কে রলের মুখ্যমন্ত্রী ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ এক বার জওহরলাল নেহরুর আতিথ্য গ্রহণ করিয়াছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর ভোজনতালিকায় কী ছিল, প্রশ্ন উঠিলে মুখ্যমন্ত্রী সহাস্যে বলিয়াছিলেন, ‘এক উত্তম কাশ্মীরি ব্রাহ্মণের এক উত্তম দক্ষিণী ব্রাহ্মণকে যাহা পরিবেশন করা উচিত, অর্থাৎ মাছ, মুরগি ও মাংস।’ বিজেপি-র প্রথম প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী মহিষের মাংসের কাবাব পছন্দ করিতেন। বর্তমান সাংসদদের মধ্যেও আমিষভোজীর অভাব নাই। তাহা হইলে ভাবের ঘরে চুরি কেন? অতীতের দিকে চাহিয়াও লাভ নাই। সে কালের ঋষিরাও আমিষলোভী ছিলেন। যাজ্ঞবল্ক্য ধেনু ও ষাঁড়ের মাংস খাইতে নিষেধ করিয়াও বলিতেছেন, ‘আমি খাইব যদি সুস্বাদ হয়।’ শতপথব্রাহ্মণ ইহার সাক্ষী। আজ যাঁহারা নিরামিষের সন্ত্রাস জারি করিতেছেন, প্রাচীন বা সাম্প্রতিক ইতিহাস তাঁহাদের সমর্থন করে না। ভারতের প্রধান ভূখণ্ডে নিরামিষ প্রবর্তনের প্রচেষ্টা যে সংবিধানের মৌলিক অধিকার বিরোধী, রাষ্ট্র ও ধর্মমত পৃথক রাখিবার নীতির বিরোধী, তাহা তর্কাতীত। যাহা বলিবার প্রয়োজন তাহা হইল, হিন্দু ধর্মেও ইহার সমর্থন মেলে না।
বেদে তিন প্রকার যাগের কথা বলা হইয়াছে, পশু, ইষ্টি ও সোম। ইষ্টি ব্যতীত অপর দুইটিতে বলি ছিল আবশ্যক। শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হইয়াছে, ‘এই হইল শ্রেষ্ঠ আহার, এই মাংস, তাই পশুবন্ধ যাগ করিলে সে পরম অন্নের ভোক্তা হয়।’ হিন্দুদের মধ্যে চির কালই আমিষ ও নিরামিষ ভক্ষণের ধারা পাশাপাশি চলিয়াছে, দুইটি ধারাই ধর্মগ্রন্থ হইতে পুষ্টি লাভ করিয়াছে। শ্রীরামচন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণ দুই জনই ক্ষত্রধর্ম অনুসারে মৃগয়া করিয়া পশুমাংস আহরণ করিতেন। সীতাহরণের পর রামচন্দ্র আমিষ ত্যাগ করিয়াছিলেন বটে, তবে সে সীতার বিরহে। ধার্মিক বলিয়া নহে। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির অনৃশংসতাকেই ধর্মের সংজ্ঞা নির্দিষ্ট করিয়াছিলেন, কিন্তু আমিষ ত্যাগ করেন নাই। এমনকী স্বয়ং বুদ্ধদেবও মাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ করিয়াছেন কি না, তাহা তর্কসাপেক্ষ। একটি সূত্র অনুসারে, তিনি সঙ্ঘে কেবল নিরামিষ খাইবার নিয়ম আরোপ করিতে অস্বীকার করিয়াছিলেন। অনুগামীদের নির্দেশ দিয়াছিলেন, ভিক্ষা হিসাবে দান করা যে কোনও খাদ্যদ্রব্য শ্রদ্ধার সহিত গ্রহণ করিতে। বর্তমান দলাই লামা শাকাহারের প্রশংসা করিয়াছেন, কিন্তু শাকাহারী নহেন।
সর্বাপেক্ষা প্রাসঙ্গিক বক্তব্যটি ঋগ্বেদের এক ক্ষুধাকাতর ঋষির। বামদেব নামে অতি-দরিদ্র ওই ঋষি বলিয়াছেন, যাহা চণ্ডালেরও অভক্ষ্য, ক্ষুধার জ্বালায় তিনি সেই কুকুরের নাড়িভুঁড়ি খাইয়াছেন। দরিদ্রের ক্ষুধার তাড়নাকে বেদও অস্বীকার করে নাই। অগণিত মন্ত্রে অন্নকে দেবতা বলা হইয়াছে। কারণ, ক্ষুধার্ত ব্যক্তির নিকট খাদ্যের অধিক সম্মাননীয় কিছু নাই। মহাত্মা গাঁধী বলিয়াছিলেন, ক্ষুধার্তের নিকট স্বয়ং ভগবানও খাদ্য ব্যতীত অপর কোনও রূপে আবির্ভূত হইতে পারেন না। যাহা কিছু সহজলভ্য ও পুষ্টিকর, তাহাই খাদ্য। তাহার কোনওটিই অশ্রদ্ধেয় নহে। যিশুর অধিকাংশ ভক্ত ছিলেন দরিদ্র ধীবর, ছুতার। তিনি তাই বলিয়াছেন, মুখে যাহা প্রবেশ করে তাহার কোনওটাই অপবিত্র নহে। বেদ-পুরাণ-ইতিহাস, মহামানব, কাহার নির্দেশে অপরকে জ্বালাতন করিতেছেন বিজেপি নেতারা?