস জিয়োগ্রাফিকাল লোকেশন কেমন ইউনিফর্ম হয়ে গিয়েছে। কলকাতার মল হোক বা দিল্লি, বা সিঙ্গাপুর, নিউ ইয়র্ক খেয়াল করে দেখবি, কার্যত প্রতিটা দোকানে এক রকম পারফিউমের গন্ধ, এক রকম আলো, এক রকম গান চলছে। সেলস-এর ছেলেমেয়েগুলো পর্যন্ত প্রায় এক রকম জামাকাপড় পরে। আলাদা করতে পারবি না। পুরোটা সমাপতন?’’

আরও পড়ুন: এসপ্ল্যানেডের নীচ দিয়ে এগোচ্ছে মেট্রোর সুড়ঙ্গ

‘‘কফি খাওয়ার পর যেখানে সিগারেট খাওয়ার জন্য বাইরে যেতে হয়, সেখানে কোনও ভদ্রলোক আড্ডা মারতে আসে না।’’ ফিরে এসে গজগজ করেন শিবুদা। ‘‘কিন্তু, সে সব কথা ছাড়। মানুষ সবচেয়ে বেশি কাকে অনুসরণ করে, বল দিকি।’’

‘‘অনুসরণ, মানে ফলো?’’ তপেশ মুখ খোলে। ‘‘আমার কথা বলতে পারি। আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প, দিল্লিতে মোদী, আর কলকাতায় আপনি।’’

‘‘যত তুচ্ছ কথা!’’ ধমক দেন শিবুদা। ‘‘শুনে রাখ, মানুষ সবচেয়ে বেশি অনুসরণ করে নিজেকে। অবচেতনেই করে। বেশির ভাগ সময়ই মানুষ জানে যে কোন পরিস্থিতিতে কী করতে হবে। যখন জানে না, তখন খোঁজ করে, ভরসাযোগ্য লোকজন এমন পরিস্থিতিতে পড়লে কী করে। আর, সেই ভরসার লোকটা, বেশির ভাগ সময়েই দাঁড়ায় সে নিজে।’’

‘‘এই উপলব্ধিটা কি বাইরে সিগারেট খেতে বেরিয়ে হল?’’ তপেশ অদম্য।

‘‘নাহ্। তোদের এই ক্যাফেতে আসার আগ্রহ দেখে হল। ভেবে দেখ, প্রথম যে দিন এই রকম ঝাঁ চকচকে ক্যাফেতে ঢুকেছিলি, সে দিন কেন এসেছিলি? হয় কারও সঙ্গে, অথবা কারও কাছে শুনে, অথবা বাইরে থেকে দেখে ভাল লেগেছিল বলে। কিন্তু, ঢুকেই ধাক্কা খেলি। তার আগে অবধি বড় জোর কুড়ি টাকায় এক কাপ কফি খেতে অভ্যস্ত ছিলি। এখানে দিলি দেড়শো টাকা। কিন্তু, যখন বেরোলি, তখন একটা ভাল লাগা নিয়ে বেরোলি। ধরেই নিলি, ভাল লাগাটা ভাল কফির জন্য। পরে যে দিন তোর ফের ভাল কফি খেতে ইচ্ছে হল, সে দিন তোর মন ভাবতে বসল, কোথায় খেয়েছিলাম ভাল কফি? এই জায়গাটার কথাই মনে পড়়ল। নিজের ওপর যে হেতু আমাদের অগাধ ভরসা, তাই নিজেকে বিশ্বাস করে তুই চলে এলি এই ক্যাফেতে। পরের দিন আবার। বার কয়েক আসতেই তোর অভ্যাস হয়ে গেল দেড়শো টাকায় কফিতে।’’ লম্বা উত্তর দেন শিবুদা। তার পর বলেন, ‘‘আর এক কাপ কফি বল তো। এসপ্রেসো বলবি।’’

সূর্য উঠে যায়। শিবুদা বলতে থাকেন, ‘‘কথাটা আসলে কোনও একটা ক্যাফে নিয়ে নয়। আমরা নিজেদের নকল করে চলেছি সর্ব ক্ষণ, সেখানেই মূল গন্ডগোল। এক বার— যখন আমি কিছু দিনের জন্য বস্টনে ছিলাম— এক বাঙালি সাইকোলজিস্ট একটা মোক্ষম কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘রাগ জিনিসটা আসলে একটা পারফর্মিং আর্ট।’’ কথাটা মনে গেঁথে গিয়েছে, বুঝলি। খেয়াল করে দেখবি, কোন ঘটনায় কে কী ভাবে রেগে যায়, রিঅ্যাক্ট করে, তার একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন আছে। কোনও একটা পরিস্থিতিতে আমাদের কী করা উচিত, সেটা আমরা অবচেতনে পুরনো স্মৃতি থেকে ঝালিয়ে নিই। তার পর, আগের পারফর্ম্যান্সটাই রিপিট করি।

‘‘অবিশ্যি, মতভেদ আছে। সটান টুকে দিই, না কি বিশ্লেষণ করে নিই, তা নিয়ে তর্ক আছে মনস্তত্ত্ববিদদের মধ্যে। এক দল বলবেন, আমাদের অতীত আচরণ থেকে আমরা আসলে বোঝার চেষ্টা করি, আমি লোক কেমন— মাথা গরম, না কি সহনশীল, আমি দয়ালু, সেন্স অব হিউমার আছে কি না, এমন হাজারটা জিনিস। তার পর, সেই লোকটা এই পরিস্থিতিতে কী করত, সেটা ঠিক করে নিয়ে সেই কাজটা করি। কিন্তু, মোদ্দা কথা হল, ক্লুগুলো আসে অতীত থেকে।’’

‘‘বুঝুন ব্যাপারখানা!’’ তপেশ বলে ওঠে, ‘‘এক দিকে কনজ়িউমারিজ়ম, অন্য দিকে রাগ, আবেগের পুরো স্পেকট্রামটাই দেখছি অতীতের হাতে।’’

‘‘শুধু অতীত নয়, ভবিষ্যৎও।’’ টেবিলে নামিয়ে দিয়ে যাওয়া ডবল এসপ্রেসো শটে চুমুক দিয়ে বললেন শিবুদা। ‘‘তপেশের জন্য দুঃসংবাদ আছে, কিন্তু তার আগে একটা কথা স্পষ্ট করে নেওয়া ভাল— আমরা অনুভূতি ভুলে যাই, কিন্তু আচরণ মনে রাখি। তোর মনে আছে, শেষ কবে মেট্রোতে কারও সঙ্গে প্রচণ্ড ঝগড়া করেছিস? কী কারণে ঝগড়া হয়েছিল, সেটাও হয়তো মনে আছে। কিন্তু, ঠিক সেই মুহূর্তে তোর মেজাজ কেমন ছিল, সম্পূর্ণ অন্য কোনও কারণে টেনশনে ছিলি কি না, রেগে ছিলি কি না, চেষ্টা করলেও মনে করতে পারবি না। অথবা, এখন যে হেতু তোকে জিজ্ঞেস করছি, ঠান্ডা মাথায় ভেবে হয়তো উত্তর দিতে পারবি, কিন্তু আবার যদি মেট্রোয় কেউ তোর পা মাড়িয়ে দেয়, তোর সে দিনের রাগের কথা মনে পড়বে, কিন্তু মেজাজ খারাপের অন্য কারণ মনে পড়বে না। কী কাণ্ড— এক দিনের খারাপ মেজাজ কিন্তু একটা পরিস্থিতিতে তোর আচরণের পথ বেঁধে দিল।’’

‘‘সে তো বুঝলাম, কিন্তু দুঃসংবাদটা কী?’’ তপেশ অধৈর্য হয়।

‘‘আগে বল, সে মেয়েটাকে নিয়ে খেলা দেখতে গেলি, ব্যাপারটা কিছু এগোল?’’ শিবুদা প্রশ্ন করেন।

তপেশ এক গাল হাসে। ‘‘ক্যাফেতে এত আগ্রহ কেন, সেটা বুঝলেন এ বার?’’ শিশির ফুট কাটে।

‘‘এ বার তুই বুঝবি, তোর ভবিষ্যৎও কেন আবেগের হাতে।’’ শিবুদা বললেন। ‘‘উঁহু, প্রেমের আবেগ নয়। এত ক্ষণ যে আবেগের কথা হচ্ছিল, সেটাই। কোর্টশিপ জিনিসটা গোলমেলে, বুঝলি। সন্ধেবেলা যখন দু’জন ঘুরতে বেরোবি, তখন দু’জনেই সচেতন ভাবে নিজেদের সেরা আচরণটা করার চেষ্টা করবি। সেটা শুধু ভদ্রতার কারণেই নয়, কোর্টশিপের পরিস্থিতিটা যে হেতু দু’জনেরই অচেনা, ফলে প্রতি ক্ষেত্রেই তোদের আচরণের দিকে নিজেদের নজর থাকবে। তাতে সময় কাটবে চমৎকার, কিন্তু মেয়েটাও বুঝবে না তুই কতখানি বজ্জাত, আর তুইও টের পাবি না, মেয়েটা চটলে রণচণ্ডী হয়ে ওঠে কি না। বিয়ের পর যখন সংসারের চাপ এসে প়ড়ে, তখন বোঝা যায়, সেই চাপ কে কেমন ভাবে সামলাতে পারে।’’

‘‘সে আর বলতে! এখন প্রতি দিন উঠতে বসতে বৌয়ের কাছে ঝাড় খাই, আর ভাবি, এই ভদ্রমহিলার সঙ্গেই প্রেম করেছিলাম!’’ শিশিরের দীর্ঘশ্বাস পড়ে। বাকিরা হেসে ওঠে।

‘‘হাসির কথা নয় রে’’, শিবুদা বলেন। ‘‘একটা কাটান অবিশ্যি আছে। ড্যান অ্যারিলি লিখেছেন, দি আপসাইড অব ইর‌্যাশনালিটি বইয়ে। অ্যারিলির পরামর্শ, প্রেমিক বা প্রেমিকাকে নিয়ে কোনও একটা অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস-এ যাও। এমন একটা খেলা, যেখানে দু’জনকে পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করতে হবে, একমত হতে হবে, আর পুরোটাই করতে হবে খুব কম সময়ের মধ্যে। নয়তো মহা বিপদ। অ্যারিলি বলেছেন ‘ক্যানু’-র কথা, কিন্তু সে খেলা আর কলকাতায় পাবি কোথায়? কিন্তু, এমন কিছু খুঁজে নে, যেখানে পরিস্থিতির চাপ তোদের ভিতরের মানুষগুলোকে বার করে আনবে। তখনই বুঝবি, তোদের সম্পর্কটা টিকে গেলে চাপের মুহূর্তে কে কেমন আচরণ করবি। বুঝবি, তোরও শিশিরের মতো ঝাড় নাচছে কি না।’’ হাসেন শিবুদা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন