শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং শিক্ষাঙ্গনের উপরেই দাঁড়িয়ে থাকে একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা। এই তিনের মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন শিক্ষক। যাঁকে আমরা মানুষ গড়ার কারিগর বলি। শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক মানোন্নয়নে এই শিক্ষক সমাজের উপর ভরসা এবং আস্থা থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু শিক্ষা দফতর তথা রাজ্য সরকারের সাম্প্রতিক কিছু সিদ্ধান্ত শিক্ষকদের উপর চরম অনাস্থা প্রকাশ করছে যা শিক্ষক তথা শিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়নে একেবারেই সহায়ক নয়।
এক নির্দেশিকায় বলা হল, ক্লাসে ক্লাসে পোস্টার টাঙাতে হবে। সহজ কথায় বলতে গেলে, কোন ক্লাসে কত দূর পড়াতে হবে তার বিজ্ঞাপন। আর সেটা দেখে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা বুঝতে পারবেন, ক্লাসে ঠিকমতো পড়াশোনা হচ্ছে কি না। অর্থাৎ, অভিভাবকদের সরাসরি শ্রেণি-পাঠ্যে অযাচিত হস্তক্ষেপ। প্রতিটি বিদ্যালয়ে বছরের শুরুতেই ক্লাস, শিক্ষক ও বাৎসরিক রুটিন তৈরি হয়ে যায়। কোন পর্বে, কোন ক্লাসে, কতটুকু পড়াতে হবে সেটা ঠিক করা থাকে। ছাত্রছাত্রীদের কাছেও সেই রুটিন দিয়ে দেওয়া হয় এবং এ ভাবেই একটি পাঠ্যবইয়ের পড়া শেষ হয়। সিলেবাস শেষ না হলে ছাত্র-ছাত্রীরাই বুঝতে পারবে। অভিযোগ করতে পারবে। এগুলো শ্রেণিকক্ষে বড় বড় করে টাঙিয়ে দেওয়াটা শিক্ষকদের প্রতি অসম্মান ও অনাস্থার প্রকাশ।
মধ্যশিক্ষা পর্ষদের এক নির্দেশিকায় পরীক্ষা সংক্রান্ত দায়িত্ব প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে কেড়ে প্রশাসকদের দেওয়া হল। মাধ্যমিকে প্রশ্ন বিতরণ সংক্রান্ত কোনও দায়িত্বে আর প্রধান শিক্ষক থাকছেন না। এত দিন নির্দিষ্ট বিতরণ কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্র নিয়ে আসার পরে তা প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে স্কুলের নির্দিষ্ট ও নিরাপদ কক্ষে থাকত। সেখানে প্রধান শিক্ষকের উপস্থিতিতে প্রশ্নপত্রের প্যাকেট খুলে তা পরীক্ষাকেন্দ্রে পাঠানো হত। পরীক্ষা হলের ইনভিজিলেটর সেই প্রশ্নপত্র ছাত্রছাত্রীদের বিতরণ করতেন। এ ভাবেই বছরের পর বছর সুষ্ঠু ভাবে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা হয়ে আসছে। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, প্রশ্নপত্র সরাসরি পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছবে। সেখানে ইনভিজিলেটর সেই প্রশ্নপত্র ছাত্রছাত্রীদের বিতরণ করবেন। অর্থাৎ পরীক্ষা সংক্রান্ত সিংহভাগ ক্ষমতা থাকছে পর্ষদ নিযুক্ত প্রশাসকদের উপর। এ ক্ষেত্রেও শিক্ষকদের প্রতি অনাস্থা প্রকট হচ্ছে।
সম্প্রতি ‘ট্রান্সফার ইন পাবলিক ইন্টারেস্ট’ বলে নতুন একটি শিক্ষক বদলির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে শিক্ষা দফতর থেকে। সেখানে বলা হয়েছে, কোনও বিদ্যালয়ের প্রয়োজনে যে কোন সময় যে কোনও শিক্ষককে বদলি করা হতে পারে। বলাই বাহুল্য, এটাকে অনেকেই বলছেন ‘পানিশমেন্ট ট্রান্সফার’। বিদ্যালয়ের প্রয়োজনে নয় বরং সরকার বিরোধী আন্দোলন বা কাজকর্ম করলেই তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে দূরে কোথাও বদলি করে দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে এই বদলি চালুও হয়ে গিয়েছে। অন্য দিকে, দীর্ঘ দিন জেনারেল ট্রান্সফার ও মিউচুয়াল ট্রান্সফার বন্ধ। বছরের পর বছর কয়েকশো কিলোমিটার দূরে প্রচুর শিক্ষককে যাতায়াত করতে হচ্ছে। অনেককে আবার পরিবার ছেড়ে দীর্ঘ দিন বাইরে থাকতে হচ্ছে। এ নিয়ে শিক্ষা দফতরের খুব একটা হেলদোল আছে বলে মনে হচ্ছে না।
অতি সম্প্রতি আর একটা নতুন নির্দেশিকা এসেছে। যেখানে বলা হচ্ছে, শারীরশিক্ষার শিক্ষকদের কোনও বিষয়ভিত্তক ক্লাস দেওয়া যাবে না। শারীরশিক্ষার শিক্ষকেরা নিযুক্ত হয়েছেন শারীরশিক্ষা ও খেলাধুলো করানোর জন্য। কিন্তু কথা হল, এখন বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাব রয়েছে। ২০১৩ সালের পরে আর সে ভাবে নিয়োগ হয়নি। এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে কিছু নিয়োগ হলেও বিভিন্ন জটিলতার কারণে মাধ্যমিক বা উচ্চ প্রাথমিকে এখনও নিয়োগ হয়নি। অনেক উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকের অভাবে বন্ধ হওয়ার মুখে। ও দিকে ঘনঘন এসএসসি-র চেয়ারম্যান পরিবর্তন হচ্ছে। যাইহোক, এই অবস্থায় শারীরশিক্ষার শিক্ষকেরা খেলাধুলো করানোর পরেও প্রয়োজনে কিছু ক্লাস নিতেন। কারণ, তাঁদের অনেকেই বিভিন্ন বিষয়ে মাস্টার্স। আমাদের সময়েও এক জন স্বনামধন্য শারীরশিক্ষার শিক্ষক যত্ন সহকারে ভূগোল পড়াতেন ভূগোল শিক্ষক না থাকার কারণেই। এখন এই নির্দেশ জারি করার ফলে কোনও বিশেষ কারণে বা আবহাওয়ার প্রতিকূলতার কারণে খেলাধুলো বন্ধ থাকলে শারীরশিক্ষার ওই শিক্ষক অফিসে চুপচাপ বসে থাকবেন। কোনও ক্লাস ‘অফ’ গেলেও তিনি যাবেন না বা তাঁকে পাঠানো যাবে না। একটা বিদ্যালয় সুষ্ঠু ভাবে চালাতে গেলে প্রধান শিক্ষকও অনেক সময় করণিকের কাজ করেন। বিষয় শিক্ষককেও অনেক সময় কন্যাশ্রী, শিক্ষাশ্রী বা মিডডে মিলের মতো বিভিন্ন বিষয় দেখভাল করতে হয়। কারণ, মিডডে মিল, কন্যাশ্রী, শিক্ষাশ্রী, মাইনোরিটি, এসসি, এসটি, ওবিসি স্কলারশিপ, ডাটা এন্ট্রি, মাসে মাসে বিভিন্ন রিপোর্ট জমা করার মতো নানা কাজে এখন বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ব্যস্ততার অন্ত নেই।
এ দিকে, ন্যায্য বেতন, ডিএ, বদলি-সহ বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করলে তাঁকে বদলি করে দেওয়া হচ্ছে। প্রতিবাদ করলে জুটছে ‘পানিশমেন্ট ট্রান্সফার’-এর অর্ডার। শুধু নির্দেশিকা জারি, কর্তৃত্ব ফলানোর চেষ্টা় বা ‘মাইনে দিই আমি, তাই ছড়ি ঘোরাবও আমি’— এমন মানসিকতা থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে। শিক্ষা সংক্রান্ত বা বিদ্যালয় সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান হোক শিক্ষক সংগঠন বা শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করেই। আস্থা ও ভরসা থাকুক শিক্ষকদের উপরেই।
শিক্ষক, বাইন্ধা জুনিয়র হাইস্কুল