Advertisement
E-Paper

এই লড়াই বহু কিছু শেখাল! আর কেউ আমাদের উপহাস করবে না! লিখলেন ৩২ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের যৌথ পরিবারের সদস্য

বাইরে তখন আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের ঝড়। সেই ঝড়ে সশরীরে শামিল হতে পারিনি ঠিকই। কিন্তু আমার মনের ভিতরেও তখন উথালপাথাল চলছিল। সত্যিই তো, এই জয় আমার শিক্ষকবন্ধুদের জয়, আমার জয়।

রিপন সাহা

রিপন সাহা

শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ১২:৪৮
কলকাতা হাই কোর্টের রায় শোনার পর প্রাথমিক শিক্ষকদের উল্লাস। ছবি: পিটিআই।

কলকাতা হাই কোর্টের রায় শোনার পর প্রাথমিক শিক্ষকদের উল্লাস। ছবি: পিটিআই।

শুনতে পাচ্ছ? হ্যালো…হ্যালো!

ফোনটা কেটে গেল। পরক্ষণেই আবার ফোন, ‘‘রিপন শুনতে পাচ্ছ?’’ ফোনের ওপার থেকে আবার কাঁপা কাঁপা গলা ভেসে এল। আবেগ আর কান্না চেপে রেখে কথা বললে যেমন শোনায়, ঠিক তেমনই। সহকর্মী শিক্ষক আমাকে কী বলতে চাইছেন, তত ক্ষণে বুঝে গিয়েছি। কারণ, হাসপাতালের টিভিতে ভাসছে, ‘চাকরি বহাল রইল ৩২ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের’। ফোনটা আবার কেটে যাওয়ার আগে সহকর্মী কোনওমতে শুধু বললেন, ‘‘আমরা জিতে গিয়েছি। আমাদের নিয়ে কেউ আর উপহাস করতে পারবে না।’’

বাইরে তখন আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের ঝড়। সেই ঝড়ে সশরীরে হাজির থেকে শামিল হতে পারিনি ঠিকই। কিন্তু আমার মনের ভিতরেও তখন উথালপাথাল চলছিল।

৩ ডিসেম্বর, বুধবার দিনটা আমার মতো ৩২ হাজার শিক্ষকের জীবনে একটা অন্যতম বড় দিন হয়ে থাকবে। হয়তো আজীবন। গত দু’তিন দিন ধরে হাসপাতাল আর বাড়ি ছোটাছুটি করছি। স্ত্রী হাসপাতালে ভর্তি। ওর হাতে একটা অস্ত্রোপচার হয়েছে। ওকে নিয়ে ভিতরে ভিতরে একটা টেনশন কাজ করছিলই। বুধবার হাসপাতালের কেবিনে ওর বেডের পাশেই বসেছিলাম সকাল থেকে। মনের ভিতর উথালপাথাল। আর কিছু ক্ষণের মধ্যে কলকাতা হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায় বেরোবে। মহামান্য বিচারপতিরা রায় দেবেন আমাদের দীর্ঘ লড়াই নিয়ে। একেক বার মনে হচ্ছিল, সব কি ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে? আবার পর ক্ষণেই মনে হচ্ছিল, নাহ! বিচারব্যবস্থার উপর আস্থা আছে। অন্যায় যখন করিনি, জয় আমাদের হবেই। ঘনঘন মোবাইল দেখছিলাম। হাই কোর্ট কী রায় দেবে?

শেষপর্যন্ত বেলা আড়াইটে নাগাদ জানতে পারলাম, চাকরি বহাল থাকছে ৩২ হাজার শিক্ষকের। চাকরি থাকছে আমারও। মুহূর্তে চোখের সামনে ভেসে উঠল গত আড়াই বছরের গ্লানি, ‘চাকরিহারা’ তকমা, সর্বোপরি আমাদের লড়াইয়ের দিনগুলো। বুধবার বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী এবং বিচারপতি ঋতব্রতকুমার মিত্রের ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছে, দুর্নীতি হয়েছে। তবে এত শিক্ষকের চাকরি বাতিল করে দেওয়া যাবে না। ৯ বছর ধরে তাঁরা চাকরি করেছেন। চাকরি বাতিল করলে তাঁদের পরিবারের উপরেও প্রভাব পড়বে। মূলত মানবিক কারণেই চাকরি বাতিলের নির্দেশ খারিজ করেছে আদালত।

ফোন আর থামছিল না। বন্ধু-সহকর্মীরা একের পর এক ফোন করছেন। ফোন আসছে। কিন্তু কারও সঙ্গে কোনও কথা হচ্ছে না। শুধু আনন্দাশ্রু। দু’পারেই। সেই অশ্রুর সঙ্গে মিশে ছিল আমার মতো ৩২ হাজার শিক্ষক আর তাঁদের পরিবারের আড়াই বছরের গ্লানি এবং লড়াইয়ের কাহিনি।

আমার বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার মসলন্দপুরে। যে ৩২ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি বাতিল করেছিলেন কলকাতা হাই কোর্টের তৎকালীন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, আমি তাঁদেরই একজন। ২০১৭ সালে প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি পেয়েছিলাম। পোস্টিং হয় বসিরহাটে। পরে বদলি হয়ে মসলন্দপুরেরই একটি স্কুলে শিক্ষকতা করছিলাম। সব ঠিকঠাকই চলছিল। তার পরেই শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি নিয়ে সারা রাজ্যে হুলস্থুল পড়ে গেল। একের পর এক মামলা, পাল্টা মামলা! তার কোপ এসে পড়ল আমাদের মতো শিক্ষকের পরিবারে। ২০২৩ সালের ১২ মে কলকাতা হাই কোর্টের এক বিচারপতি এক ধাক্কায় ৩২ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি বাতিল করার রায় দিলেন। দিশেহারা লাগছিল। পরিবার, সংসার, সন্তানদের নিয়ে কী ভাবে বাঁচব? খাব কী? বাবার হৃদ্‌যন্ত্রে অস্ত্রোপচার, সংসারের চাপ— সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছিল। অসহায় লাগছিল। তার পর থেকে শুরু হয়েছিল বেঁচে থাকার লড়াই। নাওয়া-খাওয়া ভুলে শুরু হল চাকরি বাঁচানোর আন্দোলন। সেই লড়াই শুধু জীবিকার ছিল না, লড়াই ছিল আত্মসম্মান ফিরে পাওয়ার। লড়াই ছিল সমাজে তৈরি হয়ে যাওয়া মিথ্যা প্রচারের বিরুদ্ধে। লড়াই করেছিল উজ্জয়িনী, সায়ন, অভিজিৎ, শুভজিৎ, সুমিত, উর্জ্জিতা, অঙ্কন, অর্ণব, অরিন্দম, দীপ্তেন্দু, শুভেন্দু, পার্থ, সপ্তর্ষি, শাহিন, ঈর্ষাদ, গালিব, মিঠু, সন্দীপন, সঞ্জীবের মতো আমার হাজার হাজার সহকর্মী, সহযোদ্ধা।

অবশেষে আমাদের জয় এল বিচারব্যবস্থার হাত ধরে। ৩ ডিসেম্বর আমরা ৩২ হাজার শিক্ষক আর তাদের পরিবার নতুন করে বাঁচার রসদ পেল। প্রতিটা লড়াই যেমন কিছু শিক্ষা দেয়, তেমন এই লড়াইও আমাদের বহু কিছু শিখিয়ে দিয়ে গেল।

এই লড়াইয়ে আমরা শিখেছি, লেগে থাকলে জয় পাওয়া যায়। কখনও দিল্লি ছুটতে হয়েছে। কখনও কলকাতা থেকে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। আমরা কেউ পিছিয়ে যাইনি। এই কলুষিত সমাজে খুব সহজেই যাঁরা কাউকে ‘চোর’ বলে দাগিয়ে দিতে পারেন, লড়াই ছিল তাঁদের বিরুদ্ধেও। লড়াই ছিল একদল আইনজীবীর বিরুদ্ধে, যাঁরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যে কোনও স্তরে যেতে পারেন! আমাদের এই লড়াইয়ে সারা রাজ্য জুড়ে একটা পরিবার তৈরি হয়েছিল। যারা একসূত্রে বাঁধা পড়েছিল অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে। যে পরিবার দেখাল, কোনও বাহ্যিক প্ররোচনায় পা না দিয়ে লক্ষ্যে অবিচল থেকে এগিয়ে যেতে হয়। দেখে আশ্চর্য লাগছে যে, এখনও অনেকে মেনে নিতে চাইছেন না আদালতের এই রায়। অনেকে ভাবছেন, তাঁরা কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানাবেন। অসুবিধা নেই। এতটা পথ যাঁরা হেঁটে দেখিয়েছেন, বাকিটা পথটাও তাঁরা অনায়াসে পার করবেন। আমাদের লড়াই জারি থাকবে। সমাজের যে অংশের আস্থা অর্জন করা বাকি আছে, আমরা সেটাও অর্জন করব। দরকার হলে আবার দিল্লি যাব। সম্ভব হলে যেদিন আনন্দবাজার ডট কম-এর জন্য এই লেখা লিখছি, আজ সেই শুক্রবারই।

(লেখক প্রাথমিক শিক্ষক। মতামত তাঁর নিজস্ব)

Teachers Recruitment
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy