গুজরাতের ফল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে সব দিক দিয়ে স্বস্তিকর

মমতা ভাগীদার চান না

বিজেপি গুজরাতে ১০০-র গণ্ডি পেরোতে পারবে কি না, তা নিয়ে আগ্রহ যখন চরমে, মমতা তখন মজা করে ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে বাজি ধরেছিলেন! বলেছিলেন, কিছুতেই ওরা তিন অঙ্কে পৌঁছতে পারবে না এবং সেটাই হবে বড় ‘শিক্ষা’।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:২৩
Share:

গুজরাতের ফল বেরোতেই শুরু হয়ে গিয়েছে নতুন হিসাবনিকাশ। সামনে ২০১৯-এর খোলা খাতা। অঙ্ক কষছেন সবাই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো বটেই। তাঁর অঙ্ক অবশ্য শুধুই যোগবিয়োগের নয়। ‘গুণ’ বিচার করে ভাগ করার হিসেবটাও এখন থেকে করে রাখতে চাইছেন তিনি।

Advertisement

বিজেপি গুজরাতে ১০০-র গণ্ডি পেরোতে পারবে কি না, তা নিয়ে আগ্রহ যখন চরমে, মমতা তখন মজা করে ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে বাজি ধরেছিলেন! বলেছিলেন, কিছুতেই ওরা তিন অঙ্কে পৌঁছতে পারবে না এবং সেটাই হবে বড় ‘শিক্ষা’।

তাঁর যুক্তি ছিল, বিজেপি ভোটে জিতলেও আসন সংখ্যায় ১০০-র নীচে থাকা অর্থাৎ তিন অঙ্কে পৌঁছতে না পারার চাপ ও গ্লানি বড় কম নয়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে সামনে রেখে সর্বশক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার পরে ১০০টি আসনও জিততে না পারলে জয়ের আনন্দ যথেষ্ট ম্লান হয়ে যাবে। দলের মনোবল ধাক্কা খাবে। ভোটের রাজনীতিতে সেটা হবে খুবই অর্থবহ ইঙ্গিত। ঘটনাচক্রে তা সত্যি হওয়ায় তিনি তৃপ্তির হাসি হেসেছেন!

Advertisement

কী হবে তা পরের কথা। কিন্তু গুজরাতের ফল বেরনোর তিন দিন আগেই তৃণমূল নেত্রী তাঁর দলের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন। বিজেপি-বিরোধিতার পাশাপাশি তাঁরা যে কংগ্রেসের সঙ্গেও এখন বেশি গা-মাখামাখি করবেন না, সেটা জানিয়ে মমতা তাঁর দলের বৈঠকে নেতাদের নির্দেশ দেন, কংগ্রেস সংসদ অচল করতে চাইলেও তৃণমূল যেন তাতে শামিল না হয়। তাঁরা চলবেন নিজস্ব অ্যাজেন্ডায়।

জাতীয় রাজনীতির নিরিখে মমতার এই সিদ্ধান্ত তাৎপর্যপূর্ণ। দেশে বিজেপি-বিরোধী জোট গঠনের জন্য তাঁর সক্রিয় ভূমিকা আমরা দেখেছি। সনিয়া গাঁধী কংগ্রেস সভাপতি থাকাকালীন তাঁর ডাকে মমতা দিল্লি গিয়েছেন। সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরির সঙ্গেও এক মঞ্চে বসেছেন। নিজে বিভিন্ন রাজ্যের বিরোধী নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন। কিছু দিন আগে মুম্বইতে শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরের সঙ্গে ‘সৌজন্য’ বৈঠক হয়েছে তাঁর। এমনকী গুজরাত নির্বাচনের আগেও মমতা নানা ভাবে চেষ্টা করেছিলেন যাতে গোড়া থেকে কংগ্রেস এবং হার্দিকের মধ্যে বোঝাপড়া হয়। তখন তা হয়নি। হল একেবারে শেষবেলায়।

কংগ্রেসে এখন রাহুল-যুগ এসেছে। গুজরাত নির্বাচন যদি রাহুল গাঁধীর নেতৃত্বের প্রথম পরীক্ষা হয়, তবে তাতে তিনি অসফল বলা যাবে না। বরং সাধারণ মানুষের ধারণায় নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলে বিজেপি-কে ১০০ পেরোতে না দেওয়ার কৃতিত্ব অনেকটাই তাঁর উপর বর্তায়। শুধু তা-ই নয়, প্রায় ৫০টি আসনে বিজেপির জয়ের ব্যবধান ১৫০০-র মধ্যে। এর মধ্যে ১২টিতে বিজেপি জিতেছে ২৫০-এর কম ভোটে। ১৮টিতে ব্যবধান ৫০০-র কম। যার সামান্য এ দিক-ও দিক হলেই গুজরাতে বিজেপির বিপর্যয় ঠেকানো যেত না।

তবু ঘটনা হল, এহেন ফল বেরনোর এত দিন পরেও মমতার সঙ্গে রাহুলের কোনও কথা হয়নি। কংগ্রেস সভাপতি পদে রাহুলের আনুষ্ঠানিক অভিষেকের পরেও তৃণমূল নেত্রীর তরফে কোনও শুভেচ্ছা বার্তা যায়নি বলে খবর। যদি এ সব কোনও ইঙ্গিত হয়, তা হলে তা ‘শীতলতা’ ছাড়া আর কী হতে পারে?

কিন্তু কেন? একটি চালু ব্যাখ্যা হল, সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে মমতার যোগাযোগের দীর্ঘ ধারাবাহিকতা। যার শুরু রাজীব গাঁধীর আমলে। রাহুল তখন ছেলেমানুষ! ফলে সনিয়া মমতার যত চেনা, রাজনীতির বাইরেও ব্যক্তিগত সম্পর্কের উষ্ণতা সেখানে যত বেশি, রাহুলের ক্ষেত্রে তেমনটি হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়নি। এখানে পারস্পরিক বোঝাপড়ার পরিসর এখনও সীমিত। সম্পর্ক উভয় তরফেই অনেকটা আনুষ্ঠানিক সৌজন্যের। আরও সহজ কথায় বললে, রাজীব বা সনিয়ার পরে পরবর্তী প্রজন্মের রাহুলকে একই আসনে একই ‘মর্যাদা’ দিতে মমতার দিক থেকে কোথাও হয়তো একটা মনের বাধা কাজ করছে। আবার রাহুলও হয়তো তাঁকে ‘অভিভাবক’ বলে মানতে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। সব মিলিয়ে রসায়নটা এখনও জমেনি!

যদিও রাজনীতির বাস্তবতা ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ধার বড় একটা ধারে না। বৃহত্তর রাজনীতির স্বার্থে অনেক কিছুই ভুলে থাকা যায়। তেতো ওষুধও অমৃতজ্ঞানে গিলতে হয়। এ ক্ষেত্রেও তাই শুধু ব্যক্তিগত সম্পর্কের নিরিখে বিষয়টি দেখলে বোধহয় ভুল হবে। কংগ্রেস অর্থাৎ রাহুলের সঙ্গে আপাতদূরত্ব তৈরি করার সিদ্ধান্তের পিছনে মমতার নিজস্ব অঙ্ক নিঃসন্দেহে কাজ করছে।

মমতা বোঝেন, তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর পথে গেলে এই রাজ্যে প্রায় ঘুমিয়ে থাকা রাহুলের দল আগামী দিনে জেগে ওঠার বাড়তি অক্সিজেন পেয়ে যাবে। তাতে সংখ্যালঘু ভোট ভাগ হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। তৃণমূলের পক্ষে সেটা বাঞ্ছনীয় নয়। বিজেপির মোকাবিলায় রাজ্যে ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটকে পাখির চোখ করেই তাদের এগোতে হবে। কোনও মতে কংগ্রেসের হাঁড়িতে সেই চালের ভাগ দেওয়া যাবে না। তাই সরাসরি শত্রুতায় না গিয়ে ‘সম্মানজনক’ দূরত্ব বজায় রেখে রাজ্যে সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংক ‘অটুট’ রাখার চেষ্টা করা এখন বেশি দরকার।

অনেকের অবশ্য এমনও ধারণা, প্রধানমন্ত্রিত্বের দৌড়ে রাহুলকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছেন মমতা। সেটাও নাকি ‘দূরত্বের’ আর এক উপসর্গ। উচ্চাকাঙ্ক্ষা রাজনীতিকদের স্বাভাবিক ধর্ম। তবু এই ধারণার সঙ্গে পুরোপুরি সহমত হতে পারছি না। কারণ অনেক। প্রথমত, বিরোধী জোটের চেহারা কী দাঁড়াবে, সবটাই এখনও অনিশ্চিত। দ্বিতীয়ত, কংগ্রেস যদি প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে আরও মাথা চাড়া দেয়, তা হলে পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি লোকসভা আসনের উপর ভিত্তি করে মমতা প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, এটা ভাবা খুব বাস্তবসম্মত নয়। তৃতীয়ত বুঝতে হবে, মমতা নিজেও কি প্রধানমন্ত্রী হতে আগ্রহী? যত দূর মনে হয়, নিজে প্রধানমন্ত্রী না হয়ে প্রধানমন্ত্রী ‘নিয়ন্ত্রণ’ করা মমতার বেশি পছন্দের। যদি আদৌ তেমন পরিস্থিতি আসে! তাই মমতার মতো পোড়খাওয়া নেত্রী গাছ পোঁতার আগেই এক কাঁদি কলা খাওয়ার দিবাস্বপ্ন দেখছেন, এখনই তা ধরে নেওয়া হয়তো ঠিক হবে না।

বরং এটা বলা চলে, গুজরাতের ফল থেকে যে ছবি উঠে এসেছে আপাতত সেটাই মমতার কাছে সবচেয়ে বেশি স্বস্তিদায়ক ছক। অর্থাৎ, ক্ষমতায় দুর্বলতর বিজেপি এবং অপেক্ষাকৃত সবল বিরোধী পক্ষ। তৃণমূলের বিশ্বাস, গুজরাত চালানো বিজেপির পক্ষে এ বার খুব মসৃণ হবে না। এর পরে একে একে ভোটে যাবে বিজেপি-শাসিত আরও তিন গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়। গুজরাত-মডেল তাতে ছায়া ফেলবে না, সেটা বলা কঠিন। ফলে ক্রমশ চাপ বাড়বে নরেন্দ্র মোদীর। দলের অন্দরে তাঁর অবিসংবাদী নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠাও অসম্ভব নয়।

এ সবই অনিশ্চিতের গর্ভে। তবু এমন এক পরিস্থিতিকে ভবিতব্য ধরে মমতা ২০১৯-এর হিসেব কষছেন। তাই এই রাজ্যের রণাঙ্গনে ৪২-এর যুদ্ধে আপাতত তিনি কোনও ভাগীদার চান না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement