প্রবন্ধ ১

কৃষকের সংকটে রাজ্যেরও দায় অনেক

কৃষকের আত্মহত্যা ফের রাজনৈতিক প্রশ্ন হয়েছে। দায় কার, সেটা নির্ধারণ করতে হলে প্রথমে দেখতে হবে, কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যর্থতা কৃষককে এমন চরম সিদ্ধান্তের সম্মুখীন করছে। সেই ব্যর্থতা কার কারণে, বু‌ঝতে হবে।গত এক দেড় মাসে ভারতীয় রাজনীতির একেবারে কেন্দ্রে চলে এসেছে একটা বেশ পুরনো প্রশ্ন— এ দেশে কৃষকরা কেন আত্মহত্যা করেন? তাঁদের এমন করুণ পরিণতির জন্য দায়ী কে? যন্তর মন্তরে আম আদমি পার্টির সমাবেশে গজেন্দ্র সিংহের আত্মহত্যাই হোক, অথবা রাহুল গাঁধীর কৃষক রাজনীতির নতুন উদ্যম, প্রশ্নগুলো তুলেই চলেছে।

Advertisement

সন্দীপ মিত্র

শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০১৫ ০০:১৮
Share:

প্রতিবাদ। পাটিয়ালায় বিক্রি না হওয়া গমের ওপর বসে আছেন কৃষক। ছবি: পিটিআই।

গত এক দেড় মাসে ভারতীয় রাজনীতির একেবারে কেন্দ্রে চলে এসেছে একটা বেশ পুরনো প্রশ্ন— এ দেশে কৃষকরা কেন আত্মহত্যা করেন? তাঁদের এমন করুণ পরিণতির জন্য দায়ী কে? যন্তর মন্তরে আম আদমি পার্টির সমাবেশে গজেন্দ্র সিংহের আত্মহত্যাই হোক, অথবা রাহুল গাঁধীর কৃষক রাজনীতির নতুন উদ্যম, প্রশ্নগুলো তুলেই চলেছে।

Advertisement

দায়ের একটা বড় অংশ যে সরকারের, তা নিয়ে সংশয় নেই। প্রশ্ন হল, কোন সরকারের? কেন্দ্রীয়, নাকি রাজ্য সরকার? রাজনীতি এসে এই প্রশ্নের দখল নিতে চাইবে, স্বাভাবিক। কিন্তু, তাতে যথার্থ উত্তর মিলবে না। কৃষকের আত্মহত্যার দায় কার, সেটা নির্ধারণ করতে হলে প্রথমে দেখতে হবে, কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যর্থতা কৃষককে এমন চরম সিদ্ধান্তের সম্মুখীন করছে। সেই ব্যর্থতা কার কারণে, বু‌ঝতে হবে।

ভারতে যত পরিবারের আয়ের মূল উৎস কৃষি, তাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশেরও বেশি পরিবার প্রান্তিক চাষির। অর্থাৎ, সে পরিবারগুলির মোট চাষজমির পরিমাণ আড়াই একরের কম। মনে রাখা ভাল, আড়াই একর জমিতে চাষ করেন, এমন কৃষকও পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে তুলনায় কম। অনেকেরই চাষের জমির মাপ আরও অনেক ছোট। উল্টো দিকে, দেশের মোট কৃষি পরিবারের মাত্র ০.২৪ শতাংশ বৃহৎ চাষির। এই হিসেব ২০১২-১৩ সালের। ২০০২-০৩ সালের তুলনায় দেশে প্রান্তিক চাষির অনুপাত বেড়েছে অনেকটাই। অর্থাৎ, ভারতের কৃষির সমস্যা বুঝতে হলে মূলত প্রান্তিক চাষিদের কথাই মাথায় রাখতে হবে।

Advertisement

সমস্যা হল, প্রথমত সরকারি কৃষি-ভাবনায় এই প্রান্তিক চাষিরা ঢুকতে পারেন না; আর দ্বিতীয়ত, যদিও বা ভাবনায় তাঁদের ঠাঁই হয়, তাঁদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য যে সব ব্যবস্থা হয়, সেগুলো ঠিক ভাবে কাজ করে না। যেমন ধরুন, কৃষির আধুনিকীকরণ, অথবা বাণিজ্যিকরণ। সেই প্রক্রিয়াগুলি এমন যাতে প্রান্তিক চাষির যোগ দেওয়ার কার্যত কোনও উপায় নেই। অথবা, সারের ভর্তুকি। সরকার টাকা খরচ করে ঠিকই, কিন্তু তার সুফল পৌঁছয় না প্রান্তিক বা ক্ষুদ্র চাষির কাছে। কেন?

সারের ভর্তুকির কথা দিয়েই আরম্ভ করা যাক। ২০০৫-০৬ থেকে ২০০৯-১০ সালের মধ্যে ভারতে সার ভর্তুকির পরিমাণ ৫০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু, তার সুফল পৌঁছচ্ছে না প্রান্তিক চাষিদের কাছে। গলদ আছে প্রক্রিয়ায়। কেন্দ্রীয় সরকারের সার দফতর চেষ্টা করে যাতে কৃষকের হাতে নির্দিষ্ট সময়ে ন্যায্য মূল্যে যথেষ্ট পরিমাণ সার পৌঁছয়। রাজ্য সরকারগুলি সেই প্রক্রিয়ার বড় অংশীদার। কেন্দ্র থেকে সার পৌঁছয় রাজ্যের কাছে। রাজ্যের ভৌগোলিক পরিধিতে সর্বত্র ঠিক সময়ে সার পৌঁছল কি না, সে দিকে নজর রাখা রাজ্যের দায়িত্ব। এই পর্যায়েই সমস্যা তৈরি হয়। কৃষকরা অনেক রাজ্যের কৃষকই বহু বছর ধরে অভিযোগ করছেন, যখন দরকার, তখন তাঁরা ন্যায্য মূল্যে সার পান না। চাহিদার তুলনায় জোগান কম থাকে। ফলে, তাঁদের সার কিনতে হয় কালোবাজারে, চড়া দামে। সারের বাজারে নজরদারি করা রাজ্য সরকারগুলির কর্তব্য। জেলায় যথাসময়ে সার পৌঁছচ্ছে কি না, বিশেষত ক্ষুদ্র বা প্রান্তিক চাষিদের কী দামে সার কিনতে হচ্ছে, সেই খোঁজ রাখার কথা রাজ্য সরকারের। এই কাজে তাদের ধারাবাহিক ব্যর্থতা স্পষ্ট। এই কালোবাজারের রাশ টানাও রাজ্য প্রশাসনের কর্তব্য। সেটাও করা হয়ে ওঠেনি।

কৃষির বাণিজ্যিকরণের ক্ষেত্রেও ছোট চাষিরা একেবারে অসহায়। বড় সংস্থার সঙ্গে দর-কষাকষি করার জোর তাঁদের নেই। এই জোর অর্জন করার একমাত্র রাস্তা, নিজেদের ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলা। কোনও রাজ্যেই সেই কাজটি হয়নি। একে ঠিক সরকারি ব্যর্থতা বলা যাবে না, বরং রাজনৈতিক ব্যর্থতা বলা যুক্তিযুক্ত। রাজনৈতিক দলগুলি ছোট চাষিদের বিলক্ষণ ব্যবহার করে। কিন্তু, তাদের পেশাদারি ভাবে সংগঠিত করে না।

ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রেও ছোট চাষিরা পিছিয়ে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির কৃষিক্ষেত্রে ঋণ দেওয়ার যে বাধ্যবাধকতাটুকু থাকে, সেটা তারা মূলত বড় চাষিকে ঋণ দিয়েই মিটিয়ে ফেলে। স্বল্প সুদের হারে ছোট চাষিকে ঋণ দেওয়ার পরিকল্পনা খাতায় কলমেই থেকে গিয়েছে। এ দিকে, রাজ্য সরকারের অধীনে থাকা গ্রামীণ ব্যাঙ্কগুলিও কৃষকদের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির দেখানো পথেই হাঁটে। তাদের বকেয়া ঋণের পরিমাণও উদ্বেগজনক, ফলে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা আরও বেশি সাবধািন। তাতে মার খান ছোট চাষিরা। রাজ্য সরকারগুলি এই সমস্যার সমাধান করতে পারেনি।

যেমন পারেনি কৃষি সমবায়ের মাধ্যমে প্রান্তিক চাষিদের পাশে দাঁড়াতে। কৃষি সমবায় সম্পূর্ণ রাজ্য সরকারের এক্তিয়ারভুক্ত একটি বিষয়। ভারতের বেশির ভাগ রাজ্যেই বলার মতো সমবায় ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। বারে বারেই অভিযোগ ওঠে, বড় চাষিরাই সমবায় দখল করে রাখেন, ঋণ সমেত তার যাবতীয় সুবিধা ভোগ করেন। কৃষি সমবায়ের মাধ্যমে ক্ষুদ্র চাষিদের পাশে দাঁড়ানো রাজ্য সরকারগুলির কর্তব্য ছিল। বন্যা, খরা বা অন্য কোনও কারণে ফসল মার খেলে, অথবা ফসলের দাম না পেলে কৃষকের যাতে লোকসান না হয়, সেই বিমার ব্যবস্থাও এই কৃষি সমবায়ের মাধ্যমে করা যেত। অবশ্য, এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগের অভাবের কথাও উল্লেখ না করলেই নয়।

কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প কী ভাবে রাজ্যের কারণে শেষ পর্যন্ত কৃষকের কাছে পৌঁছতে ব্যর্থ হতে পারে, তার আরও একটা উদাহরণ সরকারের প্রোকিয়রমেন্ট বা কৃষিপণ্য ক্রয়। কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন ফুড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া কৃষকদের থেকে ন্যূনতম প্রতিশ্রুত মূল্যে ফসল কেনে। কোনও কারণে বাজারে ফসলের দাম পড়ে গেলে এই সরকারি ক্রয় কৃষকদের বড় ভরসা। কিন্তু, এফসিআই-কে নির্ভর করতে হয় রাজ্যের পরিকাঠামোর ওপর। যেমন, রাস্তা। কৃষকের উৎপন্ন ফসল এফসিআই-এর গুদামে পৌঁছনোর জন্য যে রাস্তা প্রয়োজন, বহু রাজ্যেরই বহু প্রান্তে তেমন রাস্তা নেই। আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও নেই। ফলে, অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে প্রোকিয়রমেন্টের পরিমাণ কম।

কৃষকের খোলা বাজারে পৌঁছনোর পথেও রাজ্য সরকারগুলি বড় বাধা। এগ্রিকালচার প্রোডিউস মার্কেট কমিটি (এপিএমসি) অ্যাক্ট নামে একটি বিচিত্র আইন ভারতে চালু আছে। ফসলের পাইকারি বাজার বা মান্ডিতে কে কেনা-বেচা করতে পারবে, আর কে পারবে না, এই আইন তা স্থির করার অধিকার দিয়েছে রাজ্য সরকারগুলিকে। সরকারি লাইসেন্স না থাকলে এই বাজারে প্রবেশাধিকার নেই। আর, সেই লাইসেন্স জোগাড় করা অতি দুঃসাধ্য। তার জন্য বিপুল ঘুষের প্রয়োজন। ফলে, ছোট চাষিরা এই পাইকারি বাজারের বাইরে থাকতে বাধ্য হন, এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের ওপর নির্ভর করা ছাড়া তাঁদের গতি থাকে না।

স্পষ্টতই, কৃষকের সমস্যার দায়ের বড় অংশ রাজ্য সরকারগুলিকেই বহন করতে হবে। তবে, এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠারও পথ রয়েছে। সেই দায়িত্ব আবার মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের। প্রথমেই এপিএমসি আইনের সংস্কার প্রয়োজন। তার জন্য রাজ্য সরকারগুলিকে চাপ দিতে হবে। নরেন্দ্র মোদী সে কথা বলেছেনও। এলপিজি-র ভর্তুকি যেমন এখন সরাসরি গ্রাহকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পৌঁছে যায়, সারের ভর্তুকির ক্ষেত্রেও সেই ব্যবস্থাই করতে হবে। গ্রামীণ পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য বিনিয়োগ করতে হবে। কাজটিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। অন্য দিকে, রাজ্য সরকারেরও দায়িত্ব আছে। কৃষি পরিষেবার কাজে পঞ্চায়েতগুলিকে অনেক বেশি পরিমাণে কাজে লাগাতে হবে। তাদের বাড়তি গুরুত্ব দিতে হবে। ঋণ পাওয়ার জন্য কৃষকের ব্যাঙ্কের দরজায় যাওয়ার বদলে ব্যাঙ্ককে পৌঁছতে হবে কৃষকের কাছে। তার জন্য গ্রামীণ ব্যাঙ্কগুলির সংস্কার প্রয়োজন, মূলধনী বিনিয়োগ প্রয়োজন।

জরুরি কাজগুলো ফেলে রেখে শুধু রাজনৈতিক চাপানউতোরে কৃষকের লাভ হবে না।

কলকাতায় ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে অর্থনীতির শিক্ষক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন