‘আসমা জাহাঙ্গির ছিলেন এক জন পরিপূর্ণ মানুষ’

বুদ্ধি ও হৃদয়ের সমন্বয়

আসমা তাঁর জীবনের প্রথম মামলা জেতেন আইন পরীক্ষা পাশ করার আগেই। সেটা ছিল মস্ত একটা সাফল্য— সেই মামলায় জয়ী হয়ে তিনি তাঁর বাবা মালিক গুলাম জিলানিকে জেল থেকে মুক্ত করেন।

Advertisement

অমর্ত্য সেন

শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:৫৩
Share:

স্মরণ: মানবাধিকার গোষ্ঠী করাচি থিংকার ফোরাম-এর সদস্যরা। করাচি, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮। ছবি:এপি

আসমা জাহাঙ্গিরের মতো বড় মাপের মানুষ বিরল। মননচর্চায় উজ্জ্বল আসমা ছিলেন অসামান্য মানবতাবাদী, বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা, করুণার প্রতিমূর্তি এবং অদম্য সাহসের মূর্ত প্রতীক। এবং, এ-সবের পাশাপাশি, তিনি নিজেকে এমন এক জন অসাধারণ আইনজীবী হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন যার তুলনা মেলা ভার। স্বৈরাচারী ও নিপীড়কদের অত্যাচার থেকে নিঃসহায় মানুষকে রক্ষা করার ব্যাপারে আসমার মতো করে কেউ আত্মনিয়োগ করেছেন বলে আমার জানা নেই। তিনি ছিলেন মানবাধিকার বিষয়ে দুনিয়ার এক অত্যন্ত কৃতী আইনজীবী; নিজের আইন সংক্রান্ত জ্ঞানকে তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন দুর্দশাগ্রস্তদের রক্ষা এবং লোকেদের অধিকারকে সবল করার কাজে।

Advertisement

ঘটনা হল, আসমা তাঁর জীবনের প্রথম মামলা জেতেন আইন পরীক্ষা পাশ করার আগেই। সেটা ছিল মস্ত একটা সাফল্য— সেই মামলায় জয়ী হয়ে তিনি তাঁর বাবা মালিক গুলাম জিলানিকে জেল থেকে মুক্ত করেন। পাকিস্তানের সংসদের সদস্য জিলানি ছিলেন সামরিক বাহিনীর কড়া সমালোচক, সরকার তাঁকে অন্যায় ভাবে জেলে পুরে রেখেছিল। সুপ্রিম কোর্টে তিনি যখন “আসমা জাহাঙ্গির বনাম পঞ্জাব সরকার” নামে পরিচিত এই মামলা জেতেন, তখন তাঁর বয়স মেরেকেটে কুড়ি। অচিরেই অনন্য বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পেশাগত প্রশিক্ষণ ও দূরদর্শিতার যোগে তিনি পাকিস্তানে মানবাধিকার রক্ষার ব্যাপারে অগ্রণী হয়ে ওঠেন, জায়গা করে নেন আই এ রহমান ও দোরাব পটেল-এর মতো বিরাট মাপের মানবাধিকার কর্মীদের পাশে। ভারত বা দক্ষিণ আফ্রিকার মানবাধিকার কমিশনের মতো জোরালো আইনি— এবং সাংবিধানিক—স্বীকৃতি না থাকা সত্ত্বেও, আসমার মতো অগ্রণীদের নেতৃত্বে পাকিস্তান মানবাধিকার কমিশন ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার কাজে যে সাফল্য অর্জন করেছে তা সত্যিই অসাধারণ। আইনি ও সাংবিধানিক বিধিসংগতির কারণে ভারত বা দক্ষিণ আফ্রিকার মানবাধিকার কমিশনের কাজটা তুলনায় অনেক সহজ। আইনগত বাধা সত্ত্বেও পাকিস্তান মানবাধিকার কমিশন, বিশেষত এ-বিষয়ে লোকমত গড়ে তোলার এবং মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ানোর কাজে সত্যিই অনেক কিছু করতে পেরেছে।

আমার মনে হয়, আসমার সাফল্যের পিছনে তাঁর সওয়ালের মুনশিয়ানা, যুক্তি সাজিয়ে তোলার শিক্ষা ও গভীর-প্রোথিত সাহসের পাশাপাশি তাঁর ব্যক্তিত্বের অন্তর্নিহিত উষ্ণতা এবং উদ্ভাসিত সৌহার্দ্যেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তাঁর কাজকর্ম সারা পৃথিবী জুড়েই উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে, সীমান্তের দুই পারে। পাকিস্তানের মানুষের ভালবাসা তো তিনি পেয়েইছেন, পাশাপাশি ভারতের লোকেদের কাছেও তিনি ছিলেন সমান প্রিয়জন। ভারতে যেখানেই তিনি বক্তৃতা করেছেন, যত বড় প্রেক্ষাগৃহই হোক না কেন, ঘর উপচে পড়েছে। তাঁর কথা বলার ভঙ্গিটাই ছিল এমন যে, সকলেই তাঁর আপন হয়ে উঠত। যুক্তিপ্রয়োগের জোর তো ছিলই, সেই সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিত্বের মিত্রভাব, এমনকী কঠিন সব মামলাতেও, বিচারকদের বাধ্য করত তাঁর পরিচ্ছন্ন যুক্তিগুলোকে সহানুভূতির সঙ্গে শুনতে। মানুষকে অবাক করে দিয়ে আসমা একের পর এক এমন সব মামলা জিতেছেন, আপাতদৃষ্টিতে যেগুলো ছিল একেবারে হেরে যাওয়া বাজি।

Advertisement

এটা আমার পরম সৌভাগ্য যে, দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে আমি আসমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব পেয়েছি। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা এক সভায়, ভারত ও পাকিস্তানের মানুষের পারস্পরিক কথাবার্তা প্রসারের জন্য দুই দেশের একটি যৌথ উদ্যোগের সদস্য হিসাবে (আসমা ছিলেন এর সহ-সভাপতি, ভারতের পক্ষ থেকে ছিলেন ইন্দ্রকুমার গুজরাল)। বুদ্ধির স্বচ্ছতার পাশাপাশি তাঁর মানবিকতা ও উষ্ণতার প্রাচুর্য আমাকে মুগ্ধ করে তোলে। নানান জায়গায়, এবং প্রায়ই, আমাদের দেখা হয়েছে, এবং কথাবার্তার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু অফুরন্ত কথা বলার সবচেয়ে বড় সুযোগটা এসেছিল, যখন আসমা ও তাঁর স্বামী— চমৎকার মানুষ তাহির জাহাঙ্গির— কেমব্রিজে মাস্টারস লজে আমাদের সঙ্গে কয়েক দিন কাটিয়ে যান। মাঝে মাঝে তাতে যোগ দিতেন তাঁদের কন্যা সুলেমা। তিনি নিজেও আইনজ্ঞ। অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতিতেও অগ্রাধিকার ও কর্তব্য নির্ধারণের ব্যাপারে মানুষ কীভাবে চিন্তা করবে, সে-বিষয়ে আসমার কাছ থেকে আমি প্রভূত জ্ঞান লাভ করেছিলাম।

গত বছর আসমা লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স-এ (এলএসই) আমার নামাঙ্কিত একটি বক্তৃতা দেন। (বলে রাখা দরকার যে, বক্তৃতাটা আমার নামে চিহ্নিত হওয়ার ব্যাপারে আমার কোনও কৃতিত্ব নেই।) সেটি ছিল আমার জীবনে অসামান্য পরিতৃপ্তির একটা মুহূর্ত। বক্তৃতা শুনতে এসেছিলেন হাজারখানেক ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক। আসমা সেই বক্তৃতায় বিশ্লেষণ করেন, কীভাবে গণতান্ত্রিক উপায়গুলো ব্যবহার করে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা থেকে জন্ম নেওয়া অন্যায়ের প্রতিরোধ করা যায় (এটা এমন একটা বিষয়, বিশ্ব জুড়ে যার গুরুত্ব বেড়েই চলেছে)। তাঁর কথাগুলো বেশ কয়েক দিন ধরে এলএসই-তে ঘুরতে থাকে।

যে আইনজীবীরা সামাজিক পরিবর্তনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন, বিশেষত যাঁরা মানবাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের প্রায়ই হিংস্র আক্রমণের আশঙ্কায় দিন কাটাতে হয়, কেননা তাঁদের আন্দোলনের ফলে যাদের স্বৈরাচার ও নিপীড়ন বাধা পায় তারা তো ছাড়বে না! শেক্সপিয়রের হেনরি দ্য সিক্সথ, পার্ট টু’তে জ্যাক কেড যখন তার সদ্য— এবং অসৎ উপায়ে— পাওয়া ক্ষমতার জোরে ভবিষ্যৎ অগ্রাধিকারগুলোর কথা বলছিল, তখন তার এক অনুগামী, কসাই ডিক বলে ওঠে, “সর্বাগ্রে যেটা করতে হবে তা হল সব উকিলদের মেরে ফেলা।”

(ন্যায্যতা ও মানবাধিকারের প্রতি) তাঁর দায়বদ্ধ ও আত্মনিবেদিত জীবনে আসমাকে এমন বহু ডিক কসাইয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু আমার এই নির্ভীক বন্ধু নিরবচ্ছিন্নভাবে কথা বলে গিয়েছেন, তর্ক করে গিয়েছেন, উদ্বুদ্ধ করে গিয়েছেন, পথ দেখিয়ে গিয়েছেন। কোনও কিছুই তাঁকে পথভ্রষ্ট করতে পারেনি। হুমকি বা বিপদ তাঁকে থামাতে পারেনি, তাঁর যুক্তির জোরকে একটুও টলাতে পারেনি। তাঁর যে অসামান্য উষ্ণতা ও মানবিকতায় সকলে মুগ্ধ হয়েছিলেন, এই সব সমস্যায় তাতেও বিন্দুমাত্র টোল পড়েনি।

আসমা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন। কিন্তু আমরা যেমন তাঁর দ্যুতিতে মুগ্ধ থাকব, তেমনই তিনি যা শিখিয়ে গিয়েছেন তার হাত ধরে সামনে এগিয়ে যাব। মানবতার দেবী বিদায় নিয়েছেন বটে, কিন্তু যে বিপুল অনুপ্রেরণা ও অবিস্মরণীয় শিক্ষা আমরা তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি তা তো আমাদের সঙ্গেই থাকবে। এই দুঃখের মুহূর্তে এটাই একটা সান্ত্বনা। সেই সঙ্গে এটাও আমাদের গর্ব যে, এমন এক জন পরিপূর্ণ মানুষকে আমরা চিনতাম।

১৭ ফেবুয়ারি ২০১৮, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে
কেমব্রিজ, ম্যাসাচুসেটস-এ হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলে
আসমা জাহাঙ্গির-এর বন্ধু ও গুণগ্রাহীদের আয়োজিত স্মরণসভায় প্রদত্ত বক্তৃতার লেখক কর্তৃক ঈষৎ পরিমার্জিত রূপ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন