Heat Stroke

সম্পাদক সমীপেষু: তাপের শিকার

খোলা মাঠটি লক্ষাধিক লোকে পরিপূর্ণ থাকলেও যথাযথ তাঁবু বা ছাউনির ব্যবস্থা কেবল কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, ভিআইপি, মিডিয়া এবং নিরাপত্তাকর্মীদের জন্য আলাদা এন্ট্রি-সহ সংরক্ষিত ছিল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০২৩ ০৫:৩০
Share:

প্রখর দাবদাহের মধ্যে বিপুল জমায়েতে সাধারণের মাথার উপর কোনও রূপ শেড ছিল না। ফাইল ছবি।

‘মহারাষ্ট্রে শাহের সভায় হিট স্ট্রোকে মৃত ১১’ (১৭-৪) শীর্ষক সংবাদটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এ সম্পর্কে ওই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্দে বলেছেন, “খুবই মর্মান্তিক ঘটনা।” এটা কিন্তু রাজ্যের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপকদের ব্যর্থতা ও গাফিলতিরও এক চূড়ান্ত নির্লজ্জ নজির।

Advertisement

এ মাসের ১৬ এপ্রিল, নবী মুম্বইয়ের খারঘরের ৩০৬ একরের খোলা মাঠে সরকারি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, মুখ্যমন্ত্রী শিন্দে, উপমুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীস-সহ অন্য মন্ত্রীরা উপস্থিত ছিলেন। খোলা মাঠটি লক্ষাধিক লোকে পরিপূর্ণ থাকলেও যথাযথ তাঁবু বা ছাউনির ব্যবস্থা কেবল কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, ভিআইপি, মিডিয়া এবং নিরাপত্তাকর্মীদের জন্য আলাদা এন্ট্রি-সহ সংরক্ষিত ছিল। প্রখর দাবদাহের মধ্যে বিপুল জমায়েতে সাধারণের মাথার উপর কোনও রূপ শেড ছিল না। সংবাদ সূত্রে জানতে পারি, অনুষ্ঠানের সময় তাপমাত্রা ছিল বিপজ্জনক, ৩৮-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জনতার ভিড় থেকে জলের কলের ব্যবস্থা ২০০ মিটার থেকে ৩০০ মিটার দূরে ছিল, এমন অভিযোগও আসছে। ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চড়া রোদে থাকার কারণে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ১১ জনের মৃত্যু হয় এবং বহু মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাসপাতালে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়ে। সরকারের আবহাওয়া বিভাগ এখানে কেন আগেই কোনও তাপপ্রবাহের সতর্কতা জারি করেনি? চার দিকে অডিয়ো ও ভিডিয়ো জায়ান্ট স্ক্রিনের ব্যবস্থা থাকলেও, এমন তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে সাধারণ মানুষদের মাথার উপরে কোনও ছাউনি বা আচ্ছাদনের বন্দোবস্ত কেন করা হল না?

মুখ্যমন্ত্রী শিন্দে অবশ্য মৃতের আত্মীয়কে ৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু এই ব্যাপারে সরকারি অব্যবস্থা কিংবা কর্তৃপক্ষের বহু কালের এমন দায়িত্ববোধহীন অসংবেদী মানসিকতার সত্যিই কবে পরিবর্তন ঘটবে?

Advertisement

তবে, এ দেশের প্রকাশ্য রাজনৈতিক জনসভায় এমন করুণ ও দৃষ্টিকটু দৃশ্য প্রায়শই দেখা যায় যে, যথোপযুক্ত আচ্ছাদিত উঁচু সুরম্য মঞ্চে উঠে বড় বড় নেতা-মন্ত্রী উচ্চকণ্ঠ বক্তব্য পেশ করলেও, সাধারণ জনতাকে খোলা মাঠে বা ময়দানে কাঠফাটা রোদ বা প্রবল বৃষ্টির মধ্যে উপস্থিত হয়ে তাঁদের দীর্ঘ ক্ষণের ভাষণ শুনতে হয়। এ ক্ষেত্রে আমি মনে করি, মহারাষ্ট্রের ঘটনাটি প্রকারান্তরে একটি জরুরি ও অনিবার্য প্রশ্নকে সামনে তুলে ধরেছে— জনসভায় দূর-দূরান্ত থেকে আসা জনতার সবার মাথার উপর সর্বাগ্রে অস্থায়ী ছাউনি বা শেড-সহ আনুষঙ্গিক পরিষেবার সঠিক ব্যবস্থা না করা হলে, কোনও রাজনৈতিক দলকে বক্তব্য রাখার জন্য ‘বিশেষ আচ্ছাদিত মঞ্চ’ গড়ার অনুমোদনের বিষয়টি ঠিক কতটা বাঞ্ছনীয় ও বিধিসম্মত?

পৃথ্বীশ মজুমদার, কোন্নগর, হুগলি

জলের আকাল

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়ের ‘তাপপ্রবাহ নতুন পথ দেখাচ্ছে’ (২৮-৪) প্রসঙ্গে বলি, এ পথ ধারাবাহিক ভাবে চলে আসছে। শুধু আমরাই সচেতন হয়ে উঠতে পারিনি। তাপপ্রবাহ বাড়ছে আর জল শুকিয়ে যাচ্ছে। জলের স্তর ক্রমশ নিম্নগামী। সে দিন বাসে শুনছিলাম, কোন এক গবেষক নাকি দেখেছেন, পাম্প থেকে জল তুলে এক কেজি ধান তৈরি করতে কমবেশি প্রায় ৮০০ লিটার জল লেগে যায়। ১ কেজি ধানের বিক্রয় মূল্য ২৫-৩০ টাকা। এই শস্য ফলাতে চাষিকে জলের দাম দিতে হয় না। তবে পাম্প চালাতে বিদ্যুৎ খরচ কিংবা শ্যালো চালাতে তেলের খরচ লাগে।

এর ফল যে ভয়ঙ্কর, তা বোঝাই যাচ্ছে। এই ক’বছর আগেও নিম্ন দামোদর উপত্যকায় খণ্ডঘোষ, রায়না ব্লকে ৩০-৩৫ ফুট নীচে জলের স্তর পাওয়া যেত। শীত শেষে ধান কাটা মাঠের ‘কেলেস’ জমিতে দুই-আড়াই ইঞ্চি বেধযুক্ত পাইপের টিউবওয়েল বসিয়ে, হাতে কল টিপেই পেঁয়াজ চাষ করা যেত। হাতে টেপা টিউবওয়েলগুলোর জলের স্তর ক্রমশ নীচে নেমে যাচ্ছে। এখন অনেক জায়গায় কম করে ১০০-২৩০ ফুট বা তারও নীচে অল্পবিস্তর জলের স্তর নেমে গিয়েছে। এখন ‘সেলেন্ডার’ (ডিপ-টিউবওয়েল) কল ছাড়া আর চলে না। গরিব মানুষ কল টিপে দুটো পেঁয়াজ লাগিয়ে খাবে, তার উপায় আজ আর নেই।

ধান চাষ না করলে চাষিরাই বা সারা বছর খাবেন কী? কৃষির ব্যাপারটাকে মাথায় রেখেই স্বাধীনতার পর প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় দামোদরে চারটি বিশাল আকারের জলাধার তৈরি হয়েছিল। কমিশন সমীক্ষা চালিয়ে আরও চারটি বাঁধ প্রস্তুত করার কথা বলেছিল। বৃষ্টি ঠিকঠাক হলে তার চারটেতে জলের জোগান কম থাকার কথা নয়। ক’বছর আগেও ক্যানেল এরিয়াগুলোতে ভাদরের চটকায় ধান জমিতে চাপান দেওয়ার জন্য ক্যানাল বন্ধ রাখতে বলা হত। অথবা, প্রয়োজনমতো ক্যানাল থেকে বার হয়ে আসা পাইপগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হত। গ্রীষ্মে ধান চাষের জন্য দেওয়া জলে মাঠ যেত ভেসে। কিন্তু সেই একটামাত্র জলাধার এত অভাবের মধ্যে আর কত জল সরবরাহ করতে পারে?

প্রস্তাবিত বাকি তিনটিতে পলি জমে জল ধারণ ক্ষমতা অনেক কমে গিয়েছে। জলাধারগুলি পরিষ্কার করা বা নতুন জলাধার নির্মাণের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার আর কোনও নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি। জল সংরক্ষণ করতে না পারায় দক্ষিণ দামোদর উপত্যকা শুকিয়ে যাচ্ছে। এই বছর ধান চাষিদের অবাক করে, এক দিনও বৃষ্টি হয়নি। গ্রীষ্মকালে ধান চাষে ব্যক্তিগত ভাবে যে সব নলকূপ তৈরি করা হয়েছিল, জলের স্তর কমে যাওয়ায় সেই নলকূপ চালানো দমকলগুলিকে বিগত কয়েক বছর ধরে, জমিতে গর্ত কেটে নীচে নামাতে হচ্ছে। আকস্মিক বৃষ্টিতে মাটি চাপা পড়ে বা ধস নেমে সে বিপদও কম হয়নি। উত্তর রাঢ়ে মুর্শিদাবাদের অনেক গ্রামের পুকুরগুলোতে শীত আসার পরে পরেই জল শুকিয়ে যায়। এখন সেটা বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, এমনকি বর্ধমান, বীরভূম জেলাতেও দেখা যাচ্ছে। দক্ষিণ রাঢ়কে সতর্ক করে সে যেন বলতে চায়— “জলে জঙ্গলে আর বাঁচবি কত ক্ষণ?”

অর্থনীতিতে জল অমূল্য সম্পদ। শুধু কৃষি নয়, শিল্প ও পরিবহণ, অরণ্য, স্বচ্ছ অভিযান, তথা সামগ্রিক ভাবে পরিবেশ রক্ষায় জলই জীবনের জিয়ন কাঠি।

একটি হিন্দি প্রবাদে আছে— ‘জল হ্যায় তো কাল হ্যায়’। আগামী দিনের কথা ভেবে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কথা ভেবে, জলের সুরক্ষার ব্যাপারটিকে নিয়ে সর্বস্তরেই আলোচনার দিন বয়ে যাচ্ছে। হিমালয়ের হিমবাহগুলি আর নিজেদের আয়তন ধরে রাখতে পারছে না। বরফের গলনে সমুদ্রের জলতল এমন ভাবে বাড়লে শহর তো বটেই, ভারতের সুন্দরবন আর বাংলাদেশের সুন্দরবন, বিভিন্ন দ্বীপ, সমুদ্র-ঘেঁষা ভূমি ও শহরগুলির অনেকটাই জলের তলায় চলে যাবে। যে এভারেস্ট সমগ্র এশিয়ার দেশগুলির উপর বায়ুর উষ্ণতার ভারসাম্য বজায় রাখত, তার পক্ষে সে কাজ করা আর সম্ভব হচ্ছে না।

পরিস্থিতি যে দিকে এগোচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে সমস্যা হবেই পানীয় জলের। যেটুকু রক্ষা করা যেত, সেই ব্যাপারে কোনও সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। শহরের কোথাও কোথাও সিস্টেম-এর গোলযোগে পাইপ ফুটো হয়ে গিয়ে জল দিনের পর দিন নর্দমায় মিশে যায়। রাস্তার ধারের ‘চাপাকল’ থেকে জল নিয়ে, দেদার পথঘাট ভেজানো হয়। পানীয় জল খেয়ে বাড়িতে লাগানো শখের বাগানের শখের গাছেরা বেঁচে থাকে। অথচ, বাড়ির ছাদে বৃষ্টির জল ধরে, ‘জল ভরো’ প্রকল্প বানিয়ে আমরা সেই গাছের চাহিদা অনায়াসেই মেটাতে পারতাম। পারতাম বাথরুমে শৌচ কাজের প্রয়োজনীয় জলের কিছুটা সরবরাহ করতে।

দক্ষিণ দামোদরের একটা গ্রামে দেখেছি, জলধারা প্রকল্পের নামে পাম্প চলছে তো চলছেই। এবং কলের মুখও অনেক জায়গায় খোলা। কোথাও আবার কলের মুখ খোলা রেখে পুকুরে জল ভরা হচ্ছে মাছ বাঁচানোর জন্য। কারণ, সেটা সরকারি জল। সাধু সাবধান।

রমজান আলি, বর্ধমান

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন