State news

গণতন্ত্রের সংজ্ঞাই বদলে যাচ্ছে

কোনও ক্ষমতার অলিন্দে দাঁড়িয়ে কেউ বলে চলেন, কংগ্রেসমুক্ত ভারত চাই। কেউ বলেন, বিরোধীশূন্য বাংলা চাই।

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০১৮ ০০:৪৮
Share:

অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।

ক্রমাবনতিই আমাদের ভবিতব্য। এমন একটা ধারণা দৃঢ়মূল হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে চৈতন্যে। দোষ ধারণার বা চৈতন্যপ্রবাহের নয়। দোষ ঘটনাপ্রবাহের।

Advertisement

ভারতীয় গণতন্ত্রের চরিত্রটাই যেন বদলে যাচ্ছে দিন দিন। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ লোপ পাচ্ছে অথবা তার সংজ্ঞা বদলে যাচ্ছে। ক্ষমতায় আসীন হওয়াই একমাত্র লক্ষ্য এবং লক্ষ্যে পৌঁছনোর স্বার্থে সব কিছুই বৈধ— রাজনীতিকদের অধিকাংশের কাছেই আজ রাজনীতির অর্থ এই রকম। তাই কোনও ক্ষমতার অলিন্দে দাঁড়িয়ে কেউ বলে চলেন, কংগ্রেসমুক্ত ভারত চাই। কেউ বলেন, বিরোধীশূন্য বাংলা চাই।

প্রবল সমালোচিত হয়েছিলেন ইন্দিরা গাঁধী। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা তখন প্রায় অপ্রতিরোধ্য, একের পর এক সাংবিধানিক সংস্থানকে তখন গুঁড়িয়ে দিতে দিতে এগোচ্ছেন তিনি, দেশ জরুরি অবস্থার কবলে। সামলোচনা, নিন্দা, প্রতিবাদের ঝড় তার বিরুদ্ধেই। আজকের ক্ষমতাসীনেরা প্রতাপে-দাপটে সেই জরুরি অবস্থার ইন্দিরাকেও যেন ছাপিয়ে যেতে চাইছেন। গণতান্ত্রিক কাঠামোটার প্রতি সৌজন্য দেখিয়ে যে একটু রাখঢাক প্রয়োজন, তাও যেন ভুলে যাচ্ছেন।

Advertisement

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

ফারাক অবশ্য রয়েছে। জরুরি অবস্থার ইন্দিরা বাস্তবে ধূলিসাৎ করছিলেন নাগরিকের যাবতীয় গণতান্ত্রিক অধিকারকে। কিন্তু বচনে তার প্রকাশ ছিল না, রাজনৈতিক ভাষ্যে ঔদ্ধত্য ছিল না। আজকের শাসকরা জরুরি অবস্থা ঘোষিত ভাবে জারি করেন না, অঘোষিত ভাবে নাগরিকের অধিকার হরণ করতে থাকেন। কিন্তু প্রকাশভঙ্গিতে, আচরণে, ঔদ্ধত্যে ঘোষিত জরুরি অবস্থার জমানাকেও লজ্জা পাইয়ে দেন।

শক্তিশালী বিরোধী পক্ষ সব সময়েই গণতন্ত্রের পক্ষে স্বাস্থ্যকর— গণতান্ত্রিক রাজনীতির শিক্ষায় প্রাথমিক পাঠের অঙ্গ এই আপ্তবাক্য। কিন্তু সে পাঠ যেন আজ ভারত ভুলতে বসেছে।

আরও পড়ুন: অভিষেকের মন্তব্যে পুরুলিয়া তপ্ত, বিজেপির পাশে থাকার ঘোষণা কংগ্রেস বিধায়কের

নরেন্দ্র মোদী বলেন, কংগ্রেসমুক্ত ভারত চাই। কেউ জোর দিয়ে প্রশ্নই তোলেন না, এ কথার অর্থ কী? প্রধান বিরোধী দলের অবলুপ্তি চাওয়ার তাৎপর্য কী? কংগ্রেসের আদর্শের অবলুপ্তি চান মোদী? নাকি যাঁরা কংগ্রেসে বিশ্বাস রাখেন, তাঁদের অবলুপ্তি চান? কংগ্রেস তো শুধুমাত্র একটা রাজনৈতিক দল নয়। কংগ্রেস তো আধুনিক ভারত তথা স্বাধীন ভারতের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। স্বাধীনতার গৌরবান্বিত সংগ্রামের ইতিহাস থাকবে, কিন্তু কংগ্রেস থাকবে না, এ কী ভাবে সম্ভব!

কী ভাবে সম্ভব, কী ভাবে অসম্ভব, সে বিতর্কে যেতে সম্ভবত নারাজ নরেন্দ্র মোদীরা। কংগ্রেসমুক্ত ভারতের জিগির তুলেই রাজ্যে রাজ্যে ভোট চাইতে যাচ্ছেন তাঁরা। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চাও যেন কোনও অজানা ইন্দ্রজালে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।

এক দিকে যখন দেশের ইতিহাসের অঙ্গহানি ঘটানোর চেষ্টা, অন্যদিকে তখন আরও বিপজ্জনক জিগির অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। পঞ্চায়েত নির্বাচনে পুরুলিয়ায় ভাল ফল করতে পারেনি অভিষেকের দল। কিন্তু অভিষেকদের ‘গণতন্ত্রে’ পরাজয় বলে কোনও শব্দ নেই। তাই নির্ঘণ্ট দিয়ে তিনি ঘোষণা করছেন, কবে পুরুলিয়া যাবেন সে জেলাকে বিরোধীশূন্য করতে।

পুরুলিয়াকে বিরোধীশূন্য করা হবে— এ কথার অর্থ কী? সবে তো নির্বাচন হল। জনগণ রায় দিয়ে জানিয়েছেন, পুরুলিয়ায় বিরোধী পক্ষ শাসকের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। এর পরেও বিরোধীকে নিশ্চিহ্ন করা যায়। কিন্তু তার জন্য আপাতত পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হয়। কারণ পঞ্চায়েত নির্বাচন আবার পাঁচ বছর পরে। কিন্তু অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তো পাঁচ বছর পরের নির্বাচনের কথা বলছেন না। অবিলম্বে পুরুলিয়া জেলাকে বিরোধীশূন্য করার অঙ্গীকার করছেন।

কিসের ভিত্তিতে এই অঙ্গীকার করছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়? সংখ্যার বিচারে বিরোধীশূন্য? আদর্শের বিচারে বিরোধীশূন্য? নাকি বিরোধী কণ্ঠস্বরশূন্য? স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন যে রয়েছে, সে বোধও সম্ভবত নেই।

রাজনৈতিক মূল্যবোধে এই সাংঘাতিক ক্ষয় কতটা বিপদের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে আমাদের, বুঝতে পারছি না আজ হয়তো অনেকেই। তবে যে বিপদের বীজ বোনা হচ্ছে, তা কাউকে রেহাই দেবে না। যাঁরা বীজ বুনছেন, বিষবৃক্ষের ফল তাঁদের অপেক্ষাতেও থাকবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement