আজ ২১, আজ আমরা বাঙালি

আগেকার দিনের মানুষেরা এই সব বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়ে বাংলাটা যেমন শিখেছেন, ইংরেজি বা হিন্দিটাও শিখেছেন। কিন্তু এখন যেটা উদ্বেগের, তা হল মাতৃভাষার প্রতি এক সার্বিক অনীহা। এটাই ক্ষতিকারক। লিখলেন বিজয়কুমার দাস।আগেকার দিনের মানুষেরা এই সব বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়ে বাংলাটা যেমন শিখেছেন, ইংরেজি বা হিন্দিটাও শিখেছেন। কিন্তু এখন যেটা উদ্বেগের, তা হল মাতৃভাষার প্রতি এক সার্বিক অনীহা। এটাই ক্ষতিকারক।আজ ২১, আজ আমরা বাঙালি

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০৫
Share:

ভাষা দিবস উপলক্ষে ইন্দিরা গাঁধী কেন্দ্রে গানের মহড়ায় বাংলাদেশি পড়ুয়ারা । ছবি: দেবস্মিতা চট্টোপাধ্যায়

ক্যালেন্ডারে ফের ফেব্রুয়ারি। আমরা, বাঙালিরা আবার একটু নড়েচড়ে উঠব। বাংলা ব্যবহারে একটু বেশি সচেতনও হয়ে উঠব হয়তো কতকটা অবচেতনেই।

Advertisement

এ মাস যে ভাষার মাস। আজ ভাষা দিবস। বুক ঠুকে আবার বলার সময় চলে এল, আমি বাঙালি!

আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি আছে। আমাদের উনিশে মে আছে। অথচ বাংলা ভাষাটা হারিয়ে যাচ্ছে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে বাংলাভাষার মর্যাদা দাবি করে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন জব্বার, বরকত, রফিক, সালাম। ১৯৬১ সালের উনিশে মে অসমের শিলচরে বাংলা ভাষার জন্যই প্রাণ দিয়েছেন শচীন পাল, সুনীল সরকার, কানাইলাল নিয়োগী, সুকোমল পুরকায়স্থ, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, তরণী দেবনাথ, বীরেন্দ্র সূত্রধর, হিতেন বিশ্বাস, সত্যেন দেব, কুমুদ দাস এবং কমলা ভট্টাচার্য। প্রতি বছর ফিরে ফিরে আসে একুশে ফেব্রুয়ারি আর উনিশে মে। বাংলা ভাষার জন্য আমাদের আবেগ উথলে পড়ে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এই ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার আদৌ কোনও প্রচেষ্টা আছে কিনা, সেটা ভাবার বিষয়।

Advertisement

সত্যি কথা বলতে বাংলা ভাষা নিয়ে গভীর ভাবে ভাবনার দিন এসেছে। যাতে আগামীতে ভাষাটা আরও বিপন্ন না হয়ে পড়ে। নতুন প্রজন্মের বড় অংশ মাতৃভাষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু দোষ তাদের নয়। দোষ অবস্থার। পরিকাঠামোর। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে এই প্রজন্মের শিক্ষা শুরু হচ্ছে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। খাস কলকাতাতেই ইংরেজি-হিন্দির দাপটে বাংলা ভাষা বিপন্ন। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বাঙালিয়ানাটা হারিয়ে যাচ্ছে। তাই পরিবারের ছেলেমেয়েদের কাছেও বাংলা ভাষা ক্রমে দূরের গ্রহের ভাষা হয়ে যাচ্ছে।

এটাই এখন বাস্তব যে, সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করানোর ঝোঁক অধিকাংশ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের। বলা যায় না, অদূর ভবিষ্যতে হয়তো অধিকাংশ স্কুলেই ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনো চালু হয়ে যাবে। আর আমাদের গর্বের মাতৃভাষা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মুখ থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে। মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দিতে অন্য ভাষাকে পরিত্যাগ করতে হবে, তা কিন্তু নয়। যদি একটু পিছিয়ে যাওয়া যায়, তা হলে দেখা যাবে, আগেকার দিনের মানুষেরা এই সব বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়ে বাংলাটা যেমন শিখেছেন, ইংরেজি বা হিন্দিটাও শিখেছেন। কিন্তু এখন যেটা উদ্বেগের, তা হল মাতৃভাষার প্রতি এক সার্বিক অনীহা। এটাই ক্ষতিকারক। মাতৃভাষার প্রতি যে মমতা গড়ে ওঠা দরকার, তা গড়ে উঠছে না। কবি শামসুর রহমান তাঁর একটি কবিতায় বলেছেন, ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’। এখন চারপাশে তাকালে মনে হয়, বাংলা সত্যিই ‘দুঃখিনী বর্ণমালা’ হয়ে উঠেছে।

অনেকে মনে করেন, এ ক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থার একটা দায় আছে। অতীতের পাঠ্যসূচিতে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের উত্তর দিতে হলে বাংলা লেখা, বাংলা শেখা ও বাংলা বলার একটা প্রয়োজন গড়ে উঠত। কিন্তু এখন পরীক্ষায় যে ধরনের প্রশ্নপত্র, তাতে বাংলা শেখার তেমন দরকার হয় না। অর্থাৎ ভাষা শিক্ষার তাগিদটা কমে যাচ্ছে। আর উত্তরপত্রে যেটুকু লিখে আসছে এই প্রজন্ম, তা গৃহশিক্ষকের লিখিয়ে দেওয়া। ছাত্রছাত্রীদের মনের গভীরে কল্পনাশক্তির উন্মেষ ঘটছে না। বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলিতে তা-ও দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা আলাদা বিষয় হিসাবে রয়েছে। ইংরেজি মাধ্যমে সেটাও না রাখলে চলে। অনেক বাঙালি পরিবারের ছেলেমেয়েরাই দ্বিতীয় ভাষা (সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ) হিসাবে হিন্দিকে বেছে নিতে বেশি স্বচ্ছন্দ। বাংলার আর দোষ কী! সাম্প্রতিক দশকগুলিতে সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর চলটা মধ্যবিত্ত শ্রেণি রপ্তও করে নিয়েছে। অনেক অভিভাবকই সন্তানকে দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে হিন্দি নেওয়ার পরামর্শ দেন নম্বর বেশি ওঠার যুক্তি দেখিয়ে। ফলে, ছোট থেকেই মাতৃভাষা থেকে অনেকটা দূরে সরে যাচ্ছে সেই সব পড়ুয়া। ইংরেজি এবং হিন্দিময় জীবনে বাংলা বই পড়ার অভ্যাসও গড়ে উঠছে না। ফলে, বাংলা থেকে যাচ্ছে নিছকই কাজ চালানো ভাষা হিসাবে।

এক আশঙ্কার ছবি এরই মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। সমাজে যেন এক অলিখিত শ্রেণি-বিভাজন। একটা ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণি, অন্যটি বাংলা মাধ্যমে শিক্ষিত শ্রেণি। এই দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষিতের দল হীনমন্যতায় ভুগবে স্রেফ ইংরেজি ভাষা ভাল করে রপ্ত না হওয়ার কারণে।

আবার এ প্রশ্নও ওঠে অনেক মহলে, প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত বাংলা ভাষা তেমন গুরুত্ব পেয়েছে কি? উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হওয়ার পরে যারা বিজ্ঞান বা বাণিজ্য নিয়ে পড়ে, তাদের সঙ্গে মাতৃভাষার আর যোগ থাকে না বললেই চলে। মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দিতে হলে শিক্ষার সব স্তরেই বাংলা ভাষাকে আবশ্যিক রাখা দরকার বলে অনেকেই মনে করেন।

এখনকার প্রজন্ম আরও একটি ভাষা রপ্ত করে ফেলেছে যা তাদের বাংলাভাষা থেকে আরও দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সেই ভাষাকে ‘বাংরেজি’ বলা যেতেই পারে। অর্থাৎ ইংরেজি অক্ষরমালা ব্যবহার করে তারা বাংলা ভাষার ভাব প্রকাশ করছে। আজকের ডিজিটাল যুগে বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় সঙ্কটের নামই বোধহয় রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রবণতা। ‘আমি তোদের বাড়ি যাব’ লেখা হচ্ছে এই ভাবে —‘ami toder bari jabo’। এর ফলে তারা না শিখছে ইংরেজি, ভাষা, না শিখছে মাতৃভাষা। এই লেখার সঙ্গে তো মাতৃভাষার কোনও যোগই নেই!

মোবাইল ব্যবহারকারীরা অবশ্য যুক্তি দেখাবেন, বার্তা পাঠানোর ক্ষেত্রে রোমান হরফের ব্যবহারই সবচেয়ে সহজ। বাংলা কি-বোর্ড নামিয়ে বাংলার টাইপ করা—সে নাকি এক দুঃসাধ্য কাজ! সত্যিই কি এতটাই দুঃসাধ্য? তা কিন্তু নয়। ইন্টারনেটে বাংলা লেখা মোটেই সমস্যার নয়। এখনকার মোবাইল সেট বা ব্রাউজারে কোথাও বাংলার সীমাবদ্ধতা নেই। এবং চেষ্টা করলেই দিব্যি লেখা যায়। অনেকে লেখেনও। এবং ভালই লেখেন। বোঝা যায়, তাঁদের আন্তরিকতা আছে। মাতৃভাষার প্রতি টান আছে। ‘আমি বাঙালি’ ঘোষণা করেই নিজেকে প্রকৃত বাঙালি প্রমাণ করার চেষ্টা তাঁদের মধ্যে নেই।

আজ ভাষা দিবস। এই দিনটাকে নিয়ে আবেগ স্বাভাবিক। দিকে দিকে ভাষা শহিদদের স্মরণ করা হবে। বাংলা গান হবে, বাংলা কবিতা হবে, বাংলা ভাষার জন্য বক্তৃতা হবে। বাংলা ভাষা বাঁচানোর জন্য আলোচনাসভা হবে। আর বাড়ির এক কোণে বসে হাতে মোবাইল নিয়ে সদ্য কলেজে ঢোকা এক তরুণী তার বন্ধুকে লিখবে—‘aaj bikele paray rabindrasangeet gaibo. kemon sharee pora jay bol to’!

(লেখক নাট্যকর্মীও প্রাক্তন গ্রন্থাগারিক, মতামত নিজস্ব)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন