চাষি ফসল বেচবেন কী করে

যদি এতগুলো সম্ভাবনা মানা যায়, তা হলেও মেলে না উত্তর। অধিকাংশ দরিদ্র চাষি ভাগচাষ, ঠিকাচাষ করে খান। তাঁরা কী করে সরকারি দর পাবেন? সরকারি দরে ফসল কিনতে যে টাকা দরকার, কেন্দ্র তার ত্রিশ শতাংশ বরাদ্দ করছে।

Advertisement

অভীক সাহা

শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কুলতলিতে সে দিন হঠাৎ দেখা দিয়েছে একটা ছোটখাটো পাহাড়। তার চেহারা ঘন সবুজ, চকচকে, স্বাদ তেতো। করলার দাম বাজারে এক টাকা কিলোগ্রাম, তাই চাষিরা রাস্তার মধ্যিখানে ঢেলে দিয়েছেন সাধের ফসল। চাষিরা নিরুপায়, কারণ ন্যূনতম সহায়ক দামে সব্জি কেনার নীতি নেই পশ্চিমবঙ্গে। বাজারে আলু বা অন্য সব্জির দাম বেড়ে গেলে এই সরকারই কোমর বেঁধে নামে দাম নিয়ন্ত্রণ করতে। কিন্তু চাষি যাতে ফসলের ন্যায্য দাম পান, চাষের খরচ যাতে ওঠে, সেটা সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে।
কেবল পশ্চিমবঙ্গ নয় অবশ্য। দেশ জুড়েই সব্জি কিংবা শস্য খাওয়ার মানে হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রকারান্তরে দুর্বল চাষির রক্তমাংস খাওয়া। এর প্রধান দায় কেন্দ্রীয় সরকারের, যা প্রতি বছর চব্বিশটি ফসলের ন্যূনতম দাম ঘোষণা করে, কিন্তু চাষি দাম পেলেন কি না, দেখতে যায় না। এ বছরটা কিন্তু অন্য রকম হওয়ার কথা ছিল। ২০১৮ সালের সাধারণ বাজেটে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেন, ফসল যেন সহায়ক মূল্য পায়, সরকার তা দেখবে। এর পর তিনি সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার নীল নকশা প্রকাশ করেন। তার নাম প্রধানমন্ত্রী অন্নদাতা আয় সংরক্ষণ অভিযান। সংক্ষেপে, পিএম-আশা।
ঘোষণার পর দিন, ১৩ সেপ্টেম্বর, খুব গরম হরিয়ানায়। বৃষ্টি হয়ে ফসলের ক্ষতি হয়েছে, ভ্যাপসা গরম, রেওয়ারির আনাজ মান্ডিতে বসে সূর্যের প্রখর তাপ অগ্রাহ্য করে পিএম-আশা’র কাগজপত্র দেখে বোঝার চেষ্টা চলছে ব্যাপারটা কী, হঠাৎ কানে এল একটা হাসি। বজরার জন্য ঘোষিত সরকারি দর (১৯৫০ টাকা কুইন্টাল) পাওয়ার দাবিতে জড়ো হয়েছেন হাজার খানেক চাষি। তাঁদের মধ্যে কে হাসছেন, ঠাহর করা গেল না, মনে হল যেন রোদে-পোড়া মানুষগুলোর বুক থেকে একযোগে উঠছে ওই অবিশ্বাসের হাসি। সরকারের একটা কথাও ভরসাযোগ্য নয় তা বুঝলে এমন করেই হাসে মানুষ।
পিএম-আশা’র কাগজ পড়ে দেখা গেল, ওই হাসির প্রতিধ্বনি নিজের মধ্যেও টের পাওয়া যাচ্ছে। পরিকল্পনার প্রতিটি শব্দের আগে নিরুচ্চারে বলা আছে ‘যদি’, ‘কিন্তু’, ‘হয়তো’, ‘সম্ভবত’। যদি ফসল কেনার পরিকাঠামো তৈরি করা যায়, তা হলে হয়তো চাষি সরকারি দর পাবেন। যদি ‘ভাবান্তর’ প্রকল্প কাজ করে, তা হলে হয়তো চাষি সরকারি দর আর বাজার দরের ব্যবধানের টাকাটা পাবেন সরকারের থেকে। কেন্দ্র খুব জোর পঁচিশ শতাংশ ফসল কেনার টাকা দেবে। যদি রাজ্য সরকার বাকি টাকা দেয়, তা হলে সব চাষি সরকারি দর পেতেও পারেন।
যদি এতগুলো সম্ভাবনা মানা যায়, তা হলেও মেলে না উত্তর। অধিকাংশ দরিদ্র চাষি ভাগচাষ, ঠিকাচাষ করে খান। তাঁরা কী করে সরকারি দর পাবেন? সরকারি দরে ফসল কিনতে যে টাকা দরকার, কেন্দ্র তার ত্রিশ শতাংশ বরাদ্দ করছে। বাকি টাকা আসবে কোথা থেকে? সরকারি দরে ফসল বেচতে যে বাজার সংযোগ প্রয়োজন, তার পরিকাঠামো কই? চাষি ফসল বেচবেন কী করে?
যে চাষিরা ফসলের দামের দাবিতে জড়ো হয়েছেন, তাঁরা হয়তো প্রকল্পের খুঁটিনাটি জানেন না। কিন্তু শূন্য প্রতিশ্রুতি শুনে শুনে তাঁদের বিশ্বাস রাখার ক্ষমতাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। চার বছরের খরা আর বন্যা সয়েও ভেবেছিলেন, চাষির রোজগার দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি যখন প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন, নিশ্চয়ই তার উপায়ও ভেবেছেন। অর্থমন্ত্রী জেটলি ১ ফেব্রুয়ারি বাজেট ভাষণে বলেন, তিনি নীতি আয়োগকে এমন কোনও ব্যবস্থা সুপারিশের দায়িত্ব দিয়েছেন, যাতে চাষিরা ফসলের সহায়ক মূল্য পান।
সেই ঘোষণার পর রবি মরসুমের ফসল বিক্রি হয়ে গেল। খরিফ ফসলের বেচাকেনা যখন শুরু হল, তখন সরকার নতুন ঘোষণা করল। ৪ জুলাই কেন্দ্র ‘ঐতিহাসিক’ ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঘোষণা করল। সেই ঘোষণা ঘিরে যা হইচই হল তাতে চাপা পড়ে গেল এই কথাটা যে, ওই ‘ঐতিহাসিক’ বর্ধিত দাম আসলে ২০০৯ সালে ইউপিএ সরকার ঘোষিত দামের চাইতে কম। এর পর সেপ্টেম্বরে পিএম-আশা ফের ‘ঐতিহাসিক ঘোষণা’ বলে পেশ করা হল দেশের সামনে। মিডিয়াতে প্রধানমন্ত্রীর জয়গান শুরু হল। চাষি চেয়ে রইলেন শূন্য হাতে। পরিবর্তন বলতে শুধু এইটুকু হয়েছে যে, সরকার তার বাজেটে সহায়ক মূল্যে ফসল কেনার জন্য যা ধার্য করেছিল তা ছিল হাস্যকর, মাত্র দু’শো কোটি টাকা। এ বার সেটা বেড়ে ষোলো হাজার কোটি টাকা করা হল। সরকার এ-ও ঘোষণা করেছে যে, যে সব এজেন্সির মাধ্যমে সরকার ফসল কেনে, তারা ব্যাঙ্ক থেকে ৪৫ হাজার কোটি টাকা ধার নিতে পারবে। কিন্তু এই ঋণের জন্য সরকার কেবল গ্যারান্টি দিয়েছে, রাজকোষ থেকে কোনও টাকা দেয়নি।
প্রতি বারই ঘোষণার পরে নানা রাজ্যের বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গিয়েছে, ঘোষিত মূল্যের চাইতে অনেক কম দামে ফসল বিক্রি হচ্ছে। পিএম-আশা ঘোষিত হওয়ার দিন মহারাষ্ট্রে ও মধ্যপ্রদেশে মুগডাল পৌঁছে গিয়েছিল মান্ডিগুলোতে। সহায়ক মূল্য ৭০০০ টাকা কুইন্টাল, বিক্রি হল ৩৯০০ থেকে ৪৪০০ টাকা কুইন্টাল দরে। মধ্যপ্রদেশের মুগচাষির মুখেও বাংলার করলাচাষির মতো তিক্ত স্বাদ।

Advertisement

ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন