কেরলের সাম্প্রতিক বিপর্যয়কে ‘উত্তরাখণ্ড-২’ নাম দিলে বোধ হয় ভুল হবে না। উত্তরাখণ্ডের বিপর্যয়ে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর পর এই পত্রিকাতেই লিখেছিলাম, ‘‘সতর্কবাণীর কিন্তু কোনও অভাব ছিল না।’’ পাঁচ বছর পর দেশের সব চেয়ে ‘উন্নত’ রাজ্যের পরিণামের ক্ষেত্রেও কথাটি সমান প্রযোজ্য। পার্থক্য একটাই, কেরলের ক্ষেত্রে এই ‘সতর্কবাণী’ অস্বীকার করা হয়েছিল একেবারে সরাসরি বুক ফুলিয়ে। সে সময় রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা ওমেন চান্ডির কংগ্রেস সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশ্রয়ে ‘সতর্কবাণী’কে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। বাদ সাধেনি বিরোধী দলগুলোও। উদ্দেশ্য স্পষ্ট, যাতে তথাকথিত উন্নয়নের নামে পরিবেশ ধ্বংসের খোলা লাইসেন্স দেওয়া যায়, যার সুফল পৌঁছয় সব রাজনৈতিক দলের কর্তাব্যক্তিদের কাছে। ফলাফল, বর্তমানে হাড়ে হাড়ে বুঝছেন কেরলবাসীরা।
২০১১ সালের ৩১ অগস্ট বিখ্যাত পরিবেশবিদ মাধব গ্যাডগিলের নেতৃত্বাধীন এক বিশেষজ্ঞ কমিটি বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা ও গবেষণার পর জানায় যে কেরলের পশ্চিমঘাট অঞ্চল পরিবেশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কমিটি প্রস্তাব দেয় যে প্রায় ১.৩ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারব্যাপী পুরো অঞ্চলকেই ‘ইকোলজিক্যালি সেনসিটিভ এরিয়া’ বা ‘পরিবেশগত ভাবে সংবেদনশীল অঞ্চল’ বলে চিহ্নিত করা হোক এবং তার মধ্যে যে ৬০ শতাংশ অঞ্চল সংরক্ষণের প্রশ্নে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেই অঞ্চলে সম্পূর্ণ ভাবে যাবতীয় প্রকল্প, বিশেষ করে জঙ্গলের সঙ্গে সম্পর্কহীন জমির ব্যবহার হচ্ছে এমন প্রকল্প, যেমন— খনি, উন্মুক্ত খাদান এবং বহুতল ও অন্যান্য নির্মাণ বন্ধ রাখা হোক; ইতিমধ্যে যে প্রকল্পগুলি অতি সংবেদনশীল অঞ্চলে অর্থাৎ ‘ইকোলজিক্যালি সেনসিটিভ এরিয়া ১’-এ প্রস্তাবিত হয়েছে, তাদেরও পরিবেশ ছাড়পত্র দেওয়া যাবে না। একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়লেন রাজনীতিবিদ, খনি বা খাদানের মালিকরা ও আরও কিছু স্বার্থান্বেষী মহল। মাধব গ্যাডগিলকে কেউ পাগল ঠাহরালেন, কেউ বললেন যে গ্যাডগিল কমিটির রিপোর্টের সঙ্গে বাস্তব প্রয়োজনের কোনও সাযুজ্য নেই। অথচ কমিটিতে ছিলেন আরও ১৩ জন বিশেষজ্ঞ, যাঁদের অনেকেই কেন্দ্র ও রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে ছিলেন ও রিপোর্টটিতে একমত হয়েছিলেন।
অতঃপর প্রথমে রিপোর্টটিকে আলমারিতে বন্ধ করে ফেলা হল। যদিও বার বার গ্যাডগিল কমিটি রিপোর্টটি নিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলোচনা করার নিদান দিয়েছিল। ‘আরটিআই’ করেও যখন রিপোর্ট দেওয়া হল না, তখন পরিবেশবিদরা মামলা করলেন ও শেষমেশ আদালতের নির্দেশে ৫২২ পাতার রিপোর্টটি জনসমক্ষে এল। তাতে অবশ্য লাভ কিছু হল না। সরকার তার চালু ফরমুলা প্রয়োগ করে গ্যাডগিল কমিটির রিপোর্ট পর্যালোচনা করতে তৈরি করলেন কস্তুরীরঙ্গন কমিটি; আবার কস্তুরীরঙ্গন কমিটির রিপোর্ট দেখার জন্য ওমান কমিটি! এবং যথারীতি পরবর্তী সরকারি কমিটিগুলির ‘সিদ্ধান্ত’ অনুযায়ী গ্যাডগিল কমিটির রিপোর্টকে অগ্রাহ্য করে সংবেদনশীল পশ্চিমঘাট অঞ্চলের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ হাট করে খুলে দেওয়া হল যাবতীয় পরিবেশ ধ্বংসকারী প্রকল্পের জন্য। তার কারণে যে দূষণ বাড়ল ও প্রাকৃতিক উপায়ে জল নিষ্কাশন হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে গেল এবং কেরলকে আগামী দিনে বিপদের মধ্যে জেনেবুঝে ঠেলে দেওয়া হল; তা জানা সত্ত্বেও স্পষ্টতই তখনকার রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার অন্য দিকে তাকিয়ে ছিল। এই ঘটনা এমন এক রাজ্যে হচ্ছে, যেখানে ঐতিহাসিক ভাবেই বেশি বৃষ্টি হয়, এবং যখন তখন গোটা বর্ষার বৃষ্টি কয়েক দিনে হয়ে যাওয়াটা বর্তমানে ‘নিউ নরমাল’। ফলে ২০১৮ সালের ৯ থেকে ১৫ অগস্টের মধ্যে যে বৃষ্টিপাত গড়পড়তার তুলনায় প্রায় আড়াই গুণ বাড়বে, সেই ভবিষ্যদ্বাণী না শুনলেও কোনও না কোনও বছর বর্ষার কোনও সময় বৃষ্টি হঠাৎ বাড়তে পারে ও তখন বাঁধগুলিকে বাঁচাতে গেলে খুলে দিতে হবে, ভাসবে কেরলের একটা বড় অংশ— এমনটা অনুমান করতে গেলে আইনস্টাইন হওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এই সরল বিষয়টি বুঝতে অস্বীকার করল ২০১১ সালের রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার, অন্য বিরোধী দলগুলি, এমনকি পরবর্তী সরকারগুলিও!
কেরলে যে চারশোর ওপর মানুষ মারা গেলেন, অজস্র মানুষ ঘর হারালেন, বহু পরিবার ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হল, প্রায় কুড়ি হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি নষ্ট হল; এক কথায় গোটা রাজ্যটি হাঁটু মুড়ে বসতে বাধ্য হল, তার দায়ভার কার ওপর বর্তাবে? রাজ্য ও কেন্দ্রীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক দলগুলি, না কি যে পরিবেশ মাফিয়ারা পিছন থেকে আঙুল নেড়েছিল, তাদের ওপর? সম্ভবত সব চেয়ে বড় দায়িত্ব বর্তায় সেই রাজনৈতিক দলগুলির ওপর, যারা ‘বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল’ স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় আসে। প্রকৃতির বিরুদ্ধে অসম যুদ্ধের দিকে যারা ঢাল-তরোয়াল বিহীন বিপন্ন সাধারণ মানুষকে এগিয়ে দিচ্ছেন নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ ও আখের গোছানোর জন্য, তারা নিশ্চিত ভাবেই ‘ইচ্ছাকৃত অপরাধী’, আইনের শাসনকে কোনও ভাবে ঠেকাতে পারলেও নৈতিকতার আদালতে দোষী।
কেরল ব্যতিক্রম নয়। কখনও মুম্বই, কখনও চেন্নাই, কখনও আমাদের কলকাতা শহরে এমন ঘটনা ঘটছে— ‘ম্যানমেড’ (না কি, ‘পলিটিক্স মেড’) বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত হচ্ছে মানুষ। জার্মানির বন শহরে গত জলবায়ু সম্মেলনে উঠে এসেছিল, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে যে দেশগুলিতে সব চেয়ে বেশি মানুষ মারা গিয়েছেন, তার প্রথমেই রয়েছে ভারত। কিন্তু রাজনীতিবিদরা এই উদাহরণ থেকে কোনও শিক্ষাই নিচ্ছেন না, বরং এক শ্রেণির আমলার সাহায্য নিয়ে পরিবেশ ধ্বংস করে তথাকথিত উন্নয়নের পক্ষে সওয়াল করে চলেছেন।
সম্প্রতি আমাদের রাজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী পরিবেশবিদদের ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দিয়েছেন, কেননা তাঁরা আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত ও আদালতের রায়ে সংরক্ষিত পূর্ব কলকাতার জলাভূমির মধ্য দিয়ে জলা বুজিয়ে একটি উড়ালপুল তৈরির সরকারি পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছেন। কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের জল নিষ্কাশনী ব্যবস্থা অনেকটাই পূর্ব কলকাতার এই জলাভূমির ওপরে নির্ভরশীল। তাই সেখানে যে কোনও পরিবেশ ধ্বংসকারী প্রকল্প ইতিমধ্যেই জল জমার কারণে সমস্যায় থাকা শহরের বিপন্নতা আরও বাড়িয়ে দেবে। কেরলের আয়নায় চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে;
কারা দেশদ্রোহী? (চলবে)
ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।