পিঠেপুলি: বিস্মৃতপ্রায় এক বাঙালি শিল্পের নস্টালজিয়া

প্রতিটি জাতিরই নিজস্ব শৈলীর খাদ্যসংস্কৃতি থাকে। এক কালে বাঙালিরও ছিল পৌষসংক্রান্তির পিঠে-শিল্প। লিখছেন সোনালি ঘোষএকসময়ে পৌষ মাস ছিল বাঙালির পিঠে-উৎসবের মাস। শহর থেকে গ্রাম— এই উৎসব তখন চলত সবখানেই। তখনও যৌথ পরিবারে ভাঙন ধরেনি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০১৯ ০৪:০৫
Share:

একসময়ে পৌষ মাস ছিল বাঙালির পিঠে-উৎসবের মাস। শহর থেকে গ্রাম— এই উৎসব তখন চলত সবখানেই। তখনও যৌথ পরিবারে ভাঙন ধরেনি। মেয়েরা তখনও অন্দরমহল ছেড়ে চাকরির পথে পা বাড়াননি। একান্নবর্তী পরিবারে হেঁশেলের দায়িত্ব সামলাতেন মা-কাকিমা- জেঠিমারা। তাঁরাই রান্না শেখাতেন। সেই সময়ে পৌষসংক্রান্তির দিন বাঙালির হেঁশেল ম-ম করত পিঠেপুলি আর পায়েসের গন্ধে।

Advertisement

কত ধরনের উপকরন দিয়ে তখন তৈরি হত নানা রকমের পিঠে। পুলিপিঠের মধ্যে থাকত মুগেরপুলি, ভাজাপুলি, দুধপুলি, চন্দ্রপুলি আর সেদ্ধপুলি। অন্য ধরনের পিঠে বলতে, পাটিসাপটা, গোকুলপিঠে, পোস্তর পিঠে, নারকেল পিঠে, সরুচাকলি, গড়গড়া, পাতসিজা ইত্যাদি।

কী কী উপকরণ দিয়ে তৈরি হত এইসব পিঠে? আটা বা ময়দা, চালগুঁড়ো, দুধ, খোয়া ক্ষীর, নারকেল কোরা, চিনি, নলেনগুড়, মুগডাল বা বিউলির ডাল, পোস্ত আর সুজি। কখনও আলু বা মিস্টি আলুও ব্যবহার করা হত উপকরণ হিসেবে। আর থাকত পরিষ্কার সাদা কাপড়।

Advertisement

অনেক যত্ন ও সজাগ তত্ত্বাবধানে তৈরি হত এইসব পিঠে। পিঠে কতটা সুস্বাদু হবে, তা অনেকটা নির্ভর করে চাল কত নিখুঁত ভাবে গুঁড়ো করা হয়েছে, তার উপর।

পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন গৃহস্থ বাড়িতে চাল ভিজিয়ে রাখা হত। পিঠে তৈরির জন্যে ভেজানো চাল কতটা নরম হতে হবে, এই বিষয়টা তখন মা-কাকিমাদের নখদর্পণে থাকত। তাঁদের নিঁখুত হিসেব একেবারে কাঁটায় কাঁটায় মিলেও যেত। এ তো গেল পিঠে তৈরির অাগের পর্ব। সংক্রান্তির দিন সকাল সকাল স্নান সেরে নিয়ে পরিষ্কার কাপড় পরতেন মা-কাকিমারা। তারপর শুরু হত পিঠে-পর্ব। পিঠে তৈরি করার সময় তাঁরা সতর্ক দৃষ্টিতে নজর রাখতেন নিজেদের হস্তশিল্পের উপর। হয়তো অজানা কোনও দেবতাকে বলতেন— মুখরক্ষা যেন হয়! তুমি দেখো, ঠাকুর!

তখন ননস্টিক ফ্রাইং প্যান বা আধুনিক কোনও বাসনপত্রের জন্ম হয়নি। চালগুঁড়োও যে প্যাকেটবন্দি হতে পারে, সে ভাবনাও অকল্পনীয় ছিল। তা সত্ত্বেও কী নিঁখুত ভাবে তৈরি হত প্রত্যেকটা পাটিসাপটা আর অন্য পিঠেগুলো! উনুনে আগুনের আঁচ যেন গৃহিনীদের হাতের ছোঁয়ায় নিজে থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয়ে যেত। একটা পাটিসাপটাও পুড়ে যেত না। তাওয়া আর খুন্তির যুগলবন্দিতে প্রত্যেকটাই কী দারুণ সুস্বাদু হয়ে উঠত!

খুব সাবধানে তৈরি করা হত পুলিপিঠে। সেগুলো দুধে দিয়ে ফোটানোর সময় খুলে বা ফেটে গেলেই সর্বনাশ! সব পরিশ্রম তাহলে মাঠে মারা যাবে! কী উৎকণ্ঠাতেই না মা-কাকিমা-জেঠিমারা তাদের দিকে চেয়ে থাকতেন!

পিঠের সঙ্গে সংক্রান্তির দিনে তৈরি হত নতুনগুড় দিয়ে পায়েসও। নতুন চাল আর গুড়ের সেই গন্ধ বাঙালির আরেক ঐতিহ্য! সংক্রান্তির সেই ঐতিহ্যপূর্ণ নৈবেদ্য বহু বাড়িতেই সর্বপ্রথমে গৃহদেবতাকে নিবেদন করা হত। পুলি-পিঠে-পায়েসের উৎসব সম্পূর্ণ হয়ে উঠত বাড়ির বয়স্ক মহিলা এবং নবীন মেয়েদের মেলবন্ধনে। রান্নাঘর সেদিন যেন একটা প্রথাবহির্ভুত স্কুল! সেখানে প্রবীণ মহিলার কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতেন নবীন মেয়েরা।

একটা সময়ের পরে আস্তে আস্তে এই ছবিটা বদলাতে শুরু করল। সবার প্রথমে আর্থসামাজিক বদলের ছোঁয়া লাগল মাল্টিসিটিগুলোয়। সেখান থেকে বিশ্বায়নের ঢেউ এসে পৌঁছল শহরে। তার প্রভাব পড়ল গ্রামজীবনেও। ধীরে ধীরে ভাঙতে শুরু করল যৌথপরিবার। পিঠে-পুলির চর্চা ক্রমশ অবসৃত হতে থাকল। পিঠে তৈরির মূল কারিগর যাঁরা, তাঁদের বিরাট একটা অংশ পিঠে-পর্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। এর সঙ্গে যুক্ত হল বাঙালির মধুমেহ রোগ বা ‘সুগার’ এবং ‘ডায়েট কন্ট্রোল’ আর দেহ ঠিক রাখার জন্যে মিষ্টির প্রতি অনীহা। সব মিলিয়ে শহর থেকে গ্রাম— অনেকটা ম্লান হয়ে গেল পৌষপার্বণের একান্নবর্তী উৎসবের আবহ।

বেশ কয়েক বছর ধরে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন মেলায় খাবারের স্টলে পুলি-পিঠে বিক্রি হচ্ছে। বিক্রি হচ্ছে পাটিসাপ্টা, ভাপা পিঠেও। এই শীতকালের মেলা ছাড়াও অনেক জায়গায় ভাপা পিঠে বিক্রি হয়। মেলায় খাবারের স্টলে ঝাঁ-চকচকে এক্সপ্রো মেশিনের পাশে হয়তো কাচের পাত্রে রাখা থাকে পাটিসাপ্টা। তারপাশে হয়তো ভাপা পিঠে। কেমন অদ্ভুত লাগে! নতুন আর পুরনোর কী অদ্ভুত সহাবস্থান! স্টলে যে মহিলারা পিঠে তৈরি করেন, তাঁদের কখনও বলতে পারিনি— সংক্রান্তির দিন নিজের পরিবারের জন্য পিঠে তৈরি করেন তো?

আমাদের মতো চাকরিজীবী মহিলাদের পৌষসংক্রান্তির দিনও প্রতিদিনের মতো কর্মস্থলে যেতে হয়। ইচ্ছে থাকলেও পিঠে তৈরির সেই আগ্রহটা আজ আর তেমন ভাবে তৈরি হয় না। হলেও সামান্য কয়েকটা পিঠে তৈরি করা মাত্র! তাকে পিঠে-উৎসব বলা যায় না!

যৌথ পরিবারের সেই রান্নাঘর এখন শুধুই স্মৃতি। সংক্রান্তির দিন, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া কোনও ব্যস্ত অফিসযাত্রী কি আজও সন্ধান করেন প্রায় একটা হারিয়ে যাওয়া একটা ঘ্রাণ, যে সুগন্ধ একদিন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিল বাঙালি-জীবনের সঙ্গে?

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন