এত সহজেই কি জেরুসালেম করায়ত্ত করা যাবে? 

ঘি ঢাললেন ট্রাম্প

ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুসালেমকে ইজরায়েলের রাজধানী হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে বলেছেন, তেল আভিভ থেকে মার্কিন দূতাবাস সেখানে স্থানান্তর করা হবে।

Advertisement

পলাশ পাল

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:৪৩
Share:

বিক্ষোভ: জেরুসালেমকে ইজরায়েলের রাজধানী বলেছেন ট্রাম্প, তার প্রতিবাদে প্যালেস্টাইনি মানুষজন। দিয়ারবকির, ১৭ ডিসেম্বর। ছবি: এএফপি

জেরুসালেম একটি নয়, একের মধ্যে দুটি শহর। পশ্চিম জেরুসালেম সব সুযোগসুবিধা সংবলিত অতি আধুনিক একটি শহর, সংখ্যাগরিষ্ঠ ইহুদিদের আধিপত্য সেখানে। অন্য দিকে পূর্ব জেরুসালেম ভগ্নপ্রায়, অংশটি প্যালেস্টাইনি আরব অধ্যুষিত। পশ্চিমে উপচে পড়ছে ঐশ্বর্য ও প্রতিপত্তি। পূর্বের রাস্তাঘাট, নিকাশি ব্যবস্থা, স্কুল-কলেজ, পরিবহণ, হাসপাতাল— সব ধরনের পরিকাঠামোতেই অবহেলার ছাপ স্পষ্ট। এখানকার ৭৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে বসবাস করেন। পুর নির্বাচনে ভোট দেন, এ রকম প্যালেস্টাইনির সংখ্যা ২ শতাংশেরও কম। অধিকাংশই মনে করে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা মানে ইজরায়েলি কর্তৃত্বকে স্বীকার করে নেওয়া। মোট জনসংখ্যার ৩৭ শতাংশ হওয়া সত্ত্বেও পুরপরিষদে কোনও প্যালেস্টাইনি প্রতিনিধির উপস্থিতি নেই। গত ৫০ বছর ধরে শহরের দুটি অংশই ইজরায়েলি প্রশাসনের অধীন। তবু এই বিভাজনকে মুছে ফেলা যায়নি।

Advertisement

ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুসালেমকে ইজরায়েলের রাজধানী হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে বলেছেন, তেল আভিভ থেকে মার্কিন দূতাবাস সেখানে স্থানান্তর করা হবে। ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রচারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, নির্বাচিত হলে তিনি জেরুসালেমের ওপর ইজরায়েলের সার্বভৌমত্ব মেনে নেবেন। আপাত ভাবে নিজের দেওয়া সেই প্রতিশ্রুতি তিনি রক্ষা করেছেন। এবং এটা তাঁর রক্ষণশীল সমর্থক, ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে উল্লসিত করেছে ঠিকই, কিন্তু এই ঘোষণা করে তিনি একটি অন্যায় করলেন— ১৯৬৭ সালে ইজরায়েল আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে আরব অধ্যুষিত পূর্ব জেরুসালেম দখল করে নিয়েছিল, তাকে বৈধতা দিলেন। তিনি উপেক্ষা করেছেন প্যালেস্টাইনি ও বিশ্ব জনমত। পাশাপাশি এত দিন পর্যন্ত ইজরায়েল ও প্যালেস্টাইনের মধ্যে শান্তির প্রশ্নে ওয়াশিংটন নিজেকে নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসাবে দাবি করত, তার অবসান ঘটল। কার্যত ট্রাম্প নিজেই সেই দাবি বাতিল করে দিয়েছেন। এর পরে কোনও প্যালেস্টাইনি ও আরব জনতা তাঁর ওপর আর আস্থা রাখবে না, মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে, পশ্চিম এশিয়ার এই পবিত্র নগরীর অধিকার নিয়ে দীর্ঘ সাত দশক ধরে যে রক্তক্ষয়ী লড়াই, তাকেও নতুন করে উসকে দিয়েছেন। গোটা পশ্চিম এশিয়াই এখন পরিণত হয়েছে অশান্তির কুরুক্ষেত্র।

ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন দ্বন্দ্বের একেবারে কেন্দ্রে জেরুসালেমের অবস্থান। খ্রিস্টান, ইহুদি ও মুসলমান, তিন সম্প্রদায়ের মানুষের কাছেই শহরটি পবিত্র স্থান। খ্রিস্টান ও মুসলমানদের ধর্মপরিচয়ের সঙ্গে জড়িত রয়েছে এই প্রাচীন নগরী। আবার এই বিরোধিতা আরও প্রকট করে তুলেছে এই সত্য যে, মুসলমানদের কাছে যে স্থানটি ‘হারাম আল শরিফ’, সেটাই ইহুদিদের কাছে পবিত্র ‘টেম্পল মাউন্ট’ নামে বিবেচিত। উভয়ের কাছেই স্থানটির গুরুত্ব অপরিসীম। মুসলমানদের কাছে এটি মক্কা ও মদিনার পরে তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র। স্বাভাবিক কারণেই, এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আরব জনতার ভাবাবেগের প্রশ্ন। আর তাই প্যালেস্টাইন ও আরব বিশ্বের কোনও নেতা জেরুসালেম প্রশ্নে কোনও আপসে রাজি নন। সীমানা নির্ধারণসহ অন্যান্য অনেক বিষয়ে কিছুটা ছাড় দিলেও জেরুসালেম প্রশ্নে যুযুধান দুই পক্ষেরই মনোভাব অনড়। উভয়ই মনে করে, শহরটি তাদের রাজধানী হওয়া উচিত।

Advertisement

জেরুসালেমকে ঘিরে কয়েক শতাব্দীর এই টানাপড়েন ও বিতর্ক এড়াতেই, ১৯৪৭ সালে, শহরটিকে আন্তর্জাতিক প্রশাসনের অধীনে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা রেখেছিল রাষ্ট্রপুঞ্জ। কিন্তু ১৯৪৮-৪৯ সালের আরব ও ইজরায়েলের মধ্যে যুদ্ধের সময় শহরটির পশ্চিম অংশ দখল করে নেয় ইজরায়েল, এবং পুরনো শহরসহ (ওল্ড সিটি) পূর্ব অংশের ওপর প্যালেস্টাইনিদের হয়ে অধিকার কায়েম করে জর্ডন। ১৯৬০-এর দশকে উভয় রাষ্ট্রই পরস্পরের এই অধিগ্রহণকে এক প্রকার স্বীকারও করে নেয়। মুসলিম দুনিয়াসহ গোটা পৃথিবীও মেনে নিতে শুরু করে, পশ্চিম ও পূর্ব জেরুসালেম যথাক্রমে ইজরায়েল এবং প্যালেস্টাইনের অংশ। তবে সব হিসাব বদলে দেয় ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের দ্বিতীয় আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ, পশ্চিমের সঙ্গে পূর্বাংশও ইজরায়েলের হস্তগত হয়। যুদ্ধের পরে, ১৯৮০ সালে, ইজরায়েল ঘোষণা করে গোটা জেরুসালেম তার ‘চিরন্তন ও অবিভাজ্য রাজধানী’।

একই ভাবে, জর্ডন ১৯৮৮ সালে ওয়েস্ট ব্যাংক (জর্ড নদীর পশ্চিম তীর) ও পূর্ব জেরুসালেমের ওপর তার দাবি পরিত্যাগ করে। ঘোষিত হয় প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র, এবং তারাও এই সময় থেকে জেরুসালেমকে ‘চিরন্তন রাজধানী’র মর্যাদা দেয়। তবে আরব দুনিয়া এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইজরায়েলের এই একমুখী দাবিকে কখনওই মান্যতা দেয়নি। বিষয়টির সংবেদনশীলতা উপলদ্ধি করে তারা নিজেদের দূতাবাস তেল আভিভেই রেখে দেয়। বিভিন্ন বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইজরায়েলর পক্ষে সওয়াল করলেও জেরুসালেম প্রশ্নে সে এত দিন আন্তর্জাতিক মতকে অমান্য করার স্পর্ধা দেখায়নি। অন্তত প্রকাশ্যে। কিন্তু ট্রাম্প তাঁর কলমের খোঁচায় এক লহমায় সব উল্টে দিলেন।

১৯৯১ সালে প্যালেস্টাইনিদের অগ্রাহ্য করে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না, এই প্রতিশ্রুতি দিয়েই মাদ্রিদ শান্তি সম্মেলনে প্যালেস্টাইনিদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৯৫-তে ইজরায়েল ও পিএলও (প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন)-এর মধ্যে স্বাক্ষরিত অস‌‌্লো শান্তিচুক্তিতেও উভয় পক্ষ সহমত হয় যে, আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে জেরুসালেম প্রশ্নটি নির্ধারিত হবে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিন্টনের মধ্যস্থতায়, ২০০০ সালে, হোয়াইট হাউসের লনে পিএলও নেতা ইয়াসের আরাফত ও ইজরায়েলের আইজ্যাক রবিন-এর মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় শান্তিকাঠামো তৈরির চুক্তিপত্র। সেখানেও জেরুসালেম প্রশ্নে উভয় পক্ষের সম্মতি ছিল। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময়কাল পর্যন্ত এই ধারার অন্যথা হয়নি। ট্রাম্পের এই ঘোষণা আবার প্যালেস্টাইনিদের মত প্রকাশের অধিকারকেই অগ্রাহ্য করল। জেরুসালেম প্রসঙ্গে আরবদেরও যে একটা নিজস্ব মত রয়েছে, সে কথা কার্যত অস্বীকার করা হল। চূড়ান্ত ফয়সালার আগেই ট্রাম্প আলোচনার ফল নির্ধারণ করে ফেলেছেন।

বিভিন্ন সময় আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে যে সূত্রটি ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছিল, সেটি হল ‘দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান’। যার মূল কথা, উভয়কেই ১৯৬৭-র আগের সীমানা মেনে নিতে হবে। পশ্চিম জেরুসালেমের ওপর অধিকার থাকবে ইজরায়েলের, পূর্ব জেরুসালেম হবে প্যালেস্টাইনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ইহুদি সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলি সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করবে ইজরায়েল। যেখানে ৯৯ শতাংশ মানুষ প্যালেস্টাইনি আরব, তা হবে প্যালেস্টাইনের অন্তর্ভুক্ত। পুরনো জেরুসালেমের পবিত্র স্থানগুলির দায়িত্ব অর্পিত হবে স্ব স্ব ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের হাতে। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের পবিত্র স্থানগুলির দেখাশোনা ও পরিচালনার দায়িত্ব থাকবে খ্রিস্টান চার্চ পরিষদের, ওয়াক‌‌্ফ-এর নিয়ন্ত্রণে থাকবে টেম্পল মাউন্ট ও মুসলমানদের ধর্মীয় উপাসনালয়। পশ্চিম প্রাচীরের (ওয়েস্টার্ন ওয়াল) দায়িত্ব ন্যস্ত হবে এক জন র‌্যাবাই বা ধর্মীয় শিক্ষকের হাতে।

কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ অবশ্য অন্ধকারেও আলোর সম্ভাবনা দেখছেন। ট্রাম্প তাঁর ঘোষণায় বলেছেন, ‘জেরুসালেমে ইজরায়েলের সুনির্দিষ্ট সীমানার ব্যাপারে আমরা কিন্তু কোনও অবস্থান নিচ্ছি না’। তিনি আরব ও ইহুদিদের জন্য স্বতন্ত্র দুটি রাষ্ট্রের প্রতিও সমর্থন জানান। এই ভাষ্য থেকে কেউ কেউ ধরে নিয়েছেন, ট্রাম্প ভবিষ্যতে পূর্ব জেরুসালেমকে প্যালেস্টাইনের রাজধানী হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার পথও খোলা রেখেছেন। আপাতত তাঁর লক্ষ্য, দু’পক্ষকে আলোচনার টেবিলে আনা।

মুশকিল হল, ট্রাম্পের মতো পপুলিজম-এর পূজারি শাসককে বিশ্বাস করা কঠিন। এই ধরনের শাসকদের বৈশিষ্ট্য হল, এঁরা গণতন্ত্র রক্ষার নামে নিজেরাই হয়ে ওঠেন মূর্তিমান ভক্ষক। ট্রাম্প দুনিয়াকে ‘বিকল্প সত্য’-এর তত্ত্ব দিয়েছেন। এ বার প্রকৃত বাস্তবকে আড়াল করতে উপস্থাপন করছেন ‘বিকল্প বাস্তবতা’। ইতিহাস বার বার দেখিয়েছে, ট্রাম্পের মতো ক্ষমতাবানরা যখন প্রকৃত বাস্তবতাকে অস্বীকার করেন, তার ফল হয় ভয়াবহ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন