মেঘনাদের জয়

পাকিস্তান ও চিনের এই ‘অল-ওয়েদার ফ্রেন্ডশিপ’-এর প্রথম ও প্রধান কারণ, ভারত। চিনের ন্যায় মহাশক্তি যদি আপন ক্ষমতা কায়েম রাখিতে এবং তাহাকে আরও বৃদ্ধি করিতে চাহে, তবে পূর্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে ‘নেতৃত্ব’ বজায় রাখিতেই হইবে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৯ ০০:০০
Share:

দিল্লির বিদেশমন্ত্রক সুখে নাই। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে জইশ-ই-মহম্মদের নেতাপ্রবর মাসুদ আজহারকে বিশ্বস্তরের জঙ্গি কিংবা গ্লোবাল টেররিস্ট আখ্যা দেওয়ার প্রক্রিয়াটি শেষ পর্যন্ত আটকাইয়া দিয়াছে চিন। ফলত, ভারত-পাকিস্তান কূটনৈতিক দ্বৈরথে আপাতত দিল্লির পরাজয় ঘটিয়াছে। পনেরো সদস্য সংবলিত নিরাপত্তা পরিষদে এই বার অনেক দেশ এই প্রস্তাবে নিজেদের সমর্থন জানাইয়াছিল, তবুও শেষরক্ষা হইল না। ইহার আগেও পুলওয়ামা জঙ্গি হামলা লইয়া বিবৃতি প্রকাশ করিতে নিরাপত্তা পরিষদে প্রায় এক সপ্তাহ বিলম্ব ঘটিয়াছিল। একই কারণ— চিন। বিবৃতিতে ‘সন্ত্রাসবাদ’-এর উল্লেখ রাখিবার ব্যাপারটিকে তরলীকৃত করিয়াছিল তাহারা। একাধিক সংশোধনীরও দাবি উঠাইয়াছিল। জইশকে ‘বাঁচাইতে’ বেজিংয়ের এই প্রাণপাত কেন? কারণ: পাকিস্তান। প্রসঙ্গত, মার্কিন তৎপরতায় ১৪ ফেব্রুয়ারি জইশ-ই-মহম্মদ দ্বারা সংঘটিত হামলার কড়া নিন্দা করা হইলেও উহাকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ বলিতে এখনও রাজি হয় নাই চিন। ঘটনাটিতে বিস্ময়ের কিছু নাই। ২০০৮ সালের মুম্বই হামলার পর হইতে একাধিক বার মাসুদকে তালিকাভুক্ত করিবার আর্জি জানাইয়াছে ভারত, এবং প্রত্যেক বার নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে চিন একক দায়িত্বে বিষয়টিকে ‘টেকনিক্যাল হোল্ড’ অর্থাৎ কৌশলগত ভাবে স্থগিত রাখিয়াছে। পাকিস্তান সম্পর্কে তাহাদের অবস্থানটি বেশ কিছু বৎসর ধরিয়াই স্থিতিশীল।

Advertisement

পাকিস্তান ও চিনের এই ‘অল-ওয়েদার ফ্রেন্ডশিপ’-এর প্রথম ও প্রধান কারণ, ভারত। চিনের ন্যায় মহাশক্তি যদি আপন ক্ষমতা কায়েম রাখিতে এবং তাহাকে আরও বৃদ্ধি করিতে চাহে, তবে পূর্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে ‘নেতৃত্ব’ বজায় রাখিতেই হইবে। বলিবার অপেক্ষা করে না যে, দক্ষিণ এশিয়ায় চিনের প্রধান শত্রু ভারত। কিছু দিন পূর্বেই মলদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কায় সরকারের নেতৃত্ব বদলের আবহে সেই ছায়াযুদ্ধের কিয়দংশ অভিনীত হইয়া গেল। কাশ্মীর সঙ্কট পাকাইয়া উঠিতেই ফের তৎপর চিন। পাকিস্তান সামান্য বিষোদ্গার করিলে কিংবা পাল্টা বিমান হামলা করিলে কিংবা কোনও জঙ্গিকে আশ্রয় দিলেই বিবৃতি জারি করিয়া বিষয়টিকে লঘু করিবার চেষ্টা করিতেছে তাহারা। পাকিস্তানের পিছনে বেজিংয়ের সমর্থনকে এখন প্রচ্ছন্ন বলা চলে না, তাহা বেশ প্রকট। এই কাজে বেজিং কোনও আন্তর্জাতিক চাপ, এমনকি নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের সকলের বিরোধিতা করিতেও রাজি। আপন অঞ্চলে ক্ষমতা কায়েম রাখিলে তবে না মহাশক্তি!

চিন-পাকিস্তান সৌহার্দ্যের প্রথম কারণ যদি হয় ভারত, তবে দ্বিতীয় কারণটি পাকিস্তান নিজেই। গত শতকের শেষেই প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলিয়াছিলেন, ‘‘ইট’স দি ইকনমি স্টুপিড’’, আর সেই অর্থনীতিই পাকিস্তানকে বেজিংয়ের স্বাভাবিক মিত্রে পরিণত করিয়াছে। পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের উপর দিয়া যাইতেছে চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর। এই প্রকল্পে প্রায় ৬৬০০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করিয়াছে চিন। জইশের বেশির ভাগ প্রশিক্ষণ শিবির এই অঞ্চলেই অবস্থিত, সুতরাং চিন কোনও বেচাল চালিলে অর্থনৈতিক করিডরে হামলা চালাইতে পারে জঙ্গিরা। চিনকে তাহা মনে রাখিতে হইতেছে। অনুমান করা চলে, সেই কারণেই মার্চের গোড়ায় ইসলামাবাদের সহিত বৈঠকে বসিয়াছিলেন চিনের বিদেশমন্ত্রী কং জুয়ানজু। পাকিস্তান প্রশাসনের কাছে আপন প্রকল্পের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দাবি করিয়াছেন তিনি। দাবির পাশেই থাকে প্রতি-দাবি। সুতরাং চিনের করুণাহস্ত পাকিস্তানের উপর প্রসারিত। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দিল্লি যতই হাঁকডাক করুক, মেঘের আড়ালে আছেন মেঘনাদ। আন্তর্জাতিক স্তরে আপন বল প্রতিষ্ঠা করিতে হইলে দিল্লিকে বেজিংয়ের িবরুদ্ধে লড়িবার সামর্থ্য অর্জন করিতে হইবে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন