ডোকলাম। ফাইল চিত্র।
আপাতত ভারত-চিন সংঘাতের পরিবর্তে শান্তির আবহ তৈরি হয়েছে। এ ঘটনায় আমরা সকলেই স্বস্তি পেয়েছি, এ ব্যাপারে তো কোনও মতপার্থক্য নেই। কিন্তু ডোকলাম নিয়ে দু’পক্ষের বিবাদ আপাতত মিটলেও দু’দেশের সম্পর্কে অদূর ভবিষ্যতে যে আবার সংঘাতের পরিবেশ তৈরি হবে না তার গ্যারান্টি কে দেবে?
চিন তার বিদেশনীতিতে যে ক্রমশ আক্রমণাত্মক ও প্রসারবাদী মনোভাব নিচ্ছে, সেটা নিয়েও সন্দেহ নেই। দেশের অভ্যন্তরীণ বৃদ্ধি এবং আর্থিক পরিস্থিতিকে চিন গোটা দুনিয়ার সামনে সাফল্যের সঙ্গে তুলে ধরতে পেরেছে। অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির সাফল্যের পর দেং জিয়াও পিংয়ের সময় থেকেই দেশের বাইরে নিজেদের সার্বভৌম স্বার্থকে প্রসারিত করতে চিন উদ্যোগী হয়।
২০০৫-এর এপ্রিল মাসে চিনের প্রধানমন্ত্রী ভারতে এসে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিতে ভারত-চিন সীমান্ত সংলগ্ন প্রশ্নগুলির নিষ্পত্তির রাজনৈতিক বিশ্বাস ও নির্দেশাবলি ছিল। কিন্তু এই চুক্তির কয়েক মাসের মধ্যেই তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় বুঝতে পারেন, চিন চুক্তি করলেও সব সময় বাস্তবে তা মানে না। এই চুক্তিতে নির্দেশিকা ছিল, অরুণাচল, বিশেষ করে তাওয়াং থাকবে ভারতের অধীনে। চিনের ওই প্রতিশ্রুতিকে ভারত বিশ্বাস করেছিল। ২০০৭-এর জুন মাসে চিনের বিদেশমন্ত্রী প্রণববাবুকে বলেন, কেবলমাত্র স্থায়ী জনসংখ্যার উপস্থিতির যুক্তিতে সীমান্তের ও পারে চিনের দাবি লঘু হয়ে যায় না। প্রণববাবু তখনই বুঝতে পারেন, ২০০৫-এর এপ্রিলের চুক্তি ২০০৭-এর জুনেই চিন মানছে না।
হু জিন তাও ভারতে আসার আগে চিনের রাষ্ট্রদূত সান ইয়াকসি দিল্লিতে ঘোষণা করেছিলেন যে, অরুণাচল প্রদেশ চিনেরই অংশ। আরও কয়েক দিন পর চণ্ডীগড়েও তিনি একই কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। নভেম্বর মাসে চিনের উপদেষ্টা মন্ত্রক, চিনের বিজ্ঞান আকাদেমির এশিয়া শান্তিপ্রয়াসী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং চিনের আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রনীতির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিও এই একই দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। রাজ্যসভায় তখন প্রণববাবু বলেছিলেন, চিনের বিদেশমন্ত্রীর আগমনের আগেই আমি চিনের যুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছি এবং দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়েছি যে, অরুণাচল প্রদেশ ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রণববাবু সংসদে এ কথা বলার পর চিনের বিদেশমন্ত্রক বেশ কিছু দিন চুপচাপ ছিল। তার পর ২০০৭-এর মে মাসে নতুন আইএএস অফিসারদের ১০৭ জন সদস্যের এক প্রতিনিধি দলের শিক্ষামূলক ভ্রমণের উদ্দেশ্যে চিনে যাওয়ার কথা ছিল। তাঁদের মধ্যে এক জন অরুণাচল প্রদেশে ছিলেন বলে চিন তাঁকে ভিসা দিতে প্রত্যাখ্যান করে। ২০০৮-এর জানুয়ারিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ অরুণাচল প্রদেশ সফরে যান। সে বার অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে তাঁর তাওয়াং-এও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চিনের পক্ষ থেকে ঘোরতর আপত্তি জানানো হয়। বলা হয়, যেহেতু অরুণাচল প্রদেশ বিতর্কিত অঞ্চল, তাই তিনি সেখানে যেতে পারবেন না।
২০০৩ সালে চিন সফরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে চিনা প্রেসিডেন্ট হু জিনতাও। ছবি: এএফপি।
২০০৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে চিন গিয়েছিলাম। ’৬২ সালের ক্ষত ভুলে রাজীব গাঁধী চিনের সঙ্গে ভারতের কূটনীতির বরফ গলিয়ে উচিত কাজ করেছিলেন, বাজপেয়ীও উচিত কাজ করেছিলেন ২০০৩ সালে চিন সফর করে। ফলাফল স্বরূপ ভারতের অংশ হিসেবে সিকিমকে স্বীকৃতি দেয় চিন। এর জবাবে ভারতও তিব্বতের স্বশাসিত অঞ্চল ‘চিন সীমানার অন্তর্ভুক্ত’ বলে মেনে নেয়। আমাদের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে চিন তাদের মানচিত্রে চিত্রাঙ্কিত সিকিমের উপর যে দাবি করে আসছিল তা পরিত্যাগ করে। কিন্তু বহু কূটনীতিক পরে জানান যে চিন কিন্তু নিজেদের মানচিত্রে সিকিমের অবস্থান কোনও ভাবেই পরিবর্তন করেনি। ২০০৭-এর নভেম্বর মাসে চিনের সেনাদল সিকিম-ভুটান-তিব্বত সীমান্তের সঙ্গমস্থল ডোকলা অঞ্চলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর দু’টি ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। দু’সপ্তাহ অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই চিনের সেনাবাহিনী উত্তর সিকিমের ‘অঙ্গুলি সমান’ এক ক্ষুদ্র অংশে রাস্তা নির্মাণের কাজ শুরু করেছিল। ২০০৮-এর জানুয়ারি মাসে চিন সরকার সিকিমে ভারতীয় সেনাদলের নিয়মিত কুচকাওয়াজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা জারি করে। ওই বছরেরই জুন মাসে প্রণব মুখোপাধ্যায় যখন বেজিং যান তখন চিন আবার সিকিম প্রসঙ্গ ফিরিয়ে আনে। চিনের প্রধানমন্ত্রী ওই সফরে প্রণববাবুর সঙ্গে তাঁর নির্ধারিত সফর পর্যন্ত বাতিল করে দেন।
তার মানে, চুক্তি যা-ই হোক, চিন কিন্তু ক্রমাগত খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে প্রবল চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে। ভারতকে বিব্রত এবং অশান্ত রাখা যে চিনের উদ্দেশ্য সেটা নিয়েও ভারতীয় কূটনীতিকদের মধ্যে কোনও সন্দেহ নেই। নেহরু যে চিনকে বেশি বিশ্বাস করে খেসারত দিয়েছিলেন, সেটাও অনস্বীকার্য। নরেন্দ্র মোদী যদি নেহরুর রোম্যান্টিসিজম থেকে বেরোতে চান, ভালই তো। ২০১৭ সালের বাস্তবতায় ভারতীয় বিদেশনীতিকে স্থিতাবস্থা থেকে মুক্ত করে ন্যায়ের ঘোর থেকে বেরিয়ে নিরাপত্তা নীতিতে জোর দেওয়া, নিরাপত্তা নীতিকে গড়ে তোলা ভাল কথা। কিন্তু চিনকে ৫৬ ইঞ্চির ছাতি দেখানোর ‘দাবাং’ মানসিকতাও আর এক ধরনের রোম্যান্টিসিজম। প্রধানমন্ত্রী এ বার ডোকলাম বিতর্ক নিরসন করতে কতখানি এগিয়ে কতখানি পিছোলেন সেটাও আমরা, ভারতবাসীরা দেখলাম। কাজেই এ বার বোধহয় চিনকে চিনতে হবে সঠিক ভাবে!