করদাতার অর্থে দরিদ্রের জন্য নানা সরকারি পরিষেবার ব্যবস্থা হইয়াছে। সে সকলের পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে ‘মজন্তালী সরকার’। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর কাহিনির এই চতুর মার্জার নিজেকে রাজার প্রতিনিধি ঘোষণা করিয়া বনের প্রাণীদের নিকট কর আদায় করিত। সর্বপ্রকার সরকারি পরিষেবা প্রার্থীদের নিকট অর্থ আদায় করে মনুষ্যরূপী মার্জারকুল। তাহাদের সন্তুষ্ট না করিলে সরকারি দফতরে ফাইল নড়িবে না, পুলিশি তদন্তের রিপোর্ট মিলিবে না, আদালতে মামলা উঠিবে না, বিধবা কিংবা প্রতিবন্ধী ভাতা পাইবে না। ইহাতে নূতনত্ব নাই। তবু মরণাপন্ন সন্তানের চিকিৎসার পথ রোধ করিয়া যাহারা পিতার নিকট উৎকোচ আদায় করিতে চায়, তাহাদের দেখিলে শিহরন জাগে। বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস-এর স্টোরকিপার পলাশ দত্ত দোষী কি না, আদালত বলিবে। কিন্তু এক যুবক যে দীর্ঘ অপেক্ষার পরেও বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়াছেন, চিকিৎসকের নির্দেশ সত্ত্বেও তাঁহাকে একটি ‘স্টেন্ট’ জুগাইতে পারেনি সরকারি হাসপাতাল, তাহাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। সরকার বিনামূল্যে চিকিৎসায় ব্যবস্থা করিয়াছে, কিন্তু রোগী তাহার নাগাল না পাইয়া মরিতেছে। কারণ মজন্তালী-রাজ। শিশুপাঠ্য কাহিনির অরণ্যে প্রতারক পরান্নভোজী একটিই ছিল। আজ নাগরিক নির্মাণে সরকারি ব্যবস্থার অভ্যন্তরে চলিতেছে অপর এক ব্যবস্থা, যাহা তেমনই সুগঠিত। সন্দেহ, চিকিৎসক হইতে প্রশাসক, সকল স্তরে কর্মীদের একাংশের সহিত এই গোপনচক্রের যোগ রহিয়াছে বলিয়াই তাহা অক্লেশে চলিতেছে।
অমিত মণ্ডলের পিতা তাঁহার সন্তানের প্রাণরক্ষায় হাসপাতালের নানা আধিকারিকের নিকট আবেদন-নিবেদন করিয়াও ব্যর্থ হইয়াছেন। দীর্ঘ নয় মাস ধরিয়া তাঁহার অভিযোগ গুরুত্ব পায় নাই। যে কোনও সরকারি পরিষেবার দ্বারস্থ হইলে এমনই অসহায় হইয়া পড়েন নাগরিক। এ ক্ষেত্রে কেবল এই ইঙ্গিত মিলিল যে, রোগীর পরিবারের সাধ্যের সহিত, অথবা রোগীর প্রয়োজনের তীব্রতার সহিত সরকারি চিকিৎসার দালালদের চাহিদার কোনও সংযোগ নাই। এ বিষয়ে তাহারা নিষ্করুণ, অতিমাত্রায় পেশাদার। বেসরকারি হাসপাতাল রাজনৈতিক চাপে পড়িয়া বিল কমাইতে বাধ্য হইতেছে, রাজনৈতিক নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় পুষ্ট দুর্বৃত্তেরা সরকারি চিকিৎসার বিক্রয়মূল্য এক পয়সা কমাইতে রাজি নহে— করুণ রসিকতা বটে। সরকারি চিকিৎসা নাকি বিক্রয়মূল্য নির্ধারিত হইয়াই আছে— হেরফের হইবার জো নাই!
সরকারি হাসপাতালে দুষ্টচক্র ভাঙিবার চেষ্টা কম হয় নাই। কখনওসখনও দুই-এক জনকে পুলিশ ধরে নাই, এমন নহে। কিন্তু তাহাতে পরিস্থিতি বদলায় নাই। অথচ সরকারি হাসপাতালে রোগী কল্যাণ সমিতির শীর্ষে রহিয়াছেন তাবড় তাবড় নেতা-মন্ত্রীরা। রোগীর কী রূপ কল্যাণ হইতেছে, তাঁহারা কি জানেন না? অমিত মণ্ডলের মৃত্যুর নৈতিক দায় কি এসএসকেএম হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির সদস্যরা এড়াইতে পারেন? মজন্তালী-রাজ কী করিয়া চলিতেছে, তাহা না বুঝিবার মতো নির্বোধ রাজ্যবাসী নহে। অর্থের লালসা প্রাণ লইলে মানুষের ধৈর্যের সীমা লঙ্ঘিত হয়। সময় থাকিতে সতর্ক হউন।