ঐতিহাসিক বঞ্চনার প্রতিকার

স্বাধীনতা। এবং দেশভাগ। সিরিল র‌্যাডক্লিফ সীমান্তরেখা টানার পর এক লহমায় লক্ষ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তুর তকমা অর্জন করলেন। দাঙ্গা আর হিংসা এবং নিপীড়নের ভয়ে ছিন্নমূল, সহায়সম্বলহীন মানুষের স্রোত আছড়ে পড়ল এ পারে। ‘উদ্বাস্তু’ কথাটির সঙ্গে মানবাধিকার, গণপলায়ন, হিংসা, জাতীয় নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়গুলো জড়িয়ে থাকে। থেকে যায় বুকের ভিতরের অনন্ত হাহাকার। জুড়ে যায় নিরবচ্ছিন্ন অপমান, অসম্মান।

Advertisement

পরম ভট্টাচার্য ও অর্পিতা দত্ত

শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share:

স্বাধীনতা। এবং দেশভাগ। সিরিল র‌্যাডক্লিফ সীমান্তরেখা টানার পর এক লহমায় লক্ষ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তুর তকমা অর্জন করলেন। দাঙ্গা আর হিংসা এবং নিপীড়নের ভয়ে ছিন্নমূল, সহায়সম্বলহীন মানুষের স্রোত আছড়ে পড়ল এ পারে। ‘উদ্বাস্তু’ কথাটির সঙ্গে মানবাধিকার, গণপলায়ন, হিংসা, জাতীয় নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়গুলো জড়িয়ে থাকে। থেকে যায় বুকের ভিতরের অনন্ত হাহাকার। জুড়ে যায় নিরবচ্ছিন্ন অপমান, অসম্মান।

Advertisement

১৯৫১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, মোট ৮০ লক্ষ মানুষ দু’দিকের দুই সীমান্ত পেরিয়ে স্থায়ী আশ্রয়ের সন্ধানে ভারতে চলে আসেন। তাঁদের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ছিল ৫০ লক্ষ, পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৩০ লক্ষ।

১৯৪৭ সালের ১ মার্চের পর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যাঁরা ভারতে এসেছিলেন তাঁদের জন্য ১৯৫৪ সালে ডিসপ্লেসড পার্সনস (কমপেনসেশন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন) অ্যাক্ট প্রণয়ন করা হয়। এই আইনে নাগরিকত্ব প্রদান ছাড়াও নানা ধরনের সুযোগসুবিধে নিশ্চিত করা হয়। দেশভাগের মতো অন্যায়ের শিকার বাস্তুহারা উদ্বাস্তুদের সার্বিক পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে এই মানবিক আইনটি প্রণয়ন করা হয়। লক্ষণীয়, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মার খেয়ে, তাড়া খেয়ে, ভয়ে অপমানে যাঁরা ভারতে চলে এসেছিলেন তাঁদের অধিকাংশই হিন্দু এবং শিখ।

Advertisement

আর পূর্ব সীমান্ত পার হয়ে চলে আসতে বাধ্য হলেন যাঁরা? সম্প্রতি, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (২০১৬) সংসদে পেশ হওয়ার পর বিজেপি সংসদ মীনাক্ষী লেখি বলেছেন, দেশভাগের পর পশ্চিম পাকিস্তানে নির্যাতিতদের ভারতে আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে যতটা নজর দেওয়া ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রে তার ১ শতাংশ উদ্যোগের নজির নেই। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলটি যে নাগরিকত্ব প্রদান নয়, নাগরিকত্বের জন্য আবেদনের একটি প্রক্রিয়া, সেটা স্পষ্ট। এটাও বিলক্ষণ স্পষ্ট যে, বিলটি তড়িঘড়ি পাশ করানোর এই উদ্যোগ পূর্ব ভারতে হিন্দু উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিয়ে স্থায়ী ভোটব্যাঙ্ক নির্মাণের জন্য বিজেপির একটা সুচিন্তিত পরিকল্পনা। কিন্তু তার পরেও এই ঐতিহাসিক সত্য অস্বীকার করা যায় না যে, ১৯৪৭ সালে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের স্বার্থে ভারত সরকার অত্যন্ত মানবিক পদক্ষেপ করলেও ঠিক তার উল্টোটা ঘটেছিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে এ দেশে আশ্রয় নেওয়া বাস্তুহারাদের ক্ষেত্রে।

যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভারতে আসা শিখ ও হিন্দুদের পুনর্বাসন, ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা হয়েছিল এবং ভারতে প্রবেশের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা ভারতের নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন। অথচ বাঙালি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন হল না। তাঁরা বাংলা ও বাংলার বাইরে রাষ্ট্রহীন অবস্থায় দিনমজুর, বস্তিবাসী হলেন। ‘ট্রানজ়িট ক্যাম্প’-এ ঠুসে রাখা হল তাঁদের। অসহায় মানুষগুলি বাঁচার জন্য অবৈধ দখলদারিও করেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা এই উদ্বাস্তুদের প্রায় ৯০ শতাংশই বাঙালি হিন্দু। পরে আসা আরও উদ্বাস্তু, যাঁদের সারা দেশে আদিবাসীবহুল জঙ্গল এলাকায় আন্দামান থেকে উত্তরাখণ্ড, দণ্ডকারণ্য থেকে দক্ষিণ ভারতে ‘পুনর্বাসন’ দেওয়া হল, তাঁদের অধিকাংশকেই নাগরিকত্ব দেওয়া হয়নি। তাঁরা সংরক্ষণ ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত এবং বাস্তবে তাঁদের মাতৃভাষায় শিক্ষারও অধিকার নেই। তাঁরা ক্ষতিপূরণও পাননি কস্মিনকালে। পশ্চিমবঙ্গে এই অসহায় নিপীড়িত উদ্বাস্তুদের অস্তিত্বের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেয় তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি। পরে এই উদ্বাস্তুরা বামপন্থীদের স্থায়ী ভোটব্যাঙ্ক হয়ে ওঠেন।

পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের সমস্যাকে উপেক্ষা করেই ক্ষান্ত থাকেননি তখনকার শাসকরা, দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব ডিসপ্লেসড পার্সনস এভিকশন অব পার্সনস ইন আনঅথরাইজ়ড অকুপেশন অব ল্যান্ড (কন্টিনিউয়েন্স অব প্রভিশন) আইন (১৯৬৪) প্রণয়ন করা হয়। এই আইন কার্যকর ছিল শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের জন্য। উদ্বাস্তুদের মধ্যে যাঁরা জমি জবরদখল করে বাস করছিলেন, এই আইনে তাঁদের উচ্ছেদের নিদান দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ গঠনের পর ফের উদ্বাস্তুদের স্রোত নামে ভারতে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে। সে সময় হিন্দুদের ওপর একতরফা অত্যাচার, গণধর্ষণ, হত্যা, সম্পত্তি লুট হয়েছে।

এখন, নির্যাতনের শিকার, বার বার দেশভাগের শিকার মানুষগুলোকে নাগরিকত্ব প্রদানে স্বাধীন ভারতে এই প্রথম এমন একটি বিল তৈরি করা হয়েছে, যা ইতিমধ্যেই লোকসভায় পাশ হয়েছে। স্বাধীন ভারতে এই প্রথম দেশভাগের শিকার পূর্ববঙ্গ ও শ্রীহট্টের হিন্দু বাঙালিদের আশ্রয় প্রদানেও নজর দেওয়া হয়েছে। অথচ এই ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬’র বিরোধিতায় উত্তাল আকাশবাতাস!

ভারতীয় আইন ও সংবিধান ক্ষেত্রবিশেষে দেশভাগের প্রায় পর পরই প্রায়শ্চিত্ত কর্মে নিয়োজিত হয়েছে। পঞ্জাব তার প্রমাণ। সময়োচিত জীবাণুনাশক দিয়ে গভীর ক্ষত শুকিয়ে তুলে মন শরীর নিরাময়ের পথ সাফ করা যায়। পঞ্জাবে সেটা হয়েছে। উদ্বাস্তু-বান্ধব আইন করেই হয়েছে। পূর্ববঙ্গ ও শ্রীহট্ট থেকে ভারত ভূখণ্ডে আসা মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হওয়া উচিত নয়।

• ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন