শান্তিসংগ্রাম: যুদ্ধ কোনও পথ হতে পারে না, এই স্লোগান নিয়ে পাকিস্তানে নাগরিক মিছিল, মহিলারা সামনের সারিতে, লাহৌর, ২৮ ফেব্রুয়ারি। এএফপি
কোনও প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন মানে দেশদ্রোহ। প্রশ্ন মানে অ্যান্টিন্যাশনাল, পাকিস্তানি।— দেশের শাসকদের সঙ্গে দেশবাসীও যখন তারস্বরে এ সব প্রচার করতে শুরু করেন, প্রশ্ন শুনলেই প্রশ্নকারীকে বরখাস্ত গণধোলাই ধর্ষণের প্রতিশ্রুতি শুনিয়ে দেন, তেমন একটা পরিবেশেই — কী মুশকিল— দেশের নামে একটার পর একটা গোঁজামিল ধরা পড়ছে। ভারতের সামরিক বাহিনী বালাকোট বিমানহানায় হতাহতের হিসেব দিতে প্রস্তুত নয় বলা সত্ত্বেও শাসক দলের সভাপতি হাঁক দিলেন— আড়াইশো! মন্ত্রী বলছেন, মশা মেরে কেউ সংখ্যা গোনে নাকি, এ দিকে খবর, উপগ্রহছবিতে বোমাবর্ষিত অঞ্চলে এখনও বাড়িঘর সটান দাঁড়িয়ে। মহা জ্বালা— প্রশ্নও বারণ, হিসেবও মিলছে না। কাক্কেশ্বরের মতো মাথা নাড়ব তারও জো নেই, কেননা রাজাকে ছাপিয়ে পারিষদরা শতগুণ রাগ করছেন— রাজার প্রতি বিশ্বাস আর ভক্তির অভাবই হল কলিযুগের কালসর্প, সাপকে পিষে থেঁতলাতে হবে!
এই মোদীযুগীয় দাপটে আকাশ যখন অন্ধকার হয়ে আসছে, এমন সময় ইমরান খান একটা কাণ্ড বাধালেন! চিরকালের ঝগড়ুটে দেশ পাকিস্তান, পায়ে পা লাগিয়ে অশান্তি করা স্বভাব। সেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এমন একটা কথা বললেন, যা শুনে বলতে ইচ্ছে করে ‘ঐতিহাসিক’। সত্যিই, ইতিহাস খুঁজলে এমন দৃষ্টান্ত মিলবে কি যেখানে ভারত বলছে ‘যুদ্ধ চাই’, আর পাকিস্তানের মুখে ‘শান্তি চাই’?
মোদীপ্রেমীরা বলছেন, এ হল মোদীম্যাজিক। তাঁদের কথা বাদ রাখাই ভাল, কারণ তাঁরা সূর্য উঠলেও মোদীনামের জাদু দেখেন। কিন্তু এও তো ঠিক, ‘ঐতিহাসিক’-এরও একটা কার্যকারণ থাকে। ইমরান খানের হলটা কী? এক দিকে জঙ্গি পুষে অন্য দিকে শান্তির ললিত বাণী কেন শোনাচ্ছে তাঁর দেশ? তিনি কোনও আদর্শবাদী মসিহা নন, আমরা ভালই জানি। তাঁর দলের পিছনে কট্টর ইসলামিদের আশীর্বাদ আছে, সেও আমরা জানি। তা হলে?
তা হলে তাঁর ‘ঐতিহাসিক’ বাক্যটিকে একটু অন্য ভাবে দেখা ভাল। ‘গিভ পিস আ চান্স’— এ হয়তো ঠিক গদগদ আদর্শ, বা শান্তি-মৈত্রীর সুমহান উচ্চারণ নয়। হয়তো এর পিছনে আছে পাকা মাথার হিসেব, বাস্তববাদী বোঝাপড়া। কিন্তু তাতেও তাঁর ভূমিকাটা কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায় না। এই কথাটাই কয়েক দিন ধরে মনে হচ্ছে— শান্তির নীতি যদি কূটনীতিও হয়, সেটা কিন্তু ফেলনা নয়। সেটা দুর্বলতার লক্ষণ নয়, অহিংসার মহৎ দর্শনও নয়। অনেক সময় শান্তি চাওয়া একটা ‘কৌশল’ হতেই পারে। যে সব সমস্যা আছেই এবং থাকবেই, সেগুলোকে বোমা-গুলি-ড্রোন-বিস্ফোরণের পথে না টেনে নিয়ে গিয়ে আস্তে ধীরে মেটানো যেতে পারে, না মেটানো গেলেও চাপাচুপি দিয়ে রাখা যেতে পারে। সম্ভবত ইমরান খানের শান্তিবাক্য এমনই একটি কৌশলবাক্য। নরেন্দ্র মোদীরা আবার এ দিকে ‘কৌশল’ বোঝেন না, তাঁদের চোখে শত্রুর সঙ্গে বোঝাপড়াটা মশা মারার মতোই। ভারত-পাকিস্তান ইতিহাসটা জানলে সকলেই বুঝবেন, বর্তমান পাক প্রধানমন্ত্রী যে ভাবে উত্তেজনার প্রশমন ঘটালেন, তার দৃষ্টান্তও ইতিহাসে বিরল, আবার বর্তমান ভারতের মতো এতটা যুদ্ধবাজ সরকারও সাত দশকে দেখা যায়নি।
এই প্রসঙ্গে কতকগুলো কথা মনে রাখা ভাল। প্রথমত, ইমরান খানের পক্ষে এই অবস্থান নেওয়া সহজ ছিল না। মোদী সরকার থেকে শুরু করে সাধারণ ভারতীয়ও যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুঙ্কার তুলছেন, সেই সময় পাকিস্তানি জনতার একটা বড় অংশের খেপে উঠে ভারতকে ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে চাইবার কথা। পাকিস্তানের কিছু সংবাদপত্রে সেই খেপচুরিয়াস মেজাজটা ধরাও পড়েছে। ভারতের বালাকোট আক্রমণের উত্তরে পাকিস্তানের বিমানও নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর বোমা ফেলেছে, বুঝিয়ে দিয়েছে, ভারত যুদ্ধের দিকে এগোলে তারাও প্রস্তুত। অর্থাৎ নরমে গরমে একটা দ্বিমুখী নীতি নিচ্ছে পাক রাষ্ট্র— সেটাই তাদের ‘কৌশল’। জইশ-ই-মহম্মদ সংগঠনটি পাক সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক সংগঠনের কাছ থেকে সমর্থন পেয়ে এলেও, অভিনন্দনকে মুক্তি দেওয়ার পর পরই জইশ নেতা মাসুদ আজহারের ছেলে ও ভাইকে আটক করা হল, সেটাও হয়তো এই কৌশলেরই অংশ।
দ্বিতীয়ত, ভারত নিশ্চয় জানে, পাকিস্তানের অবস্থাটা এত জটিল যে একটিমাত্র মাত্রায় তাকে বিচার করাটা বোকামি। পাকিস্তান একই সঙ্গে সন্ত্রাসের সমর্থনদাতা এবং সন্ত্রাসের শিকার। গত দশ বছরে অ-যুদ্ধকালীন সন্ত্রাসহানায় বিশ্বের সর্বাধিক বিধ্বস্ত দেশের নাম: পাকিস্তান। ২০০৮-১৮ সালের মধ্যে প্রায় ষাট হাজার সাধারণ মানুষ (২০১৬ সালেই কুড়ি হাজার), পঁচিশ হাজারের বেশি সেনা নিহত হয়েছেন জঙ্গি হানায়। তালিবান-সহ বহু ছোট বড় জঙ্গি গোষ্ঠীর অবদান এর পিছনে। একটি সমীক্ষা বলছে, ২০০৪ সালে পাকিস্তানে ৪১ শতাংশ মানুষ সন্ত্রাসকে বড় সমস্যা বলে ভাবতেন, ২০১৩ সালে সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ৮৯ শতাংশ। সে দেশের বাবা-মায়েরা আজ ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠিয়ে আতঙ্কিত হয়ে ভাবেন, আর তারা বাড়ি ফিরবে কি। মসজিদে যাওয়ার সময় ভাবেন, হয়তো বাড়ির লোকের মুখ দেখবেন না আর। এই দুটো উদাহরণ দিলাম এ জন্য যে, গত কয়েক বছরে বিরাট সংখ্যক জঙ্গি হানা নেমে হয়েছে ও দেশের ইস্কুল আর মসজিদের উপরই।
তৃতীয়ত, ঠিক এই কারণেই ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণা করেও পাকিস্তানকে শত্রু দেশ হিসেবে ঘোষণা করতে পারেনি আমেরিকা, কেননা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সর্বাধিক সহায়তা দরকার হয়েছে— পাকিস্তানের কাছ থেকেই। পুলওয়ামার পর আমেরিকা ব্রিটেন ফ্রান্স পাকিস্তানকে কড়া হাতে জঙ্গিদমন করতে বলেছে, কিন্তু ভারতের কথা শুনে তাদের বয়কট করার কোনও চেষ্টা করেনি। নৌকায় পা দিয়ে যারা চলে, দুই নৌকায় পা দিয়েই তাদের ঠেকাতে হয়, এক নৌকায় পা দিয়ে লড়লে অন্য পক্ষ অন্য নৌকাটায় উঠে নাগালের বাইরে পালিয়ে যেতে পারে— পুরো পাকিস্তানটাই হয়ে যেতে পারে সন্ত্রাসবাদের আখড়া। আমেরিকা, এবং চিনও, এ কথা বুঝেই সতর্ক পা ফেলে। ভারতকেও সতর্ক হতে হবে। সন্দেহ নেই, ভারতের দিক থেকে পাকিস্তানের বিরোধিতা এড়ানো মুশকিল। ১৯৪৭ সাল থেকেই বিরুদ্ধতা দুই দেশের জন্মসূত্রে প্রাপ্ত রোগ। কিন্তু যুদ্ধ দিয়ে সেই রোগের চিকিৎসা সম্ভব নয়। যুদ্ধ বরং অসুখটাকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। পাকিস্তানি নাগরিক যাঁরা আজ ‘ভারতের সঙ্গে মৈত্রী’ চাইছেন, চরম সংঘর্ষ তাঁদের নির্বাক করে সমাজকে আরও চরমবাদী করে দিতে পারে। কিংবা, যে সমস্ত কাশ্মীরি নাগরিক আজও গলা খুলে শান্তির সওয়াল করেন, ভারত-পাকিস্তান শত্রুতা আরও তীব্র হলে তাঁরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারেন, কাশ্মীর সার্বিক ভাবে ভারতবিরোধী ও পাকিস্তানপন্থী হয়ে যেতে পারে। আর, যদি আমরা মেনে নিই পাকিস্তান ইসলামি সন্ত্রাসের ‘একমাত্র উৎস’ নয়, সে ক্ষেত্রে এও স্বীকার করতে হবে যে ভারত পাকিস্তানকে বোমা ফেলে সমুদ্রে ডুবিয়ে দিলেও অন্যান্য দেশের জঙ্গিরা রক্তবীজের মতো কাতারে কাতারে পাক জঙ্গিদের জায়গা নেবে, একই ভাবে মারবে ভারতের সৈনিক আর সাধারণ মানুষদের।
চতুর্থ কথা, এ বারের সংঘর্ষটাকে যদি একটা বড় ক্যানভাসে দেখি, দুটো স্পষ্ট পরিবর্তন দেখব। এক, ভারতের মানুষ আগের থেকে অনেক বেশি জিঙ্গো-জাতীয়তায় উদ্বুদ্ধ, আর পাকিস্তানের মানুষ আগের তুলনায় অনেক প্রকাশ্যত শান্তির দাবিদার! শহরে শহরে শান্তির পক্ষে যে ভাবে জোর স্লোগান দিলেন পাক নাগরিকরা, কিছু দিন আগেও সেটা সম্ভব ছিল না। বিষয়টা কিন্তু হেলাফেলার নয়। বর্তমান পাকিস্তানি তরুণরা সে দেশের প্রথম প্রজন্ম, যাঁদের গণতন্ত্রের জাতক বলা চলে, সে গণতন্ত্র যতই সীমিত চেহারার হোক। এবং সে দেশের বর্তমান মধ্যবয়সিরা সম্ভবত প্রথম প্রজন্ম যাঁরা ভারতবিরোধিতা ছাড়াও পাকিস্তানি রাষ্ট্রের একটা অন্য পরিচয়ের স্বাদ পেয়েছেন। গবেষক মদিহা আফজল তাঁর বইতে এই দরকারি কথাটা মনে করিয়ে দিয়েছেন যে ১৯৪৭ সালে সে দেশে ইসলাম আর ভারতবিরোধিতা ছাড়া আর কোনও আইডেন্টিটি ছিল না, ‘‘বাট নাও দে হ্যাভ আ শেয়ারড্ হিস্টরি অ্যান্ড লাভ ফর দেয়ার কান্ট্রি দ্যাট ক্যান ড্রাইভ ন্যাশনালিজ়ম।’’ এই নতুন প্রজন্মের কাছে জাতীয়তাবাদের অর্থ কেবল ভারতের প্রতি শত্রুতা নয়, তার চেয়ে বেশি কিছু, এবং তার বাইরে অনেক কিছু।
এই কথাটা বোঝা বা মনে রাখার কোনও জায়গাই নেই মোদীযুগীয় ভারতে। এই ভারত শুধু ‘প্রশ্ন’ ভুলিয়ে দিতে চায় না, আইডেন্টিটি-জাত বিদ্বেষ ছাড়া আর সমস্ত রকম সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনকেও ভুলিয়ে দিতে চায়। সন্ত্রাস এই ভারতের কাছে সঙ্কট নয়, কূটনীতির সন্ধান নয়, কেবলই রাজনীতির সুবর্ণসুযোগ!