বিশ্ব ক্ষুধাশূন্য, অপুষ্টিহীন হইবে ২০২৫ সালে, এমনই অঙ্গীকার করিয়াছিল ভারত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সকল সদস্য-দেশের ন্যায় ভারতও ২০১৫ সালে এই লক্ষ্যকে গ্রহণ করে। অতঃপর ২০১৮ সালের একটি আন্তর্জাতিক রিপোর্টে প্রকাশ পায়, যে হারে ভারতে অপুষ্টি কমিতেছে, তাহাতে লক্ষ্য অধরা থাকিবে। একটি বিশ্লেষণ বলিতেছে, প্রতি দিন অন্তত আটচল্লিশ হাজার মানুষের অপুষ্টিমুক্তি প্রয়োজন। ভারত বর্তমানে দিনে হাজার দশেক মানুষকে ক্ষুধা-অপুষ্টি হইতে উত্তোলিত করিতেছে। স্পষ্টতই ইহা যথেষ্ট নহে। অত্যন্ত লজ্জার কথা যে, ভারত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতি হইলেও বিশ্বের অপুষ্ট শিশুদের অর্ধেকই বাস করে ভারতে। আরও দ্রুত আরও অধিক মানুষের নিকট খাদ্যের নিরাপত্তা এবং অপুষ্টিমুক্তি পৌঁছাইতে হইবে। কিন্তু তাহাও যথেষ্ট নহে। নূতন সমস্যা আসিতেছে, যেমন অতিরিক্ত ওজন এবং স্থূলত্ব। অপুষ্টির ন্যায় স্থূলত্বও নানা রোগ ডাকিয়া আনে। এই কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পুষ্টির জন্য কেবল ক্ষুধা বা অপুষ্টি নিয়ন্ত্রণকে রাখে নাই, নয়টি সার্বিক লক্ষ্য স্থির করিয়াছে। তাহার মধ্যে শিশুর অপুষ্টি এবং মহিলাদের রক্তাল্পতা কমাইবার লক্ষ্য যেমন আছে, তেমনই স্থূলত্ব, মধুমেহ রোগ কমাইবার লক্ষ্যও আছে।
আক্ষেপ, ইহার মধ্যে একমাত্র শিশু অপুষ্টি হ্রাসের একটি সূচকে কিছুটা সাফল্য পাইয়াছে ভারত। কিন্তু সেই চিত্রও সর্বত্র সমান নহে। বিভিন্ন রাজ্যে বিপুল অসাম্য রহিয়াছে। উত্তরপ্রদেশে আজও প্রায় অর্ধেক শিশু পুষ্টির অভাবে বয়সের তুলনায় দীর্ঘ নহে, কেরলে কুড়ি শতাংশ। খাদ্যের নিরাপত্তা আইন সারা দেশের শিশুকে সমান সুরক্ষা দিতে পারে নাই, তাহা স্পষ্ট। খাদ্যকে শিশুর ‘অধিকার’ বলিলেই পুষ্টিকর খাদ্য তাহার নিকট পৌঁছাইয়া যায় না। পরিবারকে সুলভে চাল-গম সরবরাহ করিলেও শিশুর অপুষ্টি থাকিতে পারে। এমনকী বিত্তবান পরিবারগুলিতেও শিশুদের মধ্যে যথেষ্ট অপুষ্টি মিলিয়াছে, বলিতেছে ওই আন্তর্জাতিক সমীক্ষা। অপর একটি সমীক্ষায় প্রকাশ, দুই বৎসরের কম শিশুদের মাত্র দশ শতাংশের ক্ষেত্রে দৈনন্দিন খাদ্যকে পুষ্টির দৃষ্টিতে ‘সুষম আহার’ বলিতে পারা যায়। কেবল খাদ্যের জোগান নহে, খাদ্যাভ্যাস বদলাইতে হইবে। সম্প্রতি কয়েকটি রাজ্যে শিশুদের মিড ডে মিলে ডিম, পেঁয়াজ-রসুন বাদ দিবার ঝোঁক দেখা গিয়াছে। যুক্তি: ধর্মবিশ্বাস। বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যের দৃষ্টিতে ইহা অতীব আপত্তিকর। যে দেশে এত শিশু অপুষ্ট, সেই দেশে ধর্মের নামে পুষ্টিবঞ্চনা কখনওই সঙ্গত নহে।
কিন্তু প্রশ্ন হইল, নির্বাচনের যুদ্ধে ধর্মবিশ্বাসের প্রতি আনুগত্য গুরুত্ব পাইবে, না কি শিশুর পুষ্টি? এই প্রশ্ন তো কেবল নেতাদের করিলে চলিবে না, দেশের নাগরিককেও ইহার উত্তর দিতে হইবে। উন্নয়নের সূচকগুলি যখন রাজনৈতিক যুদ্ধের অস্ত্র হইয়া ওঠে, তখনই তাহার প্রতি সজাগ হইয়া ওঠেন নেতারা, সক্রিয় হয় সরকার। শিশুমৃত্যুর হার এই ভাবেই রাজনীতিতে আসিয়াছে। শিশুর অপুষ্টি পরিবারের অপারগতা বা অজ্ঞানতার জন্য কখনও প্রাধান্য পায় নাই। এলাকার শিশুর ওজন কম হইলে যদি নেতার ওজন কমে, যদি তাহার ভোটে টান পড়ে, তবেই হয়তো শিশুর ক্ষুধা ও অপুষ্টি বিশেষজ্ঞের পরিসংখ্যান হইতে দেশের সমস্যা হইয়া উঠিতে পারে।