Advertisement
E-Paper

এসআইআর দেখাচ্ছে বুথে বুথে ভোটার তালিকায় পাঁচ ধরনের ভূতের বাসা! সেই পঞ্চভূত কারা, খুঁজে পেল আনন্দবাজার ডট কম

ভূতেদের আশীর্বাদ পাওয়ার ক্ষেত্রে শাসকদলই সবসময় এগিয়ে থাকে। এক সময় থাকত সিপিএম। এখন তৃণমূল তাতে আগুয়ান বলে দাবি বিরোধীদের। যদিও অনেকের মতে, ভূতেরা নাচে না। তাদের নাচাতে জানতে হয়।

শোভন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ১১:৪০
ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনের কাজ চলছে।

ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনের কাজ চলছে। ছবি: পিটিআই।

গুপি গাইন গান গেয়ে বলেছিল, বাবা ভূত, ছানা ভূত, খোঁড়া ভূত, কানা ভূত, কাঁচা ভূত, পাকা ভূত, সোজা ভূত, বাঁকা ভূত-সহ আরও হাজার ভূতের রাজার দয়া আছে তার এবং তার দোসর বাঘা বাইনের উপর। সত্যজিৎ রায়ের প্রয়াণের সঙ্গেই গুপি-বাঘার ছবিরও অন্ত হয়েছে। কিন্তু ভূতের শেষ হয়নি। ‘গুগাবাবা’র জগৎ থেকে ভূতেরা এসে আস্তানা গেড়েছিল পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায়।

রাজ্য জুড়ে ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) শুরু হওয়ায় বুথে বুথে সেই ভূতেদের হদিস মিলতে শুরু করেছে। একটা সময়ে এই ভূতেদের ‘দয়া’ ছিল সিপিএমের সঙ্গে। রাজ্যে ক্ষমতার পটবদলের পরে সেই ভূতেদের ইজারা নিয়েছিল তৃণমূল। ভূতরক্ষার প্রক্রিয়া আরও আধুনিক করেছিলেন একদা তৃণমূলের দু’নম্বর নেতা মুকুল রায়। অধুনা গুরুতর অসুস্থ মুকুলই তৃণমূলের হয়ে নির্বাচন সামলাতেন বছরের পর বছর। সে কারণেই তিনি ছিলেন মূলত ‘নেপথ্যচারী’। তাঁর কাজও ছিল ভোটার তালিকা নিয়ে ‘নিবিড় নিরীক্ষণ’। যেমন সিপিএম আমলে সেই ‘নিরীক্ষণ’ করতেন রবীন দেব।

তবে সত্যজিতের ছবির গানের মতো মতো পশ্চিমবঙ্গে ‘হাজার ভূত’ নেই। এসআইআর প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর থেকে এ রাজ্যের ভোটার তালিকায় খোঁজ মিলছে পাঁচ রকম ভূতের। বিরোধীদের অভিযোগ, এই ভূতেদের দাপটেই তারা নির্বাচনে সে ভাবে কল্কে পায়নি বা পাচ্ছে না। নইলে রাজ্য রাজনীতির ছবি অন্যরকম হত।

বাসি ভূত

এই ভূতুড়ে ভোটার হল মৃত ভোটারের একটি প্রকার। ‘বাসি’, কারণ তাঁরা মারা গিয়েছেন অনেক বছর আগে। কিন্তু এখনও ভোটার তালিকায় তাঁদের নাম রয়ে গিয়েছে। আসলে যত্ন করে তাঁদের নামগুলি ভোটার তালিকায় রেখে দেওয়া হয়েছে। এই ভূতেরাই তালিকায় সবচেয়ে ‘সক্রিয়’ বলে রাজনৈতিক দলগুলির খাতাপত্র বলছে। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক দলের কাছে এঁরা সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছেন। এঁদের পাশাপাশি তিন-চার বছর আগে মৃতদের নামও রয়েছে ভোটার তালিকায়। তাঁরাও পরিভাষায় ‘বাসি’ ভূত। আবার অনেক জায়গায় আরও বেশি বাসি ভূতেরও হদিস মিলছে।

টাটকা ভূত

এটিও মৃত ভোটারেরই প্রকার। এটি দ্বিতীয় প্রকার। বাসি ভূতের পাশাপাশি এঁরা হলেন টাটকা ভূত। এই ভোটারেরা গত এক বা দেড় বছরের মধ্যে মারা গিয়েছেন। তার পরেও ভোটার তালিকায় নামের সংযোজন-বিয়োজন প্রক্রিয়া হয়েছে। কিন্তু এই ভূতেদের ভোটার তালিকায় যত্নভরে রক্ষা করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন সূত্রে খবর, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত যত ভূত তারা ধরতে পেরেছে, তাদের মধ্যে সিংহভাগই বাসি এবং টাটকা ভূত।

হাওয়া ভূত

এই ভূতেরা হলেন যাঁরা ঠিকানা বদলেছেন। কেউ কোনও বসত থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে অন্যত্র চলে গেলে তাঁর বা তাঁদের সম্পর্কে বলা হয়, ‘হাওয়া’ হয়ে গিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় এমন হাওয়া ভূতেদেরও ছড়াছড়ি দেখছে নির্বাচন কমিশন। ভোটের পরিভাষায় এই হাওয়া ভূতেদের বলা হয় স্থানান্তরিত ভোটার। এঁদের ঠিকানা বদলালেও পুরনো ঠিকানার ভোটার তালিকা থেকে তাঁদের নাম হাওয়া হয়নি। এঁরাও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের (মূলত ক্ষমতাসীন) কাজে লাগেন। যে দলের সংগঠন মজবুত, তাঁদের কাছে এঁদের বিস্তারিত তথ্য থাকে। ভোটের দিন সে সব কাজে লাগানো হয়ে থাকে।

ডবল ভূত

এই চতুর্থ প্রজাতির ভূতেরা ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে গ্রাম, মফস্সল এমনকি শহরের বুথে বুথে। অর্থাৎ, একই ব্যক্তির নাম রয়েছে একই কেন্দ্রের দু’টি জায়গায়। কোথাও কোথাও একই কেন্দ্রের না হলেও দেখা যাচ্ছে তাঁর নাম রয়েছে পার্শ্ববর্তী কোনও বিধানসভা কেন্দ্রের ভোটার হিসাবে।এই ‘ডবল’ ভূতেরা অনেক সময় ‘ট্রিপল’ হয়েও আবির্ভূত হয়েছেন। অর্থাৎ, একই ব্যক্তির নাম রয়েছে তিনটি এলাকায়। এসআইআর প্রক্রিয়া শুরু পরে এই ধরনের ভূতেদের অস্তিত্ব খুঁজতে নির্বাচন কমিশন একটি নির্দিষ্ট সফ্‌টঅয়্যারের সাহায্য নিচ্ছে। নাম ‘ডেমোগ্রাফিক সিমিলার এন্ট্রিজ়’। অর্থাৎ, কোনও ভোটারের নাম দুই বা তার অধিক জায়গায় থাকলে এই সফ্‌টঅয়্যার তা চিহ্নিত করতে পারবে।

পরিযায়ী ভূত

শ্রমিকদের মতো ভূতেরাও পরিযায়ী হন। ভোটার তালিকা ছাঁকনিতে ফেলার পরে এমন অনেক পরিযায়ী ভূতেদেরও হদিস মিলছে রাজ্য জুড়ে। এই ভোটারেরা আসলে এ রাজ্যের লোকই নন। কর্মসূত্রে পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন। ভোটার তালিকায় নামও তুলেছেন। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি আদতে যে রাজ্যের বাসিন্দা, সেখানকার তালিকাতেও তাঁর নাম রয়েছে। কমিশন সূত্রের খবর, উত্তর কলকাতা এবং শহর হাওড়ার একাধিক বিধানসভায় এই ধরনের পরিয়ায়ী ভূতেদের খোঁজ মিলছে। যাঁদের নাম রয়েছে বিহার বা উত্তরপ্রদেশে তাঁদের আদত ঠিকানার ভোটার তালিকাতেও।

তবে ‘সক্রিয়তা’র নিরিখে বাসি এবং টাটকা ভূতেরাই ভোটার তালিকায় বেশি সক্রিয়। অন্তত রাজনৈতিক দলগুলির ‘অভিজ্ঞ’ নেতা-কর্মীরা তেমনই জানাচ্ছেন। দ্বিতীয় স্থানে তার পর হাওয়া ভূত এবং ডবল ভূত। পরিযায়ী ভূতেরা ঠিক ভূত বেশে বুথে যান না। কিন্তু আসলে তাঁরা ভূতই। সাধারণত ভূতেদের ‘আশীর্বাদ’ পাওয়ার ক্ষেত্রে শাসকদলই সবসময় এগিয়ে থাকে। যেমন একটা সময়ে এগিয়ে থাকত সিপিএম। রাজ্যে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র বদলের পরে তৃণমূল আগুয়ান। অন্তত বিরোধীদের তেমনই দাবি। তবে ভোটের দিন ভূতেরা নিজেরা নাচেন না। তাঁদের নাচাতে জানতে হয়। সাংগঠনিক জোরই হল সেই নাচনের মূল কথা। যা একটা সময়ে ছিল সিপিএমের। প্রবীণ রাজনীতিকদের স্মৃতি বলছে, পশ্চিমবঙ্গে বাম জমানাতেও কংগ্রেস তাদের ঘাঁটিতে ভূতুড়ে ভোটারদের কাজে লাগিয়েছে।

এমন ভূতেদের ধরতে অবশ্য নির্বাচনের দিন বুথে সজাগ এবং সতর্ক থাকতে হয়। ফলে এসআইআর প্রক্রিয়ায় অধিকাংশ ভূত তাড়ানো গেলে বুথে বুথে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সেই কাজের ভার অন্তত খানিকটা কমবে। বিজেপি বলছে, ভূত তাড়াতেই তো এসআইআর! সে কারণেই শাসক তৃণমূল এত উদ্বিগ্ন। তৃণমূল অবশ্য পাল্টা বলছে (যেমন যে কোনও শাসকদলই বলে), ভোট দেন মানুষ। ভূতেরা নয়। মানুষই তৃণমূলকে ফের জেতাবেন।

এসআইআর কি সত্যিই বুথে বুথে ভূতের নাচন ঠেকাতে পারবে? প্রকাশ্যে বিজেপি-সহ বিরোধীরা নানা কথা বললেও, একান্ত আলোচনায় তারাও মানছেন, সব ভূত তাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে না। কিছু ভূত থেকেই যাবে। কত ভূত তাড়ানো গেল, তা মোটামুটি স্পষ্ট হবে ১৬ ডিসেম্বর। ওই দিনই খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করবে কমিশন।

SIR West Bengal Election Commission
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy