Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

‘এইচআইভি নিয়েও আর পাঁচটা মানুষের মতোই বেঁচে আছি ১১ বছর’

স্ত্রীয়ের সঙ্গে আর পাঁচ জন সুস্থ মানুষের মতোই জীবনযাপন করতে থাকেন লাল্টু। এরই মধ্যে সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়লেন পম্পা। তখনও তিনি জানলেন না স্বামী এডস-আক্রান্ত। মারণরোগে আক্রান্ত সমাজকর্মী পম্পা দত্তের সঙ্গে কথা বললেন সুস্মিত হালদার তিনি পম্পা দত্ত। নিজেই এইচআইভি পজ়িটিভ।  স্বামী মারা যাওয়ার পরে পরীক্ষা করা হয় তাঁর রক্তও। ধরা পড়ে তাঁর রক্ত বহন করছে এইচআইভি পজ়িটিভ জীবাণু। এক দিকে, স্বামীকে হারিয়ে সন্তানদের নিয়ে প্রায় পথে বসার মতো অবস্থা, সব হারানোর যন্ত্রণা।

শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৮ ০১:৪২
Share: Save:

তিনি নিজেই উদাহরণ। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে পাশে দাঁড়াতে গিয়ে নিজেকেই প্রতি মুহূর্তে তুলে ধরেন অন্যদের সামনে।

না কোনও সঙ্কোচ নয়, কোনও সামাজিক চাপের কাছে মাথা নত করাও নয়। এডস আক্রান্ত মানুষের ভিতরে বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছেটাকে বাঁচিয়ে তুলে জীবন যুদ্ধে ফিরিয়ে আনতে তিনি অনায়াসে বলতে পারেন— “আমায় দেখুন। আমি বেঁচে আছি এগারো বছর। আরও অনেকগুলো বছর বেঁচে থাকব। আর পাঁচটা মানুষের মতোই।” বলেন— “আমি পারলে আপনি পারবেন না কেন?”

তাতে কেউ কেউ ফিরে আসেন স্বাভাবিক জীবনে। কেউ আসেন না। তিনি কিন্তু থেমে থাকেন না। এডস আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পেলেই ছুটে যান তাঁদের কাছে। কাউন্সেলিং করেন। বোঝানোর চেষ্টা করেন— জীবন বড় সুন্দর। আরও অনেকগুলো দিন বেঁচে থেকে তাকে উপভোগ করতে হবে যে!

তিনি পম্পা দত্ত। নিজেই এইচআইভি পজ়িটিভ। স্বামী মারা যাওয়ার পরে পরীক্ষা করা হয় তাঁর রক্তও। ধরা পড়ে তাঁর রক্ত বহন করছে এইচআইভি পজ়িটিভ জীবাণু। এক দিকে, স্বামীকে হারিয়ে সন্তানদের নিয়ে প্রায় পথে বসার মতো অবস্থা, সব হারানোর যন্ত্রণা। আর অন্য দিকে, মারণ রোগের থাবা। আচমকা গোটা জীবনটাই যেন ডুবে গিয়েছিল নিখাদ অন্ধকারে।

আরও পড়ুন: এ ভাবেও ফিরে আসা যায়!

সেই অন্ধকার থেকেই তিনি নিজেই টেনে তুলেছেন নিজেকে। সম্বল বলতে মনের জোর আর হার না মানার মানসিকতা। নিজেকে মনে মনে বলেছিলেন— “আমায় বাঁচতেই হবে। সন্তানের জন্য। নিজের জন্য!” এখনও সেই বাঁচার লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তবে এখন আর শুধু নিজের জন্য কিংবা নিজের পরিবারের জন্য নয়। এখন লড়াইটা আরও অনেক বড়। এখন তাঁর লড়াই অনেকের জন্য। বহুর জন্য। পম্পা বলছেন— ‘‘লড়াই করা ছাড়া তো আর কোনও বিকল্প পথ খোলা নেই। এখন অনেক উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি বেরিয়েছে। প্রয়োজন শুধু মনের জোর। বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছা। আমি তো দিব্যি বেঁচে আছি! সুস্থ আছি!”

আরও পড়ুন: রেগে যাওয়া আসলে একটা পারফর্মিং আর্ট!

মারণরোগ শরীরে নিয়ে এই পম্পাই এখন নদিয়া জেলার বহু এডস ও এইচআইভি পজ়িটিভ রোগীর বেঁচে থাকার প্রেরণা। তাঁর নিজের জীবনযুদ্ধকে সামনে রেখে এখন পম্পা অনেককেই বিশ্বাস করাতে পেরেছেন— এইচআইভি পজ়িটিভ হলেও দিব্যি বেঁচে থাকা যায়। পম্পার মতো করেই।

জেলা প্রশাসনের এক কর্তা বলছেন, “মেয়েটা নিজেই নিজেকে একটা উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। কী ভাবে লড়াই করে বেঁচে থাকা যায়, কী ভাবে অন্যকে বাঁচিয়ে রাখা যায়, তা ওঁর কাছ থেকে শেখার আছে।”

পম্পার বাবা গ্রামে-গ্রামে কীটনাশক ফেরি করে বেড়াতেন। দুই বিয়ে। পম্পা তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান। কলকাতার বাড়ি ছেড়ে দুই মেয়ে আর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীকে নিয়ে তিনি শক্তিনগরে বাড়ি কিনে বসবাস করতেন। জীবনটা চলছিল ভালই। ছোট্ট মেয়েটি বাবার আদরে একটু একটু করে বড় হয়ে উঠছিল। কিন্তু সেই সুখ বেশি দিন স্থায়ী হল না। কঠিন অসুখে পড়লেন তাঁর বাবা। চিকিৎসার জন্য একে একে সব বিক্রি হতে থাকল। এমনকি, শেষ পর্যন্ত বাড়িটাও বিক্রি করে দিতে বাধ্য হলেন মা। এক সময় যখন বাবার মৃত্যু হল, তখন সব শেষ। বেঁচে থাকার ন্যূনতম সম্বলটুকু পর্যন্ত নেই। যাকে বলে পথে বসার মতো অবস্থা।

এর মধ্যে কৃষ্ণনগরেই বিয়ে হয়ে গিয়েছে দিদির। মায়ের হাত ধরে চলে এলেন ভীমপুর এলাকায় মামার বাড়ি। সেখানেই কোনও রকমে মাথা গুঁজে দিন যাপন মা-মেয়ের। পড়া হল না অষ্টম শ্রেণির বেশি। চলে এলেন কৃষ্ণনগরের দিদির বাড়ি। চলতে থাকল সেলাইয়ের কাজ করা। বেঁচে থাকার লড়াই।

২০০২ সালে হঠাৎই একদিন বিয়ের সম্বন্ধ এল। পাত্র অঞ্জনাপাড়ার লাল্টু দত্ত। স্ত্রী মারা গিয়েছে। প্রথম পক্ষের দুই মেয়ে। কিন্তু স্বচ্ছল পরিবার। লাল্টুর গেঞ্জির কারখানা। বিয়ে হয়ে গেল তাঁর সঙ্গে। আগের পক্ষের দুই মেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু হল পম্পার। কিন্তু সে সুখও স্থায়ী হল না বেশি দিন। ২০০৪ সালে গলব্লাডারে স্টোন ধরা পড়ে লাল্টুর। ভেলোরে গেলেন চিকিৎসা করাতে। সঙ্গে পম্পাও। সেখানেই লাল্টুর এডস ধরা পড়ে। কিন্তু সবটাই তিনি গোপন করে রাখেন স্ত্রী পম্পার কাছে। শুধু তাই নয়, স্ত্রীয়ের সঙ্গে আর পাঁচ জন স্বাভাবিক-সুস্থ মানুষের মতোই জীবন যাপন করতে থাকেন। এরই মধ্যে সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়লেন পম্পা। তখনও তিনি জানলেন না কিছুই। এ দিকে, শরীরের অবস্থাও দিন দিন খারাপ হতে থাকে তাঁর স্বামীর।

ক্রমশ শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল মানুষটা। এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন পম্পা। ছেলের বয়স যখন দু’মাস, তখন সব শেষ। একেবারে শেষ মুহূর্তে দেখা করতে এসেছিলেন কলকাতার মহাজন। তাঁকেও প্রথম দিকে রোগ সম্পর্কে কিছুই জানাতে রাজি হলেন না তিনি।

শেষ পর্যন্ত জোরাজুরিতে মৃত্যুর দু’দিন আগে লাল্টু জানালেন রোগের নাম— এডস।

সেই ভেলোরের ধরা পড়া রক্তের রিপোর্ট লুকিয়ে রেখেছিলেন দেওয়ালে টাঙানো কালীঠাকুরের ছবির পিছনে। সেখান থেকে নামানো হল রিপোর্ট। তখন আর কিছুই করার নেই। মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়লেন লাল্টু। আর পম্পার জন্য রেখে গেলেন এক অনিশ্চিত জীবন। দিয়ে গেলেন মারণ রোগ।

লাল্টু দত্ত মারা যাওয়ার পরে সরকারি হাসপাতাল থেকে রক্ত পরীক্ষা করা হল। সেখানে জানা গেল, পম্পার শরীর বহন করছে এইচআইভি পজ়িটিভ জীবাণু। তখনও তিনি এই বিষয়ে জানতেন না বিশেষ কিছুই। শুধু জানতেন, এই রোগ হলে কেউ আর বেঁচে থাকে না। সরকারি হাসপাতালে কাউন্সেলিং করার সময়ই পম্পা প্রথম বিস্তারিত ভাবে জানলেন নিজের রোগ সম্পর্কে।

পম্পাদেবী বলেন— “রোগ সম্পর্কে আমায় প্রথম যখন জানানো হল, তখন আমার চারপাশটা পুরো অন্ধকার। ছেলের মুখটা মনে পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল, দুই মেয়ের কথা। নিজেকে বোঝালাম— হারলে চলবে না। যেমন করেই হোক বেঁচে থাকতে হবে। সন্তানদের জন্য।”

সেই শুরু। প্রতি মুহূর্তে নিজেকে নিজেই কাউন্সেলিং করেছেন। নিজের মনকে নিজেই জোর দিয়েছেন। সান্ত্বনা দিয়েছেন। মনে জোর এনেছেন লড়াই করার। তত ক্ষণে ব্যবসা লাটে উঠেছে। সংসারে চরম অভাব। এক দিকে, পম্পার এমন এক মারণ রোগ। অন্য দিকে, প্রায় একঘরে হয়ে যাওয়া। অভিভাবকদের চাপে শিক্ষকেরা পম্পার সন্তানদের আর স্কুলে পাঠাতে বারণ করে দিলেন। কেউ তাদের সঙ্গে তেমন মিশতে চায় না। সামাজিক ভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়া মেয়েটি কিন্তু তখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

ঠিক সেই মুহূর্তে এগিয়ে এল পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা। তাঁরাই প্রথম দাঁড়ালেন পম্পার পাশে। পাশে দাঁড়াল মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর। কাটল সেই একঘরে অবস্থা।

এর পর? আবারও শুরু হল নতুন লড়াই। পম্পা সদস্য হলেন নদিয়া ডিস্ট্রিক্ট পিপিল লিভিং উইথ এইচআইভি-এডস সোসাইটির। তাদের সঙ্গে মেলামেশার পাশাপাশি শুরু হল স্বেচ্ছাসেবকের কাজ— এই রোগে আক্রান্ত পুরুষ ও মহিলাদের নিয়ে কাজ করা। তাঁদের কাউন্সেলিং করানো। তাঁদের মধ্যে মনের জোর ফিরিয়ে আনানো। এ ভাবেই কাটতে থাকে দিন। বেঁচে থাকার নতুন দিশা খুঁজে পান পম্পা।

তাঁর কাজে আন্তরিকতা দেখে সংস্থার কর্তারা এক দিন তাঁকে সর্বক্ষণের কর্মী হিসাবে কাজ করার প্রস্তাব দিলেন। এর ফলে একদিকে যেমন তিনি এই মারণরোগে আক্রান্ত মানুষগুলির পাশে তাঁদের বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সঙ্গে থাকতে পারবেন, তেমনই পম্পার নিজের সংসারের অভাব কিছুটা হলেও ঘুচবে বলে মনে করলেন তাঁরা।

শুরু হল আরেক লড়াই। বর্তমানে পম্পা নদিয়া জেলার এডস-বিরোধী লড়াইয়ের প্রচারে অন্যতম প্রধান মুখ। সরকারি নথিভুক্ত এই সংস্থায় নদিয়ার আউট রিচ ওয়ার্কার। কাউন্সেলিংয়ের পাশাপাশি এডস ও এইচআইভি পজ়িটিভ রোগীদের চিকিৎসা থেকে শুরু করে যাবতীয় দায়িত্ব পালন করে থাকেন তিনি। আর এই কাজে তাঁর প্রধান শক্তি তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতা।

দিন কয়েক আগে কৃষ্ণনগরের কাছে একটি গ্রামে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল না এডস-আক্রান্ত এক রোগীকে। খবর পেয়ে পম্পা ছুটে গিয়েছিলেন সেখানেও। এক গ্রাম লোকের সামনে বলেছিলেন— “এই দেখুন, আমিও এই রোগে আক্রান্ত। কই, আমার তো কিছুই হয়নি! দিব্যি সুস্থ আছি।”

বলেছিলেন, “আমার কাছাকাছি যাঁরা থাকেন, তাঁদের তো কিছুই হয়নি।” শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছিলেন গ্রামবাসীরা। গ্রামে নিজের বাড়িতে ঢুকতে পেরেছিলেন ওই এডস-আক্রান্ত রোগী।

তবে স্বামীর প্রতি অভিমান রয়েছে গিয়েছে এখনও। সব জেনেও কেন তিনি স্ত্রীকে কিছু বলেননি? কেন চিকিৎসা করাননি নিজের? তা হলে তো রক্ষা পেত দু’টো জীবন। পম্পা সেই দিনের কথা মনে করে এখনও আপসোস করেন— “ভেলোরে একদিন চিকিৎসক দেখি ওঁকে আলাদা করে ঘরের ভিতরে নিয়ে গিয়ে কী সব বললেন। বেরিয়ে আসার পরে জানতে চাইলাম যে, কী বললেন চিকিৎসক? উনি বললেন, তেমন কিছু নয়। রক্তে একটু সমস্যা ধরা পড়েছে, ব্যস। আর কোনও দিন এ নিয়ে আমার সঙ্গে কোনও কথা হয়নি। ওঁর জীবন যাত্রাতেও কোনও প্রভাব পড়তে দেখিনি কখনও।”

কী করে নিজের কথা প্রকাশ্যে আনেন পম্পা? সঙ্কোচ বোধ হয় না? নতুন করে একঘরে হওয়ার ভয় হয় না? চোয়াল দু’টো শক্ত হয়ে যায় পম্পার। বলেন— ‘‘রোগ যৌনসঙ্গীর কাছে চেপে রেখে, চিকিৎসা না করালে তো কারও কোনও লাভ নেই। এই কথাটা বোঝানো দরকার। বরং আমার জীবন সকলের সামনে তুলে ধরে এই রোগে আক্রান্তদের মনে বেঁচে থাকার সাহস জোগাতে পারি।’’

পম্পা তাই লড়াই করে চলেছেন। সমাজের জন্য। একদিন যে সমাজ তাঁকে একঘরে করে রেখেছিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Social Woker HIV AIDS Woman
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE